লেবাননে চিকিৎসাসেবা ও মহান একুশ

চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন একজন প্রবাসী
চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন একজন প্রবাসী

লেবাননের বাংলাদেশ দূতাবাস প্রবাসীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং বিনম্র শ্রদ্ধায় মহান একুশ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে। রাজধানী বৈরুতে দূতাবাস প্রাঙ্গণে ২৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার চিকিৎসাসেবা প্রদান ও ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।

চিকিৎসাসেবা
বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে ও লেবাননে শান্তি মিশনে থাকা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর চিকিৎসক দলের সহযোগিতায় এই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিনা মূল্য চিকিৎসাসেবা প্রদান করার বিষয়টি বাংলাদেশ কমিউনিটিকে জানানো ও আগ্রহী প্রবাসীদের দূতাবাসে ফোন করে নাম রেজিস্ট্রেশন করার অনুরোধ জানানো হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই প্রায় ২০০ জন প্রবাসী চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য তাঁদের নাম নিবন্ধন করেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি দূতাবাসে সরাসরি এসে নাম নিবন্ধন করেন আরও প্রায় ১০০ জন প্রবাসী। দুপুর দুইটা থেকে বিকেল ছয়টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হলেও তা শেষ হয় রাত সাড়ে ১০টায়। বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ ছিল প্রবাসীদের মধ্যে।

উল্লেখ্য, এই কর্মসূচির আওতায় গত আড়াই বছরে প্রায় তিন হাজারের বেশি প্রবাসীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়ে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশে দূতাবাস।

চিকিৎসাসেবা নিতে আসা প্রবাসীরা
চিকিৎসাসেবা নিতে আসা প্রবাসীরা

গিয়াস উদ্দিন দুই বছর যাবৎ লেবাননে আছেন। মেডিকেল ক্যাম্প চলাকালে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। বাংলাদেশ দূতাবাসের এমন উদ্যোগে তিনি অত্যন্ত খুশি। তিনি বলেন, ‘আমি লেবাননে কাজ করি ক্লিনার হিসেবে। আমার বেতন খুব বেশি না। দু-তিন মাস পর পর এমন সেবা দেওয়ার জন্য আমি দূতাবাসকে ধন্যবাদ জানাই। এমন সেবা দিয়ে প্রবাসীদের পাশে থাকার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের রাষ্ট্রদূতকে ধন্যবাদ দিতে চাই।’

উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কন্টিনজেন্ট কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম নজরুল ইসলাম শান্তি মিশন দলের প্রধান হিসেবে আছেন। তিনি তার বক্তব্যে এমন একটি মহৎ কাজে নৌবাহিনীর সদস্যদের যুক্ত করার জন্য ধন্যবাদ জানান। যত দিন নৌবাহিনীর সদস্যরা লেবাননে শান্তি মিশনে থাকবে তত দিন তাঁরা এমন সেবা দিতে চান বলে তিনি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন।

চিকিৎসাসেবা নিতে আসা প্রবাসীরা
চিকিৎসাসেবা নিতে আসা প্রবাসীরা

দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুল মোতালেব সরকার বলেন, ‘লেবাননে চিকিৎসাব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তা ছাড়া রয়েছে ভাষা ও আকামা সমস্যা। তাই প্রবাসীরা ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। বিনা চিকিৎসায় দিন যাপন করেন। ফলে সামান্য রোগে আক্রান্ত হলেও পরে তা জটিল আকার ধারণ করে। তাদের এসব সমস্যার কথা চিন্তা করেই আমাদের এ প্রয়াস।’ ভবিষ্যতেও এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।

সেবা নিতে আসা প্রবাসীরা যাঁরা অনেক দূরদূরান্ত থেকে এসেছিলেন, তাঁদের জন্য হালকা আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া ব্যবস্থাপত্রের সঙ্গে দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় ওষুধ।

একুশ একটি চেতনার নাম
বাংলাদেশ দূতাবাস যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে। সকাল সাতটা এক মিনিটে প্রায় শতাধিক প্রবাসী বাংলাদেশির উপস্থিতিতে রাষ্ট্রদূত আবদুল মোতালেব সরকার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত ও দূতাবাসের তৈরি অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। শহীদবেদিতে তাঁর পুষ্পস্তবক অর্পণের পরপরই বাংলাদেশি বিভিন্ন সংগঠন শহীদবেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।

অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন আবদুল মোতালেব সরকারসহ বাংলাদেশি বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা
অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন আবদুল মোতালেব সরকারসহ বাংলাদেশি বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা

২১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার লেবাননে কর্মদিবস থাকায় বিকেলে আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। কোরআন থেকে তিলাওয়াতের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর বায়ান্নর ভাষাশহীদদের স্মরণে ও ঢাকার চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের প্রেরিত বাণী পড়ে শোনানো হয়। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভাষাশহীদদের জন্য বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আলোচনায় উপস্থিতি
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আলোচনায় উপস্থিতি

আলোচনায় বেশ কয়েকজন প্রবাসী একুশের ওপর বক্তব্য দেন। তাঁরা তাঁদের বক্তব্যে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। রাষ্ট্রদূত তাঁর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা ও গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করেন। মহান ভাষা আন্দোলন ও বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর অবদান তিনি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আলোচনায় বক্তব্য দিচ্ছেন আবদুল মোতালেব সরকার
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আলোচনায় বক্তব্য দিচ্ছেন আবদুল মোতালেব সরকার

তিনি বলেন, ‘একুশ হলো একটি চেতনার নাম। একুশ আমাদের শিখিয়েছিল কীভাবে অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে ন্যায়সংগত দাবি আদায় করে নিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে একুশই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ দেখিয়েছিল।’ মাতৃভাষার চর্চা ছাড়া কোনো দিনই পরিপূর্ণ শিক্ষা লাভ করা যায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে বা প্রয়োজনের তাগিদে অবশ্যই আমরা বিদেশি ভাষা শিখব, তবে তা যেন কোনোভাবেই মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে না হয়।’

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

একুশের চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অর্জন তুলে ধরেন। এ ছাড়া প্রবাসীদের জন্য বর্তমান সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপও তিনি তাঁদের অবহিত করেন।

আলোচনা পর ছিল বাংলাদেশ দূতাবাসের সাংস্কৃতিক দলের পরিবেশনা। দলের শিল্পীরা একুশের অমর সংগীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ ছাড়াও দেশের গান পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেন দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) আবদুল্লাহ আল মামুন।