কিছু ধূসর আবেগ

লেখিকা
লেখিকা

দেশে নাকি এখন বিয়ের আগে ও পরের বহু অনুষ্ঠান যোগ হয়েছে। আমার বিয়ের সময় এনগেজমেন্ট, দুই হলুদ, মেহেদী, বিয়ে ও বউ ভাত পর্যন্ত দেখে এসেছিলাম। এখন বিত্তবানেরা করেন প্রি–অ্যানগেজমেন্ট পার্টি, অ্যানগেজমেন্ট পার্টি, ব্যাচেলর পার্টি, হেন্স পার্টি, ব্রাইডাল শাওয়ার, হলুদ, সংগীত, মেহেদী, বিয়ের রিসেপশন, ওয়ালিমা ও ফিরানি পার্টি ইত্যাদি ইত্যাদি। দূর থেকে এসবের ছবি দেখি আর মনে মনে ভাবি, ইস এ রকম একটা বিয়ে যদি খেতে পারতাম! বাইরে থাকার কারণে চাচাতো বোন, খালাতো ভাই থেকে শুরু করে অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবের বিয়ে মিস করেছি। নতুন কারও বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনলেই মনে মনে হিসাব করি, সেই সময় আমার পক্ষে দেশে যাওয়া সম্ভব হবে কিনা, বিয়েটা খেতে পারব কিনা।

বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোর মতো বিয়ের খাবারগুলোও আকর্ষণীয় হয়ে চোখের সামনে ভাসে। কত দিন বিয়েবাড়ির কাচ্চি বিরিয়ানি, জালি কাবাব, রোস্ট, বোরহানি বা জর্দা খাই না! অথচ এগুলো সবই নিজে রান্না করতে পারি। তারপরও মনে হয় দেশের বিয়েবাড়ির খাবারের স্বাদই আলাদা। যত রান্নাই জানি না কেন, ও রকম স্বাদ কক্ষনোই হবে না। বোনকে এ কথা বলতে সে হেসে উত্তর দিল, এখন বিয়েতে এসব মেন্যু চলে না। মানুষ চিকেন গ্রিল, ফিশ কাটলেট, এসব বেশি পছন্দ করে। শুনে ভাবলাম হবেও বা, প্রোগ্রামের ধরন যখন বিদেশি হয়ে গেছে, খানাপিনাও যে বিদেশি হবে সে আর বিচিত্র কী! একবার গিয়ে দেখতেই হবে কতটা পরিবর্তন হলো সবকিছু।

পরিবারের কয়েকজন প্রবীণ সদস্যকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতে সবাই দেখি বিরক্তি প্রকাশ শুরু করলেন। আধুনিক এই কালচার তাঁরা পছন্দ করেন না। দেশীয় সংস্কৃতি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের নামে শো অফ, টাকাপয়সার অপব্যবহার, এগুলো কখনোই সুফল বয়ে আনবে না, এই জাতীয় কথা শুনতে হলো। বুঝলাম খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা এই ব্যাপারটির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। আর শুধু বয়োজ্যেষ্ঠই বা বলছি কেন? আমাদের জেনারেশনের অনেককেই দেখলাম বিয়ের নামে এই অযথা হুলুস্থুল অপছন্দ করে। তাঁদের চিন্তাভাবনা খুব বাস্তবিক ও বৈষয়িক। তাঁরা বলেন, লোক দেখিয়ে এত টাকা খরচ না করে টাকাগুলো দিয়ে নতুন বিবাহিত দম্পতির নামে ব্যাংকে একটা সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হাজার গুণ ভালো। সত্যিকার উপকার হবে তাতে। কিংবা টাকাগুলো দিয়ে নববিবাহিত দম্পতি পছন্দের জায়গায় মধুচন্দ্রিমা করে এল। একটা বড় শখ পূরণ। খামোখা হাজার লোককে দশ রকম প্রোগ্রাম করে খাইয়ে কী লাভ? আর তা ছাড়া অতিসাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন পরপর এত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেও আগ্রহ বোধ করেন না। ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যামের ঢাকা শহরে এক বিয়েকে কেন্দ্র করে সাত–আট দিন পরপর সময় দেওয়া এদের কারওর কর্ম নয়। জ্যাম ঠেলে পাঁচটা প্রোগ্রামে আসা যথেষ্টই ক্লান্তিকর। তাঁরা চান অনুষ্ঠান আরও সংক্ষিপ্ত হোক। দুটি হলুদ একসঙ্গে করে সম্মিলিত একটা হলুদ হোক। আর এরপরে শুধু বড় করে একটা বিয়ের রিসেপশন হোক। ব্যাস, দুই দিনেই কেল্লাফতে। এর বেশি লম্বা টেনে সবাইকে বিরক্ত করার কী মানে?

আমি সবার সব যুক্তিই চুপচাপ শুনে যাই। কোনো মতামত দিই না। আসলে পুরোটাই যার যার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও ইচ্ছার ব্যাপার। যে যেটা যে রকম ভাবে করতে চায়, সে সে রকম করবে। আমি বলার কে? হতাশ হয়ে ভাবি, মনের মতো একখানা দেশি বিয়ে এ জন্মে বুঝি আর খাওয়া হবে না। সারা জীবন জেনে এসেছি মধ্যবিত্তের অর্থের প্রাচুর্য না থাকুক তাদের আবেগ সব সময় বাঁধভাঙা। মানবিক ব্যাপারগুলোতে তারা ধনী। কিন্তু ইদানীং কেন যেন মনে হয় দেশের বর্তমান অবস্থা এই সাধারণ ছা-পোষা মানুষগুলোকেও যান্ত্রিক করে দিয়েছে। কারও ঘরে নতুন শিশু জন্ম নিলে অথবা কারও বিয়ে বা জন্মদিনে দূর–দূরান্ত থেকে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে আত্মীয়স্বজনেরা ছুটে আসতেন। এ কথা কল্পনাও করা যেত না যে তাঁরা প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করাটাকে একটা বার্ডেন মনে করবেন। অথচ এখন করেন।

আত্মীয়দের মধ্যে আত্মার টানের থেকে এখন দায়বদ্ধতা বা দায়িত্ববোধ বেশি কাজ করে। আমাদের ছোটবেলায় ছুটির দিনে মেহমান আসা একটা সারপ্রাইজের মতো ছিল। বিনা খবরে সবাই একে অপরের বাড়ি যেতেন বেড়াতে। আত্মীয়স্বজনেরা এলে আমরা খুশিতে লাপাতাম। বাড়ির বড় বা পুরুষ কাউকে তৎক্ষণাৎ দোকানে পাঠানো হতো খাবারদাবার কেনার জন্য। এখন এই দৃশ্য কল্পনাও করা যায় না। আগে থেকে না জানিয়ে কেউ আর কারও বাড়িতে যান না। ১০ দিন আগে থেকে এখন খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয় অমুক দিন অমুক জন ফ্রি আছেন কিনা। অমুকের সঙ্গে তমুকের সময় মিলছে কিনা। তমুক তখন গাড়ি ফ্রি পাবেন কিনা। লাঞ্চের বদলে ডিনারের সময় আসলে সমস্যা হবে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই যুগের, এই ব্যস্ত সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই এটা সঠিক। সবার যেহেতু সুবিধা–অসুবিধা আছে তাই আগেভাগে জানিয়ে, সবার সময় ম্যাচ করে আত্মীয়–পরিজন ও বন্ধুবান্ধবদের দেখা হওয়াটাই বেশি প্র্যাকটিক্যাল।। তা–ও হঠাৎ হঠাৎ বলতে ইচ্ছে করে, ইশ্‌ আমরা যদি এত বাস্তববাদী আর যান্ত্রিক না হয়ে সেই আগের সময়ের মানুষগুলোর মতো হয়ে যেতে পারতাম, তাহলে প্রিয় মুখগুলো দেখতে পাওয়ার আনন্দটাই অন্য রকম হতো!