ফুলেল ভালোবাসা

বাটিতে রাখা কাঠগোলাপ
বাটিতে রাখা কাঠগোলাপ

নিজের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা ব্যাপারটার উপলব্ধি ঠিক কবে থেকে এসেছে, সেটা বলা মুশকিল। তবে বাংলা চলচিত্র দেখে বেড়ে ওঠা আমাদের প্রজন্ম চাইতাম যেন জীবনে একটা প্রেম হয়। কিন্তু সেটা আমার জীবনে কখনোই হয়ে ওঠেনি বিভিন্ন কারণে। কখনো কখনো যখন প্রেম আমার ওপরে এসেছে পড়েছে, তখন আবার আমি নিজেই পালিয়ে বেঁচেছি। 

অবশেষে নিজের সম্বন্ধে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলাম যে আমি আসলে বনের পাখি। কারও মনের খাঁচায় আটকা পড়ে বন্দী জীবনযাপন আমার স্বভাববিরুদ্ধ। সেটাতে আমার নিজস্বতা বিলীন হয়ে যায়। তাই গায়ে পড়া প্রেমকেও দূরে ঠেলতে আমাকে খুব বেশি একটা বেগ পেতে হয়নি।

অবশেষে যখন বিয়ের নামে প্রেম আবারও ঘাড়ে এসে পড়ল, তখন আর পালানোর পথ পেলাম না। কারণ, ঘুড়ির নাটাই তখন অন্য একজনের হাতে চলে গেছে। উড়নচণ্ডী জীবনে প্রেমটাকে মানিয়ে নিতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। প্রেমের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় কাজটা আরও কঠিন হয়ে গেল। অবশ্য একটা বাড়তি সুবিধাও পাওয়া গেল। যাঁর সঙ্গে সারা জীবনের বন্ধনে বাঁধা পড়লাম, তিনিও আমার মতোই। তাঁর তেমন কোনো চাওয়া–পাওয়া ছিল না। তবু মনে মনে ভাবছিলাম, এই আটপৌরে প্রেমটাকে কীভাবে একটু রঙিন করা যায়। তখনই মাথায় এল ফুলের ভাবনাটা।

কদম ফুল হাতে লেখকের মেয়ে
কদম ফুল হাতে লেখকের মেয়ে

অফিস শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় প্রায় দিনই। অফিস শেষ করে বাসে ওঠার পর জ্যাম ঠেলে নানা রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় উত্তরার আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে। তারপর ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হয়ে আবার শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। কখনো অটোতে ঝুলে আবার কখনো বাসে আর ভাগ্যদেবী খুব বেশি প্রসন্ন হলে রিকশায় করে বাসায় ফিরতে হয়। অবশ্য গুলশান ছাড়িয়ে মূল রাস্তায় আসার পর বাস বদলে উত্তরার বাসে উঠতে হতো।

আমাদের অফিসটা ছিল গুলশানে, শুটিং ক্লাবের বিপরীতে। অফিস শেষে বের হয়ে গুলশান–১-এর মোড় পর্যন্ত হাঁটার পর ছয় নম্বর বাসে চড়ে গুলশান দুই হয়ে বনানী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে রাস্তা পার হয়ে উত্তরার জন্য বাসে উঠতে হতো। গুলশান–১ থেকে ২ হয়ে বনানী পর্যন্ত পুরো রাস্তাটায় জ্যাম লেগেই থাকত। জ্যামের মধ্যে ভ্রাম্যমাণ কিছু ফেরিওয়ালা বিভিন্ন ধরনের জিনিস বিক্রি করত। তবে আমার চোখ খুঁজে ফিরত ফুল বিক্রি করা বাচ্চাগুলোকে। ৮ থেকে ১০ বছরের মেয়ের কাছ থেকে ফুল নিতে নিতে ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে গেল যে আমি বাসে গুলশান–২–এ এলেই মেয়েটা কীভাবে যেন আমাকে খুঁজে বের করে ফেলত। হয়তোবা আমি ওর সঙ্গে একটু নরম সুরে কথা বলতাম তাই। ওর সঙ্গে কথা বলার সময় আমার মাথায় কাজ করত বাসায়ও আমার একটা মেয়ে আছে। আর সে যদি আজ পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াত।

রাস্তার পাশে ফুটে থাকা ভাঁট ফুল
রাস্তার পাশে ফুটে থাকা ভাঁট ফুল

মৌসুম অনুযায়ী ফুলের ধরন পরিবর্তন হতো। বকুল আর বেলি ফুলের মালা নিতাম বেশির ভাগ সময়। তবে একবার এই দুটোর কোনোটাই না থাকায় মেয়েটা আমাকে এক তোড়া ধবধবে সাদা ফুল দিয়েছিল। ফুলগুলোর সুবাস যেমনই হোক, দেখতে অনেক বাহারি ছিল। ঘরে ফুলদানির মধ্যে সাজিয়ে রাখলে ঘর উজ্জ্বল হয়ে উঠবে নিশ্চিত। এভাবে ফুল নিয়ে এসে শুরুতে গিন্নির হাতে দিতাম লুকিয়ে লুকিয়ে। পরে একদিন মেয়ের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার পর তার হাতেই ফুলের মালা দিয়ে দিতে হতো। এরপর বুদ্ধি করে দুটো করে মালা কেনা শুরু করলাম। কিন্তু তাহিয়া ঠিকই টের পেয়ে দুটো মালাই আমার কাছ থেকে নিয়ে দুই হাতে ব্যান্ডের মতো করে জড়িয়ে সারা ঘরময় ঘুরে বেড়াতে শুরু করল। ওকে দেখে মনে হতো পাড়ার উঠতি বয়সী মাস্তান। একদিন মেয়েকে বললাম, তুমি আমাদের একটা মালা দাও, আমি আর তোমার মা মালাবদল করব। শুনে সে কী মনে করে জানি সানন্দে রাজি হয়ে গেল এবং আমাদের মালাবদলের ছবি তুলে দিল।

এরপর একসময় বহুজাতিক কোম্পানির চাকচিক্যময় চাকরি ছেড়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দিলাম। রাতারাতি বেতন একেবারে চার ভাগের এক ভাগে নেমে এল। কিন্তু ফুল কেনার অভ্যাসটা ছাড়তে পারলাম না। আগারগাঁওয়ে ছিল আমাদের অফিস। অফিস থেকে বের হয়ে আগারগাঁও সিগন্যাল হয়ে গেলে সেখানেও কিছু কম বয়সী বাচ্চা ফুল বিক্রি করত। তবে এদের ফুলের মধ্যে নতুনত্ব ছিল। এখান থেকেই প্রথম কদম ফুল কিনেছিলাম। ফুল নেওয়ার পর ওরা যা দাম চাইত, সেটাই দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে সেটা প্রায়ই সম্ভব হতো না। তখন ওদের জিজ্ঞেস করতাম কমে দিতে পারবে কি না? শুরুর দিকে ওরা রাজি না হলেও পরের দিকে দিয়ে দিত। আমি অবশ্য অন্য কোনো দিন সেটা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। এই বাচ্চাগুলোর একটা জিনিস আমাকে খুবই অবাক করত, সেটা হচ্ছে ওদের নেটওয়ার্ক। আমার মনে হয় ওরা কাজের শেষে নিজেদের মধ্যে প্রতিদিনের ঘটনাবলি নিয়ে আড্ডা দেয়। কারণ, আমি একজনের কাছ থেকে ফুল নিলেও অন্যরা ঠিকই আমাকে চিনে ফেলত এবং ফুলের দাম নিয়ে আর আমার ওদের সঙ্গে কথা বলতে হতো না।

এরপর আগারগাঁওয়ে ফুলের বাজার বসা শুরু করলে একদিন সহকর্মী আসিফ এসে বলল, ভাই, ওখানে সকালবেলা গেলে পাইকারি দামে অনেক ভালো ফুল পাওয়া যায়। প্রায় দিনই কর্মব্যস্ততায় ভুলে যেতাম। তবুও মাঝেমধ্যে গিয়ে কিনে এনে টেবিলে পানির বোতলের মধ্যে সাজিয়ে রাখতাম। তারপর ফেরার পথে বাসায় নিয়ে যেতাম। এভাবেই একদিন ফেরার পথে উত্তরার আজমপুর থেকে উত্তরখান যাওয়ার কোনো বাহন পাচ্ছি না। ওখানে সাধারণত অটোরিকশা চলে। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ পুলিশি অভিযানে অটোরিকশাগুলো হারিয়ে যেত। তখন যে যার মতো করে বাসায় ফিরত। হয়তো বা এখনো ফেরে।

পলাশ ফুল
পলাশ ফুল

এমনই একদিন কোনো অটোরিকশা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একটা বাস এলে সেই বাসটাকে বাস না বলে মিনিবাস বলাই ভালো। আজমপুর থেকে উত্তরখান রুটে দুটো মাত্র বাস চলত। বাসটা এসে দাঁড়ানো মাত্রই সবাই ওঠার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিল। আমি বরাবরই এগুলোতে অপারগ। তাই গত্যন্তর না দেখে বাসের ছাদে উঠলাম। উঠে দেখি সেখানে ইতিমধ্যেই আরও একজন উঠে বসে আছেন। কথায় কথায় পরিচয় হলো। তার নাম মিজান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ। ঢাকা এসে মজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

বাসের ছাদে ভ্রমণ যতখানি আতঙ্কের, ঠিক ততখানিই আনন্দের। এর আগেও একবার ছাদে উঠে ভ্রমণ করেছিলাম। ঈদের ছুটি শেষে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় আসার সময় পাটুরিয়া ফেরিঘাটে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার মেজ ভাইয়ের বন্ধু তামিমসহ আমরা অনেকে। একটা করে বাস আসে আর চোখের পলকে সেটা ভরে যায়। তামিম একবার বাসের মধ্যে উঠে পড়লেও আমি আর উঠতে পারি না। অগত্যা তামিমকে আবার নেমে আসতে হয়। এই অবস্থা দেখে তামিম বলল, মিঞা ভাই, বুঝেছি আপনি বাসে উঠতে পারবেন না। চলেন, বাসের ছাদে যাই। আমি বললাম, চল যাই, একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। বাসের ছাদে বসে থাকা যতটা কঠিন হবে ভেবেছিলাম, ততটা আসলে কঠিন নয়। আরও কয়েকজন আমাদের মতো বাসের ছাদে উঠেছিলেন। তার মধ্যে একজন আবার ছাগল নিয়ে উঠেছেন। বাস চলতে শুরু করলে আমার ঘুম চলে এল। ঘুম ভাঙল পাশের ভদ্রলোকের চিৎকার শুনে—এই ভাই একে তো উঠেছেন বাসের ছাদে, আবার ভোঁসভোঁস করে ঘুমোচ্ছেন।

যা হোক, আজমপুর থেকে উত্তরখান যাওয়ার পথে আমি আর না ঘুমিয়ে মিজানের সঙ্গে সংসারের গল্প করতে গেলাম। আমার হাতে সেদিন সকালে আগারগাঁও বাজার থেকে কেনা জারবেরা ফুলগুলো মিজান ভাইয়ের হাতে দিয়ে মোবাইলে ছবি তুলে নিলাম।

এ ছাড়া ছুটির দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে তাহিয়া ও আমার পাড়া বেড়ানো ছিল অন্যতম শখের বিষয়। পাড়া বেড়াতে গিয়ে আমরা কুড়িয়ে আনতাম শিউলি ও ভাঁট ফুল। কোনো দিন প্রতিবেশীদের গাছ থেকে হাসনাহেনার শাখা বা সন্ধ্যা ফুলের শাখা। এ ছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষে আমরা ফুল কিনতাম। গোলাপ কিনেছি বলে মনে পড়ে না। বেশির ভাগ সময় কিনতাম রজনীগন্ধা। দেশি রজনীগন্ধায় অনেক বেশি সুবাস পাওয়া যায়, তাই সেটাই ছিল আমাদের প্রথম পছন্দ। দেশিটা না পেলে বিদেশিটা কিনতাম। প্তাহখানেক সারা বাসা রজনীগন্ধার সুবাসে ম–ম করত। শেষ কুড়িটা ফুটে ফুল হয়ে ঝরে পড়ার পর আমরা সেগুলো ফেলে দিতাম। এ ছাড়া বসন্তকালে আমাদের অফিসের গেটে একটা গাছে অনেক পলাশ ফুল ফুটত। অফিস থেকে ফেরার পথে মাঝেমধ্যেই সেই গাছের তলা থেকে পলাশ ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যেতাম।

হাসনাহেনা ও সন্ধ্যা ফুল
হাসনাহেনা ও সন্ধ্যা ফুল

বিদেশে আসার পর সস্তায় ফুল কেনার অভ্যাসে ছেদ পরে গেল সাময়িকভাবে। তবে অন্যভাবে আমরা ফুল জোগাড় করতে শুরু করলাম। স্টেশন থেকে হেঁটে আসার পথে গাছের তলা থেকে কখনো কাঠগোলাপ, কখনো গন্ধরাজ আবার কখনো গোলাপের ঝরে যাওয়া পাপড়ি, আবার কখনো কামিনীর ঝরে যাওয়া পাপড়ি মুঠোভরে কুড়িয়ে আনতে শুরু করলাম। বাসায় আনার পর তাহিয়া সেগুলো পরম যত্নে এক বাটি পানিতে ভাসিয়ে রেখে দিত। এভাবে ফুলগুলো বেশ কদিন ভালো থাকত এবং সুবাস বিতরণ করত আমাদের সারা ঘরে। আলাদাভাবে আমাদের তেমন একটা ফুল কেনা হয় না। এর একটা কারণ, অস্ট্রেলিয়াতে ফুলের দাম অনেক বেশি। তবু আমরা টিউলিপের সময়ে সুপার সোপ এলডি থেকে সস্তায় টিউলিপ ফুল কিনে আনি। টিউলিপ ফুলগুলো দেখতে এতই সুন্দর যে একগুচ্ছ শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই আমরা আরও একগুচ্ছ কিনে নিয়ে আসি।

বাংলাদেশেও আমাদের বাসা ছিল অনেক ছোট। আর অস্ট্রেলিয়ায় এখনো আমরা থাকি গ্র্যানি ফ্ল্যাটে। যেটাকে একটা বাসা না বলে বাসার বাচ্চা বলা উচিত। কারণ, একটা বড় বাসার সামান্য কিছু অংশকে আলাদা করে এই গ্র্যানি ফ্ল্যাট বানানো হয় বয়স্কদের কথা মাথায় রেখে। এর মধ্যেও আমাদের বাসাটা মাঝেমধ্যেই স্বর্গের রূপ নেয় রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসা এই ফুলগুলোর কল্যাণে। আমাদের জীবনে হয়তোবা জৌলুশ নেই। কিন্তু আমাদের জীবনে আছে ছোট ছোট সুখের হাজারো উপকরণ। আমার মনে হয়, আমাদের সবারই উচিত বড় সুখের উপলক্ষের অপেক্ষায় না থেকে ছোট ছোট সুখের মুহূর্তের সদ্ব্যবহার করা। কারণ, ছোট ছোট সুখের মুহূর্তই আপনার প্রত্যেক মুহূর্তকে রঙিন করে তুলতে পারে। এভাবে যদি আপনি চলতে পারেন, তাহলে দেখবেন, জীবনের বাস্তবতার রূঢ়তা আপনাকে স্পর্শ করতে পারছে না। দিনে দিনে আপনি জীবন উপভোগ করতে শুরু করবেন। আর ফুল এমনই একটা বস্তু, যেটা আপনার যেকোনো দুঃখের মুহূর্তকে সামান্য সময়ের জন্য হলেও ভুলিয়ে স্বর্গসুখ দিতে পারে।

লেখকের ই–মেইল: <[email protected]>