স্মৃতিতে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি

বাবার চাকরির সুবাদে আমার শৈশবের শুরুটা কাটে খুলনার সিএমবি কলোনিতে। সে সময় প্রতিটি শৈশবের স্মৃতিমাখা প্রভাতফেরি এখনো আমাকে আন্দোলিত করে। মফস্বলের শান্ত-নির্মল পরিবেশে সাংস্কৃতিক চর্চা হতো নিয়ম করে। প্রতিবছর কলোনির সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রভাতফেরি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। সেই পুরোনো শৈশবের অলসমাখা ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম আলো-আঁধারির মাঝে এক টুকরো প্রভাতফেরি দেখার জন্য। রক্তের ভেতরে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি বয়ে যেত যখন শুনতাম, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি। কলোনির প্রতিটি বিল্ডিংয়ের সামনে বানানো হতো শহীদ মিনার। দল বেঁধে সবাই ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতাম।

একবার আমার হাম হলো। সঙ্গে প্রচণ্ড জ্বর। বাইরে যাওয়া নিষেধ। একুশে ফেব্রুয়ারির দিন বিষণ্ন মনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে শহীদ মিনারে সবাইকে ফুল দিতে দেখছি। চঞ্চলা মন কিছুতেই ঘরে থাকতে চাইছে না। আমার মনকথন আঁচ করতে পেরে সেদিন আমার মা-বাবা পরম যত্নে আমাকে একটি ছোট শহীদ মিনার বানিয়ে দিয়েছিলেন। সে বয়সে এটা ছিল আমার জন্য অনেক বড় একটা উপহার।

তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতে আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে কোনো শহীদ মিনার তৈরি হলো না। আমাদের বড় ভাইয়েরা সেবার কোথায় গিয়েছিলেন মনে নেই। কিন্তু আমার ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। সব বিল্ডিংয়ের সামনে শহীদ মিনার তৈরি হলো কিন্তু আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে হলো না! মেনে নিতে পারলাম না। খেলার সাথিদের নিয়ে একটা মিটিং করলাম। কিছু কিছু ব্যাপারে আমার আস্ফালন আকাশচুম্বী। শহীদ মিনার একটা বানাতেই হবে। সে সময়কার ছোট ছোট হাতগুলো একত্র করে বানিয়ে ফেললাম ছোট্ট একটা শহীদ মিনার। কাদা দিয়ে তৈরি শহীদ মিনারে সবাই মিলে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালাম ভক্তি ভরে। দুপুরে যার যার বাসায় চলে গেলাম। রোদে আমাদের তৈরি ছোট্ট সেই শহীদ মিনার আরও শক্ত, পাকাপোক্ত হবে। বিকেলে আবারও আমরা সবাই একত্র হব। কিন্তু দুপুর না ফুরোতেই একদল দুষ্টু ছেলেমেয়ে এসে সেই শহীদ মিনারটা ভেঙে দিয়েছিল। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলাম। অনেক অনুরোধের পরও তারা কোনো কথা শোনেনি। আমাদের শৈশবের সেই শহীদ মিনারের সঙ্গে আমাদের মনটাও ভেঙে গুঁড়া গুঁড়া করে দিয়েছিল।

চতুর্থ শ্রেণি। খুলনায় আমার শেষ একুশে ফেব্রুয়ারি। বাবা বদলি হয়ে গেছেন ঢাকায়। কলোনির ‘কচি-কাঁচার মেলা’ নামের সাংস্কৃতিক সংগঠনে সবেমাত্র সদস্য হয়েছি। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে দিনভর রিহার্সাল। আমি সবার সঙ্গে কোরাস গাইব। কবিতা লেখা শুরু করি তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতেই। নিয়মিত পত্রিকায় কবিতা ছাপা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম। সাহস করে সংগঠনে কবিতাটি দিয়ে বলেছিলাম আবৃত্তি করব। সবাই ভীষণ খুশি হয়েছিল। শুরু হলো তবলা দিয়ে আমার কবিতার রিহার্সাল। প্রতিবেশী এক কাকি আমাকে বলেছিলেন, আমি কোনো দিন মঞ্চে উঠতে পারব না। মনে জিদ চেপে গিয়েছিল। তাঁর জন্যই সেই বয়সে আমি নিজে গিয়ে কচি-কাঁচার মেলার সদস্য হই। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানাই। অনুষ্ঠান যখন শুরু হলো তিনি এলেন আমার মায়ের সঙ্গে। আমরা কোরাসে একুশে ফেব্রুয়ারির গান গাইছি।

তিনি দেখছেন। তাঁর চোখে বিস্ময়! আমি তবলার সঙ্গে আমার কবিতা ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা, বাংলা আমার গান’ আবৃত্তি শুরু করলাম। মনে মনে কাকির সেই কটূক্তি আমাকে আহত করছে বারবার। কেন বললেন আমি কোনো দিন মঞ্চে উঠতে পারব না? বুকের ভেতরে অভিমানী আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। আড় চোখে তাকালাম কাকির দিকে। আবৃত্তি শেষে সবার আগে তিনিই দাঁড়িয়ে করতালিতে মুখর করে তুলেছিলেন সবার মাঝে। তার চোখে তখন বিজয়ের জলরাশি চকচক করছে! সেদিন আমি প্রথম উপলব্ধি করলাম, কিছু কিছু আঘাত জীবনে সামনে এগিয়ে দিতে সহায়তা করে। আমার ভেতরের জড়তাকে ছুড়ে ফেলতে যে আঘাত তিনি করেছিলেন, সে আঘাতে এখনো আমি মঞ্চে নির্দ্বিধায় পরিবেশনা করতে পারি। কাকির ভালোবাসার আগুন এখনো আমাকে অনেক বাধা অতিক্রম করতে সহায়তা করে।

আমার শৈশবের সেই স্মৃতি জড়ানো একুশে ফেব্রুয়ারি এখনো বুকের ভেতরে যত্ন করে লালন করে আসছি। প্রবাসে থেকেও বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে দুই কলম লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যাঁদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আজ বাংলা ভাষায় কথা বলছি, তাঁদের ঋণ কোনো দিনও শোধ দিতে পারব না। বীর সেই শহীদদের জন্য রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।