ছোঁয়া!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দুই বেডরুমের একটিতে দুটি খাট আছে। আফরোজা দুই খাটের মাঝখানে আলনা দিয়ে পার্টিশন দেয়। তাতে আলাদা রুমের মতো হলো। আলনায় একটা শাড়ি পেঁচিয়ে দিল যাতে ফাঁকফোকর দিয়েও অন্য খাটের মানুষটাকে দেখা না যায়। সঙ্গে দুজনের খাটের ওপরই মশারি টাঙায়, মশা ও আড়ালের জন্যও।

আফরোজার মা আর দাদি এতেকাফ নেবেন তাই এত আয়োজন।

মা মনোয়ারা শাশুড়িকে চোখের সামনে দেখবেন, কিন্তু কথা বলবেন না বা কুশলাদি জানতে চাইবেন না, তা হবে না। তিনি এমনিতেই কথা একটু বেশিই বলেন।

এক যুগের কিছু সময় আগেও এত কথা বলতেন না। স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করানোর পরই তার মুখে যেন কথার খই ফুটে। তখন আফরোজার বয়স সাড়ে পাঁচ বা ছয় চলছে। তারও কয় বছর আগে থেকে স্বামী, শাশুড়ি ও আশপাশের অনেকের কাছেই ‘মেয়ের মা’ এই খোঁটা বারবার শুনতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর পেটে নাকি ছেলে সন্তান নেই!

অথচ এখন মনোয়ারা মেয়ে আফরোজার মুখে শুনছেন, মায়ের পেটে ছেলে আসবে, নাকি মেয়ে তাতে মায়ের কোনো দোষ নাই। যদিও সব আল্লাহর হুকুমে হয়। তবুও দোষ যদি থেকে থাকে, তবে তা বাপের। তাঁর কারণেই সন্তান ছেলে বা মেয়ে হয়।

কথাটা শোনার আগে নিজেকে অপরাধী ভাবতেন। শোনার পর তা অনেকাংশে কমে গেছে মনোয়ারার। যদিও এটা ভেবেও অবাক হন, অপর পক্ষের ঘরে ছেলে সন্তান জন্মাল কীভাবে!

দেড় যুগেরও বেশি সময়ের সংসার মনোয়ারার। প্রায় কুড়ি বছর। পাঁচটা কন্যাসন্তান তাঁদের! দুই কন্যার বিয়েও দিয়েছেন। প্রবাসী বর তাদের বিদেশেও নিয়ে গেছে।

এর পরও স্বামীর একটা ছেলে সন্তানের জন্য হাহাকার। বারবার দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ। মনোয়ারা অনেকটা বিরক্ত আর অভিমানী হয়েই তাঁকে আরেকটা বিয়ে করতে বলেন। এত বছরের সংসার, না হোক প্রেমের বিয়ে। কিশোরী বউ মনোয়ারাকে সদ্য যুবক মনসুর কম ভালোবাসেননি। প্রেম ষোলো আনাই ছিল। এত বছরের দাম্পত্য জীবনেও কোনো টুঁ শব্দ হয়নি তাঁদের। শুধু একটাই দোষ, তাঁর পেটে সব কন্যাসন্তান ছিল।

এরপরও স্বামী মনসুর আলম খুশি মনেই বিয়ে করেছেন এবং নতুন বউ পেয়ে মনোয়ারাকে দ্বিতীয় পছন্দতেও রাখেননি। একেবারে পর করে দিয়েছেন। আট আনা খবরও রাখেন না তাঁদের। নামমাত্র বউ হয়ে আছেন মনোয়ারা।

তাই হয়তো মনের গোপন কষ্টটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই, মনটা হালকা করার জন্যই এত কথা বলেন মনোয়ারা। এমতাবস্থায় যেন চুপচাপ থাকেন, এতেকাফ যেন এতেকাফের মতো হয়, তাই আফরোজার এই ব্যবস্থা।

গত বছর পর্যন্ত এসব কাজ আফরোজা ও তার বোন আফসানা মিলে করত। দুই বছর ধরে মনোয়ারা ও তার শাশুড়ি এতেকাফ করছেন।

এ বছর আফসানা নেই। নয় মাস আগে তার বিয়ে হয়ে গেছে। এবার সবকিছু আফরোজাকে একা করতে হচ্ছে।

আফরোজা রাতের বেলা অন্য রুমে একা থাকবে। অবশ্য একা থাকতে সে অভ্যস্ত। ড্রয়িংরুমে একপাশে সোফা, অন্যপাশে খাট রয়েছে। খাটে শুয়ে এক্স ফাইলস দেখতে দেখতে কত রাত যে ভয়ে আধমরা হয়ে সে একা ঘুমিয়েছে, হিসাব নেই। তবুও দেখা বন্ধ করেনি বা বেডরুমে যায়নি।

১১টা বাজতেই চুপচাপ গ্রামের নিস্তব্ধতায় ভয়ে শিহরিত হয়ে অনুষ্ঠানটা দেখতে তার ভয়ের চেয়ে আলাদা একটা মজা লাগে বেশি।

কিন্তু এখন ঘরের বাকি দুই ব্যক্তিই বলতে গেলে এক রুমে বন্দী হয়ে থাকবেন। তা ছাড়া তাদের ঘরটা রাস্তার পাশে, পুকুর পাড়ের বাগানে তৈরি করা হয়েছে। আগে তারা বিকেলবেলা বাগানে আসত পেয়ারা, শরিফা ও লেবু এসব ছিঁড়তে। ঘর বাঁধার জন্য সব গাছ কেটে ফেলতে হয়েছে। খুব খারাপ লেগেছিল আফরোজার। গাছের ডালে এতগুলো পেয়ারা লেবু ঝুলে ঝুলে থাকত, কী সুন্দরই না লাগত। আর সে আনন্দ নিয়েই তা ছিঁড়ত।

তিন বছর আগে বড় মেয়েরা মিলে ঘরটা বেঁধে দিয়েছে। এরপর থেকে মনোয়ারাকে চোখের সামনে তাঁর নিজের শয়নকক্ষে সতিনের কাছে স্বামীর স্থায়ী গমন দেখার যন্ত্রণা সহ্য করতে না হলেও, স্বামীকে তো প্রতিনিয়ত চোখের দেখা দেখতে পেতেন মনোয়ারা। সেটা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কষ্টটাও তাঁর বুকে বড় বাজে।

আফরোজাদের ঘরের আশপাশে আর কোনো ঘর নেই। খুব জোরে চিল্লিয়ে না ডাকলে বিপদ-আপদের কথা কেউ জানবেও না।

আফরোজার সামান্য একটু ভয় ভয় লাগছে এবার। যদিও ভার্সিটির অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী, ১৯ বছর বয়সী আফরোজা নিজেকে সাহসীই ভাবে। আফরোজা তাদের প্রতিবেশীর মেয়ে শারমিনের মাকে বলে আসে, রাতে যাতে শারমিনকে এতেকাফের এই ১০ দিন তার সঙ্গে থাকতে দেন। তিনি না করেন না, এক কথাতেই রাজি হন।

আফরোজাদের ঘরে কাজ একেবারে কম নয়। ঘর ঝাড়ু, মোছা, বাথরুম পরিষ্কার করা। প্রতি নামাজের ওয়াক্তে মা-দাদির জন্য বালতি ভরে বাথরুমে গরম পানি রেখে আসা। ইফতারের সময় সব ইফতারি, সাহরির সময় ভাত-তরকারি তাঁদের বিছানায় দিয়ে আসা। শুধু ভাত-তরকারি নয়, সঙ্গে দুধ, কলা, চিনি, কখনো ঘিও দিয়ে আসতে হয়। মা-দাদি দুজনেরই এসব দিয়ে ভাত না খেলে কী যেন খাননি-খাননি, এমন নাকি মনে হয় ।

আফরোজা ছোটবেলায় খেয়েছিল শুধু। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে ওসব দিয়ে ভাত খেলেই বমি ভাব হয় তার।

তারপর, তাদের ওষুধ খাওয়ানো। সব থালাবাসন ধোয়া। ঘর গোছানো। মা-দাদিসহ তার নিজের কাপড় ধোয়া ইত্যাদি কাজ। কম নয় কিন্তু।

তাতে অবশ্য আফরোজার অসুবিধা হচ্ছে না। ভার্সিটি বন্ধ আছে। আর সে নিজেও গোছানো মেয়ে। এতসব কাজ করতে তার আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। বাকি সময় সে টিভি দেখে, গল্পের বই ও পাঠ্যবই পড়ে কাটাচ্ছে। বই পড়ার ভালো একটা অভ্যাস তার আছে। যদিও কোনো অভ্যাসই মাত্রাতিরিক্তও ভালো নয়। আফরোজার এই অভ্যাসটা একটু বেশিই। সে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়। পড়তে পড়তে মাথা ব্যথা করে ফেলে।

হাতে তিন-চারটা বই থাকলে কোনটা ফেলে কোনটা পড়বে, অস্থির হয়। এক দিনেই সব পড়ে ফেলতে চায়।

তাই কাজটাজ সব সেরেই পড়তে বসে সে। এখন তো মা-দাদি কেউই সাহায্য করতে পারবেন না তাকে। সেই বিবেচনা তার মাথায় আছে। আফরোজা বয়সের আগেই অনেক বুঝদার হয়ে গেছে। হয়তো জোড়াতালি দেওয়া পরিবারের সন্তানদের সময়ের আগেই বড় হয়ে যেতে হয়।

যদিও সাধারণত দিনে এত কাজের অর্ধেকও তাকে করতে হয় না। মা আর দাদিই প্রায় সব করে ফেলেন। আফরোজা তখন তাঁদের সাহায্যকারী হিসেবে সামান্যই কাজ করে। যেমন, ঘরটা ঝাড়ু দেওয়া, বাইরে থেকে কাপড় এনে আলনায় গুছিয়ে রাখা। মা তরকারি, শুঁটকি বা মাছ-মাংস কুটে ধুয়ে রাখলে, সন্ধ্যাবেলায় সে রেঁধে দেয়, এইটুকুই। দিনে তো ভার্সিটি থাকে।

ইফতার-সাহরির সময় ছাড়া আফরোজা মা-দাদির রুমে পারতপক্ষে ঢুকে তাদের বিরক্ত করতে চায় না।

দাদি যদিও তেমন কথা বলেন না। অজু করতে উঠলে, আফরোজা আশপাশে থাকলে হাতের ইশারায় গরম পানি দিতে বলেন। কিংবা ইশারায় ময়লা কাপড় দেখিয়ে দেন ধুয়ে দেওয়ার জন্য।

তবে নিজে নিজে যা বলেন, মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙার জন্য তা যথেষ্ট। দাদির ঘুম ভাঙলে বা বাথরুমে যাওয়ার দরকার হলে, তিনি বিছানা থেকে উঠতে উঠতে শব্দ করে দোয়া দরুদ পড়তে থাকেন। আফরোজার ধারণা, রাত বিরাতে দাদি ভয় কাটাতেই শব্দ করে দোয়া দরুদ পড়ে ভয় পাওয়া থেকে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। আর আল্লাহকে উদ্দেশ করে এক ডায়লগ প্রতিদিন দিতে থাকেন।

‘হে আল্লাহ, তুমি আমাকে পরা শাড়িতে, বাঁধা চুলে, সুস্থ সবলভাবে তোমার কাছে নিয়ে যেও...।’

এখনো প্রায় প্রতিরাতে দাদির এসব কথার আওয়াজ শুনে আফরোজার ঘুম ভাঙছে। আবার শুনে শুনেই ঘুমিয়ে পড়ছে সে। অ্যালার্ম বাজলেই জেগে ওঠে শুধু। উঠেই গ্যাসের চুলায় ভাত চড়িয়ে সবাইকে ডেকে তোলে, যাতে তাঁরা তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে নিতে পারেন। শারমিনও উঠে কিছু কিছু সাহায্য করে দেয়।

ওদিকে মা কিছু না কিছু বলবেনই। যেমন আজ আফরোজা ইফতারি দিতে গেলে মা বলেন, ‘জাকাতের সব টাকা দেওয়া হয়েছে? মনে করে দিয়েছিস তো? ফিতরার টাকা আলাদা করে রেখেছিস?’

আফরোজা ধমক দিয়ে ওঠে, ‘মা, সবকিছু আমি কাগজে লিখে নিয়েছি না! তুমি দুনিয়াবি চিন্তা বাদ দিয়ে আল্লাহর চিন্তা করো, আমি সব ঠিকঠাকমতো করব।’

‘আহা, এমনিই জানতে চাইছি আর কী।’ এই বলে তিনি কোরআন তিলাওয়াতে মনোনিবেশ করলেন।

মনোয়ারার বড় দুই মেয়ে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সঙ্গে তার কাছেও জাকাতের জন্য বেশ কিছু টাকা পাঠায়, গরিব মানুষদের দেওয়ার জন্য। তার জন্যও ঈদ, কোরবানির খরচ ছাড়াও মাসে মাসেও কিছু টাকা দেয়। বরের সঙ্গে তারা নিজেরাও বিদেশে কাজ করে।

রুমে মনোয়ারা বেগমের সাইডে বাইরের আলো, বাতাস আসে না বললেই চলে। শাশুড়ি জানালার পাশে খাটটা নিয়েছেন। মাঝখানে আলনা দেওয়ায় মনোয়ারাকে দিনের বেলাতেও অন্ধকারে থাকতে হচ্ছে। দিনরাত কোরআন তিলাওয়াত করছেন বলে প্রায় সারাক্ষণ তিনি লাইট জ্বালিয়ে রাখেন। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে তার সামান্য অসুবিধা হয়। কারণ, তিনি চোখে কম দেখেন, মোটা চশমা পরে থাকতে হয় ২৪ ঘণ্টা।

তো ইলেকট্রিসিটি না থাকলে তার একহাতের পাতা সমান কোরআন মজিদটা চোখের সামনে নিয়ে প্রায় অন্ধকারেও পড়ে ফেলেন।

চোখে একটু চাপ পড়ে, তাতে কী! চোখ এমনিতেও খারাপ, আর কত খারাপ হবে, তিনি তা-ই ভাবেন। আর কোরআন মজিদের অনেক সুরা তাঁর মুখস্থ। সুরা ইয়াসিন, মুজাম্মিল, আর রাহমান, মূলক আরও অনেক। তিনি কোরআন হাতে রাখলেও মুখস্থ পড়ে যান।

বিয়ের পরপর, বছরখানেক কোরআন না পড়ে তিনি প্রায় ভুলতে বসেছিলেন। একদিন তার বাপজান এসে খুব মন খারাপ করেন এই কথা শুনে। মেয়েকে অনেক যত্ন করে কোরআন পড়িয়েছেন ঘরে হুজুর রেখে। তারপর দিন থেকেই মনোয়ারা বিয়েতে বাপজানের দেওয়া ছোট্ট কোরআনটা দিনে দুই-তিনবারও পড়তে বসেছেন।

কোরআনটা অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। দুই-এক পাতা ছিঁড়েও গেছে এখন। কিন্তু মনোয়ারার মায়া পড়ে গেছে ওটার ওপর। তাই ঘরে আরও কোরআন থাকলেও বদলিয়ে নিতে ইচ্ছে করে না। বাপের দেওয়া কোরআন মজিদটা তিলাওয়াত করতে করতেই তিনি কবরে যেতে চান।

মনোয়ারার হিসেবে তাঁর শাশুড়ি চোখে ভালোই দেখেন। তিনি কোরআন পাঠের সময়ই শুধু চশমা চোখে দেন। তবে চশমা ছাড়াও পড়তে পারেন এখনো। বয়সের ভারে কোমর বাঁকা হলেও চাল-ডালের পাথর সহজেই বেছে ফেলতে পারেন তিনি।

আজ এতেকাফের সাত দিন পার হয়েছে। মনোয়ারা রাতদিন কোরআন তিলাওয়াত এবং নামাজ আদায় করলেও তাঁর কান খাড়া হয়ে থাকে মনসুর আলমের গলা শোনার জন্য। সাতটা দিন তাঁর গলা খাঁকাড়িও শোনেননি। একবারও কি মানুষটা এই ঘরে আসেনি! আফরোজাকে জিজ্ঞেস করে ধমক খেতে ইচ্ছে করছে না।

তারপরও সাহরির খাবার আনলে তাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলেন, ‘তোর বাপ এই ঘরে আসেনি? গলা শুনলাম না একবারও।’

‘আমার সঙ্গে প্রায়ই পানি আনতে গেলে বা বারান্দায় দাঁড়ালে দেখা হচ্ছে। তাই আসছে না মনে হয়। কাল কিছু বাজার এনে দিতে বলেছিলাম, এনে দিয়েছে।’

‘কই আওয়াজ শুনলাম না তো।’

‘রিকশা দেখে, আমি দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এসেছি।’

‘ও...।’

মনোয়ারা খুশি হতে পারেন না। বেচারা রিকশা থেকে নেমে এই ঘরে খানিকক্ষণ বসে তারপর যেত। যদিও রমজানের দিনে এক কাপ চা খাওয়ানো যেত না।

দুই ঘরের ব্যবধান মাত্র ৩০-৪০ কদমের তফাত। তবুও মনোয়ারা চান, তিনি যেন কিছু সময় এখানে বসে যান।

মনোয়ারাকে না হোক, মনসুর আলম তাঁর মাকেও তো এতেকাফ অবস্থায় একবার দেখে যেতে পারতেন। মনোয়ারা তখন না হয় একটু করে চোখের দেখা দেখে মন শান্ত করতেন। মনোয়ারা মনেপ্রাণে ঈদের দিনের অপেক্ষা করেন।

আজ প্রায় তেরো বছর হতে চলল। এই চোখের দেখা আর গলার স্বর শুনেই মনোয়ারা খুশি থাকার, সুখে থাকার চেষ্টা করছেন।

সতিন তাঁকে বা তাঁর সন্তানদের কাউকেই আপন ভাবতে পারেনি। তাই মনসুর আলমও আস্তে আস্তে দূরে। অনেক দূরে সরে গেছেন। তবে ওই পক্ষের সন্তানেরা মনোয়ারা বলতে পাগল। এই এক রুমে বন্দী, এখানেও তারা দিনে দুই-তিনবার একনজর এসে দেখে যাচ্ছে। আফরোজা আশপাশে না থাকলে বড় মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে দুই টাকা আছে কি না, আবদারও করে গেছে।

মনোয়ারা তাদের এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছেন, এবার ঈদে ঈদির টাকা বেশি করে দেবেন তাদের দুজনকেই। এখন তো সঙ্গে টাকা নাই। বেশি দরকার হলে আফরোজার থেকে যেন নিয়ে নেয়।

অবশ্য তাদের আবার দরকার কী, ছোট ছেলেপুলে, কোনো কোনো দিন রোজা রাখে না, আচার চকলেট কিছু একটা কিনে খাবে হয়তো।

তারা অবশ্য আফরোজার কাছে টাকা কেন, কী দরকার, এত প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি নয়। তাদের কথা, আফরোজা আপার পছন্দসই না হলে ধমক খাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। আপা একটু রাগী আছে, বড় মায়ের মতো হয়নি। বড় মা হচ্ছেন ফ্রিজের পানির মতো ঠান্ডা স্বভাবের। কোনো দিন রাগ, গোসসা করতে দেখেনি তারা। বড় মা ধমকও দেননি। বড় মাকে সব গোপন কথা বলা যায়, যা তাদের নিজের মা বা বাবাকেও বলতে পারে না।

যেমন, বেশ কয়েক দিন আগে, ক্রিকেট খেলতে গিয়ে সেলিম চাচাদের মুরগির বাচ্চা পায়ে ব্যথা পেয়েছে। কেউ দেখেনি, বুঝতেও পারেনি। তাই তারাও গোপন করে রেখেছে। শুধু বড় মাকে এ কথাটা বলেছে তারা।

বড় মা চুপিচুপি ছানাগুলোর খবর আনতে গিয়েছিলেন। সব সুস্থ আছে দেখে ওদের আর কিছু বলেননি।

তবে তাদের বারবার বলেছেন, দেখেশুনে যেন খেলে, ছোট বাচ্চা বা পশুপাখি যাতে ব্যথা না পায়, সেদিকে যেন নজর দেয় তারা।

‘চাঁদ উঠেছে, ঈদের চাঁদ উঠেছে...।’

বাচ্চাকাচ্চাদের চিল্লানি শুনে মা-দাদি দুজনই বেরিয়ে পড়েন রুম থেকে। আফরোজা দুজনকেই জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমার জন্য অনেক দোয়া করেছ তো?’

‘অনেক দোয়া করেছি। মুখ দিয়ে যা করেছি, অন্তর আরও বেশি দোয়া করেছে রে।’

জবাব দেন তাঁরা।

আফরোজার আজ অনেক কাজ। কত নাশতা-খাশতা যে বানাতে হবে, মাছ-মাংসও কষিয়ে রাখতে হবে।

সকাল সাড়ে ১০টার ভেতর নামাজ শেষ করে মেহমান আসা শুরু হবে।

সকালে গোসল, ঘরটা আবার গোছানো, হালকা পরিষ্কার, নাশতা, রান্নার ফাইনাল টাচ, তা-ও কম না। মা-দাদিও কাজে হাত লাগান। দাদি কাজ না করে এক মুহূর্ত বসে থাকবেন না আর। উনি পুরোনো দিনের মানুষ, বসে থাকতে পারেন না একেবারে।

সকাল হয়। মা গোসল করে সস্তা ছাই রঙের শাড়িটা পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বারান্দায় পায়চারি করতে থাকেন। আফরোজা কিছু বলতে গিয়েও বলে না আবার।

বলতে চেয়েছিল, ‘মা এত সুন্দর প্রিন্টের, ভালো একটা শাড়ি কিনে আনলাম। তা না পরে, বাবার দেওয়া জাকাতের শাড়ির মতো এই পচা শাড়িটা কেন পরেছ?’

বলা হয় না, আসলে বলতে পারে না আফরোজা। মায়ের খুশি যে লুকিয়ে আছে ওই শাড়িতে।

নামাজ সেরে, আফরোজার বাবা ওই ঘরের ছোট দুই ভাইসহ এই ঘরে আসেন। মনোয়ারা যেন দরজা পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মনসুর আলমের ঢোকার দেরি, তিনি লাজুক ভঙ্গিতে পা ছুঁয়ে সালাম করতে বসে যান।

মনসুর আলম বলেন, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও আগে তো ঘরে ঢুকতে দাও।’

এই কথায় আরও লজ্জা পান তিনি। কিন্তু তবুও খুশি, একটু তো ছোঁয়া হলো তাঁকে! প্রতিবছর এই দিনের জন্যই যে তাঁর প্রতীক্ষা এখন।
...

ফারহানা বহ্নি শিখা: পশ্চিম লন্ডন, যুক্তরাজ্য।