খাদ্য সংরক্ষণের শিক্ষা

সাইলো
সাইলো

পৃথিবীর জনসংখ্যা বর্তমানে ১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে বাড়ছে <worldometers.info/world-population>। এই হারে বাড়তে থাকলে ধারণা করা যায়, ২০৫০ সালে অতিরিক্ত দুই বিলিয়ন মানুষকে খাওয়াতে হবে। কীভাবে সম্ভব? এই বিশাল পরিমাণ জনসংখ্যাকে খাওয়াতে যে পরিমাণ অতিরিক্ত খাদ্য প্রয়োজন হবে, সেটা উৎপাদনে কি আমরা সক্ষম?

পুরো পৃথিবী বাদ দিয়ে শুধু বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তা করি। আমাদের দেশে পাঁচ বছরের নিচে, সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন বাচ্চা অপুষ্টিতে ভুগছে<usaid.gov/what-we-do/global-health/nutrition/countries/bangladesh-nutrition-profile>।

প্রতিদিন আমাদের কৃষিজমি কমছে। সঙ্গে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। বাড়ছে জনসংখ্যা। বর্তমানে যেভাবে খাদ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়, এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কোনোভাবেই বর্ধিত জনসংখ্যাকে পরিমিত খাদ্য ও পুষ্টির জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। দেশ–বিদেশে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে, কীভাবে খাদ্যের উৎপাদনকে বাড়ানো যায়। তবে মানুষ যেহেতু তার খাদ্য নিয়ে সচেতন হচ্ছে, তাই শুধু উৎপাদন বাড়ানো নয়, সঠিকভাবে বললে ‘ফুড সিকিউরিটি ও ফুড সেফটি’ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে <nature.com/scitable/knowledge/library/food-safety-and-food-security-68168348>।

উৎপাদিত খাদ্যের যে অংশ নষ্ট হয়ে যায়, অর্থাৎ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় না, সেটাই ফুড লস। আমরা যদি টোটাল ফ্রুটস ও ভেজিটেবলস লসের দিকে তাকাই, তবে দেখব মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশই লস হয় <fruitandvegetable.ucdavis.edu/? blogtag=produce&blogasset= 2231>।

ফুড চেইনের বিভিন্ন অংশে এই লসটা হয়ে থাকে। যেমন কৃষি কাজের সময়, ফসল তোলার পরে, প্রসেসিংয়ের সময়, পরিবহন ও ব্যবহারের সময় ইত্যাদি <fao.org/home/en/>।

উন্নত বিশ্বে খাবারের একটা বড় অংশ নষ্ট হয় উৎপাদনে ও বাসাবাড়িতে। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয় পরিবহন ও বণ্টনের সময়। এই ঊর্ধ্বমুখী জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে, হয় উৎপাদন বাড়াতে হবে অথবা যে পরিমাণ খাবার নষ্ট হয় তা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।

এই যে ৪০ শতাংশ বা তার বেশি খাবার (ফ্রুটস ও ভেজিটেবলস) নষ্ট হচ্ছে, এটা কিন্তু শুধুই খাবারের লস নয়, এর সঙ্গে জড়িত মানুষের শ্রম, জমি, অর্থ, সেচ, সার, কীটনাশক, এনার্জি, পানি, নিউট্রিশন সবকিছুর লস। গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে যে পরিমাণ নিউট্রিশন লস হয়, তা দিয়ে অতিরিক্ত দুই বিলিয়ন মানুষের পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব <fao.org/home/en/>।

একটু অন্যভাবে চিন্তা করলে ৫ শতাংশ খাবার অতিরিক্ত উৎপাদন করতে যে পরিমাণ কাজ করা (effort) দরকার, তার চেয়ে অনেক কম করেই ৫ শতাংশ খাবারকে নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচানো সম্ভব।

তাই খাদ্য সংরক্ষণ বর্তমান সময়ের একটি হট টপিক। খাদ্যকে মোটাদাগে দুভাবে সংরক্ষণ করা যায়। তাপমাত্রা কমিয়ে ও শুকিয়ে। বর্তমানে খাদ্য সংরক্ষণের সময় বা আগে, বিভিন্ন ধরনের আধুনিক ও অত্যাধুনিক ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়। যেমন আলট্রাসাউন্ড, আলট্রাভায়োলেট, পালসড ইলেকট্রিক ফিল্ড ইলেক্ট্রপোরেশন, প্লাজমা, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি, উচ্চ তাপ-চাপ, নিম্ন তাপ, গরম পানিতে ফ্লাশিং, ওজোন, দ্রবণে ভিজানো, গ্যাস, মাইক্রো অর্গানিজম ইত্যাদির ব্যবহার। এ ছাড়া আচার বানিয়ে, গাজন ঘটিয়ে, বাতাসের কম্পোনেন্ট পরিবর্তন করেও খাদ্য সংরক্ষণ করা যায়। এটা নির্ভর করে খাদ্যের বাহ্যিক ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের ওপর। আবার ফুড রেগুলেশনের কারণে দেশ ভেদে এর ব্যবহার নির্ভর করে। যেমন একসময় স্টোরেজ রুমে গামা রেডিয়েশন দেওয়া হতো, যেটা এখন অনেকটাই কমে গেছে।

লেখক
লেখক

কোন খাবার কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, সেটা অনেক সময় প্রকৃতি থেকেই ধারণা পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে আমি পেঁয়াজের কথা বলব। পেঁয়াজের বাইরে তিন থেকে চারটি শুকনো আবরণ থাকে। এই খোসাগুলো পেঁয়াজকে রক্ষা করে বাইরের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থেকে। এই খোসাগুলো ভেতরের আর্দ্রতাকে বাইরে যেতে বাধা দেয়। এটা না থাকলে পেঁয়াজ শুকিয়ে যেত। এই খোসায় রয়েছে ন্যাচারাল অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল উপাদান, যা পেঁয়াজকে রোগবালাই থেকে রক্ষা করে। এই খোসা না থাকলে ফাঙ্গাস ও ব্যাকটেরিয়া দিয়ে পেঁয়াজ আরও বেশি আক্রান্ত হতো। এই ছোট্ট অবজারভেশন থেকে একটা প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায় কীভাবে পেঁয়াজকে সংরক্ষণ করতে হবে। যেহেতু এর খোসা শুকনো, তাই এটাকে শুকনো স্থানে, অর্থাৎ কম আর্দ্রতায় রাখতে হবে। এরপর যদি সংরক্ষণ তাপমাত্রা কমিয়ে দেওয়া যায়, তবে পেঁয়াজ অনেক দিন ভালো থাকবে।

খাবারটি যদি দানাশস্য বা খাদ্যশস্য হয়, তবে তার সংরক্ষণের উপায় ভিন্ন। সংরক্ষণের আগে, খাদ্যশস্য থেকে যদি আর্দ্রতা দূর করা না হয় তবে সেখানে মাইক্রোঅর্গানিজম জন্মাবে ও পচন ধরবে। তাই শস্য সংরক্ষণের আগে শুকানো হয় এবং সাইলোতে (silo) জমা করে রাখা হয়। উল্লেখ্য, শস্য সংরক্ষণের অনেকগুলো পদ্ধতির মধ্যে সাইলো একটি পদ্ধতি।

সাইলো শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ siros থেকে। যার বাংলা অর্থ দ্বারায় খাদ্যশস্য রাখার জন্য মাটির গর্ত বিশেষ। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, সাইলোর উৎপত্তিস্থল ইসরায়েলের Tel Tsaf অঞ্চলে। জেনেসিসের তথ্য অনুযায়ী Joseph's Tomb অর্থাৎ ইউসুফ (আ.)–এর কবর ইসরায়েলের সেই অঞ্চলেই। <wikipedia.org/wiki/Joseph_(Genesis)>

এ থেকে ধারণা করা যায়, হজরত ইউসুফ (আ.)–এর সময়েই প্রথম খাদ্যশস্য মজুত করে রাখার জন্য সাইলো ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু কী এমন ঘটেছিল যে খাদ্যশস্য সংরক্ষণের প্রয়োজন হলো?

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআন শরিফের ১২ নম্বর সুরায় এ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। পাঠকের সুবিধার জন্য সুরা ইউসুফের কয়েকটি আয়াতের বাংলা অনুবাদ এখানে দিয়ে দিচ্ছি।

৪৩ নম্বর আয়াতের অর্থ ‘বাদশাহ বলল আমি স্বপ্নে দেখলাম, সাতটি মোটাতাজা গাভি-এদের সাতটি শীর্ণ গাভি খেয়ে যাচ্ছে এবং সাতটি সবুজ শিষ ও অন্যগুলো শুষ্ক। হে পরিষদ বর্গ! তোমরা আমাকে আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা বল, যদি তোমরা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় পারদর্শী হয়ে থাক।’ ৪৪ নম্বর আয়াত: তারা বলল, এটা কল্পনাপ্রসূত স্বপ্ন। এরূপ স্বপ্নের ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই।’ ৪৬ নম্বর আয়াত: ‘সে তথায় পৌঁছে বলল, হে ইউসুফ! হে সত্যবাদী! সাতটি মোটাতাজা গাভি-তাদের খাচ্ছে সাতটি শীর্ণ গাভি এবং সাতটি সবুজ শিষ ও অন্যগুলো শুষ্ক; আপনি আমাদের এ স্বপ্ন সম্পর্কে পথনির্দেশ প্রদান করুন, যাতে আমি তাদের কাছে ফিরে গিয়ে তাদের অবগত করাতে পারি।’ ৪৭ নম্বর আয়াত: ‘তোমরা সাত বছর উত্তম রূপে চাষাবাদ করবে। অতঃপর যা কাটবে, তার মধ্যে যে সামান্য পরিমাণ তোমরা খাবে তা ছাড়া অবশিষ্ট শস্য শিষ সমেত রেখে দেবে।’ ৪৮ নম্বর আয়াত: ‘এবং এরপরে আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর; তোমরা এ দিনের জন্য যা রেখেছিলে, তা খেয়ে যাবে, কিন্তু অল্প পরিমাণ ব্যতীত, যা তোমরা তুলে রাখবে।’ ৪৯ নম্বর আয়াত: ‘এর পরেই আসবে এক বছর-এতে মানুষের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং এতে তারা রস নিঙড়াবে।’ <quraanshareef.org/Surah-Yusuf>

এই আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় মুফতি মোহাম্মদ শফী উসমানী রচিত আল কোরআনের তফসির ‘মারেফুল কোরআন’ পুস্তকে। <archive.org/details/MarefulQuranCompleteSummary/page/n673>

অন্য একটি তাফসিরে একই বর্ণনা এসেছে। সৌদি বাদশাহ সালমানের নির্দেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ড. জাকারিয়া লিখিত ‘পবিত্র কোরআনের তরজমা ও তফসির’। প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা নম্বর ১২১৭-১২২১।

আল্লাহ তাআলা হজরত ইউসুফ (আ.) কে বিশেষ জ্ঞান দান করেছিলেন যাতে তিনি স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারতেন। তৎকালীন বাদশাহ একদিন স্বপ্ন দেখলেন, ‘সাতটি মোটাতাজা গাভিকে খেয়ে ফেলছে সাতটি শীর্ণকায় গাভি। তিনি আরও স্বপ্নে দেখলেন সাতটি সবুজ ও সাতটি শুষ্ক শিষ।’ বাদশাহ এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য রাজ্যের জ্ঞানীগুণীদের ডাকলেন, কিন্তু কেউই স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পারলেন না। এমন সময়ে উপস্থিত একজন, যিনি হজরত ইউসুফ (আ.) কে চিনতেন ও তাঁর স্বপ্ন ব্যাখ্যার ক্ষমতা জানতেন, তিনি বাদশাহের কাছে আবেদন করলেন, যেন তাঁকে কারাগারে ইউসুফ (আ.)–এর সঙ্গে দেখা করতে প্রেরণ করা হয়।

স্বপ্নের ঘটনা শোনার পর আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের মাধ্যমে ইউসুফ (আ.) বিজ্ঞের মতো স্বপ্নের ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন, সাতটি মোটাতাজা গরু (চাষাবাদে শক্তিশালী গরুর প্রয়োজন) ও সবুজ শিষ দিয়ে বোঝানো হয়েছে, আগামী সাত বছর সারা দেশে ভালো ফলন হবে। আর শীর্ণকায় গাভি ও শুষ্ক শিষ দিয়ে বোঝানো হয়েছে, পরবর্তী সাত বছর দেশে খরা ও দুর্ভিক্ষ হবে। তিনি আরও বললেন, দুর্ভিক্ষের পরের বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে। এরপর তিনি বাদশাকে উপদেশ দিলেন কীভাবে খাদ্য সংরক্ষক করে রাখতে হবে এবং খরা ও দুর্ভিক্ষের সময় কীভাবে সেই খাদ্য ব্যবহার করা যাবে।

খাদ্যশস্য শুকানো হলে তার আর্দ্রতা কমে যায়। খাদ্যশস্যে মাইক্রোঅর্গানিজম জন্মানোর জন্য ও অঙ্কুরোদগমের জন্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট আর্দ্রতা। উপরন্তু, খোসা সহকারে রাখা হলে সেই খোসা জীবাণুর প্রবেশে অতিরিক্ত বাধা হিসেবে কাজ করে। তাই শুকনো খাদ্যশস্য খোসা সহকারে রাখাটাই তখনকার সময়ে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জ্ঞান ছিল। উপরন্তু, বর্তমান সময়ের মতো এত উঁচু উঁচু সাইলো তৈরি করা তখন সম্ভব ছিল না। তাই তারা হয়তো মাটিতে বড় গর্ত করে সেখানে শস্য জমা করে রাখত। সে ক্ষেত্রে মাটির নিচে থাকার কারণে সংরক্ষণ তাপমাত্রা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কম ছিল। আর এটাই বর্তমান সময়ের হার্ডল টেকনোলজি (একাধিক প্রসেসের সঠিক ব্যবহার করে খাদ্যে প্যাথজেনিক মাইক্রোঅর্গানিজম জন্মাতে না দেওয়া)।

উল্লেখ্য, এই প্রথমবারের মতো মানুষ খাদ্যশস্য সংরক্ষণের সঠিক জ্ঞানকে কাজে লাগাল। বর্তমান সময়েও সাত বছরের ফসল দিয়ে পরবর্তী সাত বছর কাটানো অনেকটাই অসম্ভব। কিন্তু, আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর সহায়তায় হজরত ইউসুফ (আ.) দক্ষতার সঙ্গে সেই দুর্যোগকে সামাল দিয়েছিলেন।
...

ড. মো. নাহিদুল ইসলাম: খাদ্য গবেষক, ওডেন্স, ডেনমার্ক। ফেসবুক: <Dr. Nahidul. Islam>