স্যাক্রিফাইস

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জীবনের কিছু ঘটনা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। আমার আজকের গল্পটি নিশাকে নিয়ে। নিশার সঙ্গে পরিচয় ভার্সিটিতে এসে। আমরা দুজন দুই ডিপার্টমেন্টে। নিশাকে সত্যি বলতে কি আমি ও আমরা ইয়ারমেটরা অনেক হিংসা করতাম। হিংসা করার অনেকগুলো কারণ ছিল। নাহ, নিশা দেখতে ফাটাফাটি রকমের সুন্দরী ছিল সে জন্য নয়, হিংসা হতো ওর বড় বোন নিলা আপুর জন্য।

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর আমরা যারা মফস্বল থেকে এসেছিলাম প্রায় নয় মাস ছাত্রী হলের কমন রুমে গাদাগাদি করে থাকতাম। এদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল নিশা। ওর বোন নিলা আপু আমাদের হলের সিনিয়র আপু। কাজেই নিশা প্রথম দিন থেকেই ঝকঝকে সুন্দর রুমে ওর বোনের সঙ্গে থাকত। নিশাকে হিংসা করার আরও কারণ হলো, ওকে হলের ডাইনিংয়ের খাবার খেতে হতো না। নিলা আপু ওর জন্য মজার মজার রান্না করত। ওর কাপড়চোপড় ধুয়ে ইস্তিরি করেও দিত। নিলা আপু ওর জন্য সব সাবজেক্টের নোটও জোগাড় করে দিত। তার ওপর আমরা যেখানে বাড়ির জন্য মন খারাপ করে থাকতাম, সেখানে ওর বড় বোন থাকায় ওরা দুজন বাড়ির মতোই কী মজা করে দিন কাটাত। বোনের সঙ্গে নিশার ঢং দেখে তাই আমরা অনেক জেলাস হতাম।

আমরা কমনরুমের সবাই ধীরে ধীরে হলে সিট পেয়ে গেলাম। আমার সিট হলো ৩২৭ নম্বর রুমে। নিলা আপুর পাশের রুমেই। ওদের দুই বোনের সঙ্গে আমারও ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওদের মজার মজার খাবারের ভাগ আমার জন্যও থাকত। হলের দিনগুলো কাটছিল আনন্দেই।

ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট রায়হান ভাইয়ার সঙ্গে কীভাবে নিলা আপুর প্রেম হলো সে কথাও জানলাম। রায়হান ভাইয়াকে অবশ্য আমরা বেশি দেখিনি। আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে আসি, তখন রায়হান ভাইয়া মাস্টার্সের থিসিস শেষ করে কোথায় যেন একটা জব করছিলেন আর বিসিএস ভাইভা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। নিলা আপুর কাছেই একদিন জানলাম যে ভাইয়ার বিসিএস হয়েছে প্রশাসন ক্যাডারে, রংপুরে পোস্টিং।

একবার হলে প্রায় রাত সাড়ে ১১টার দিকে নিলা আপু খুব অসুস্থ হয়ে গেলে আমরা অ্যাম্বুলেন্স করে তাকে হাসপাতাল নিয়ে গিয়েছিলাম। খবর পেয়ে সারা রাত জার্নি করে রায়হান ভাইয়া রংপুর থেকে ভোরে এসেই হাজির। সে কী প্রেম রে বাবা। এমন প্রেম দেখে আমরা বান্ধবীরা শুধু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছিলাম।

নিলা আপুর হার্টে প্রবলেম ছিল। হার্ট ফাউন্ডেশনে বেশ কয়েক মাস পর নিলা আপুর ওপেন হার্ট সার্জারি হলো, আমার ব্লাড গ্রুপ এক হওয়ার কারণে আমি তাকে ব্লাডও দিয়েছিলাম।

এই ঘটনার অনেক পরে, রায়হান ভাইয়ার সঙ্গে নিলা আপুর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়েতে দুই পক্ষের কেউই রাজি ছিলেন না। অসুস্থ মেয়েকে বিয়ে দিতে নিশার বাবা-মা রাজি ছিলেন না। আর একই কারণে রায়হান ভাইয়ার বাবা-মাও এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না। তারপরও তাদের বিয়ে হয়। নিলা আপুর সঙ্গে মাঝেমধ্যে নিশার মোবাইলে কথা হতো। ভালো আছে জেনে ভালো লাগত।

ভার্সিটিতে থাকার সময় নিশারও অ্যাফেয়ার হয় শিহাব নামে বুয়েটের এক ছেলের সঙ্গে। দিন কাটছিল দ্রুতই। ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে নিশা বাসায় চলে গেল। আমারও কিছুদিন পর মাস্টার্সের জন্য স্কলারশিপ হলে দেশের বাইরে চলে আসি। সোশ্যাল মিডিয়ায় না থাকার জন্য বন্ধুবান্ধব কারও সঙ্গেই তেমন আর যোগাযোগ হতো না।

মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডি। দিন কাটছে প্রচণ্ড ব্যস্ততায়। এর মধ্যে রিসার্চের কাজে বাংলাদেশে যেতে হলো মাসখানেকের জন্য। ঠাকুরগাঁওয়ে কাজ। আমার ফুফাতো বোনের বাসায় উঠলাম।

দিন সাতেক পর বোনের ম্যারেজ এনিভার্সারিতে বেশ বড় একটা পার্টির আয়োজন করেছিলাম আমরা। ওই পার্টিতেই অনেক বছর পর দেখা হয়ে গেল নিশার সঙ্গে। নীল রঙের শাড়িতে যেন এক নীল পরি। দুজনেই দুজনকে দেখে এত জোরে চিৎকার দিয়েছিলাম, ভুলেই গিয়েছিলাম যে কোথায় আছি। সংবিৎ ফিরে এল ছোট্ট বাবুটাকে দেখে। ওরে বাবা, ব্লেজার পরা ফোকলা একটা নাদুসনুদুস বাবু ওর হাত ধরে আছে।

বাবুটাকে কোলে নেওয়ার আগেই ওর স্বামীকে দেখে আমি প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থায় পড়লাম। বাবা বলে পিচ্চিটা যাকে ডাকছে, সে যে রায়হান ভাই! একটু মোটা হয়েছেন, কিন্তু তাই বলে চিনতে ভুল হওয়ার কথা না। হঠাৎ করেই কেমন যেন অসুস্থ বোধ করছিলাম। এই কাজ কীভাবে করতে পারল নিশা! কীভাবে সে পারল বোনের ঘর ভেঙে তার হাসব্যান্ডকে বিয়ে করতে!

একটু অক্সিজেনের আশায় দৌড় দিয়ে ছাদে উঠলাম। আর কিছু পরেই পেলাম চেনা সেই পায়ের শব্দ। আমি জানি কে আমার পাশে দাঁড়িয়ে। সেই আগের মতো যেন হলের ছাদে দাঁড়িয়ে আমরা দুই বান্ধবী।

নিশাই কথা শুরু করল।

আমাকে দেখে খুব ঘৃণা হচ্ছে, তাই না রে? তুই তো সেই যে হাওয়া হয়ে গেলি। জানবি কী করে যে বাচ্চাটা হতে গিয়ে আপুনি আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। সবাই যখন শোকে কাতর, আমি তখন ব্যস্ত অসুস্থ বাবুটাকে নিয়ে। আপুনির জন্য কান্না করার মতো বিলাসিতা করার সময় ছিল না আমার। আরও অনেক পরে যখন সবার হুঁশ হলো, আপুনির শ্বশুরবাড়ি থেকে এক অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে এল। বাচ্চাটা তাদের দিয়ে দিতে হবে। সব থেকে নাকি ভালো হয়, তাদের ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হলে। কী অদ্ভুত তা–ই না!

আমি, তোদের রায়হান ভাই কেউই রাজি ছিলাম না। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন এমন চাপে ফেলল আমাদের দুজনকেই, আর কোনো উপায় ছিল না। শিহাবকে ফিরিয়ে দিতে হলো। রাতারাতি বাচ্চার মা হয়ে গেলাম। মধ্যবিত্তের পরিবারে চাই আর না চাই, সেই ছোট থেকে আপুনির জিনিস পরেই বড় হয়েছি। বাকি জীবনটাও আপুনির জিনিস দিয়েই পার করতে হবে। আপুনির সংসার, বাচ্চা এমনকি তার স্বামীরও দেখার দায়িত্ব এখন আমার। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, জানি তিনি আপুনির, এক বাচ্চার বাবা এবং আমি দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী।

বাঁধভাঙা কান্নাটা অনেক কষ্টে চেপে প্রায় ফিসফিস করে বললাম, নিজের জীবনটা এভাবেই স্যাক্রিফাইস করে দিলি?

হল লাইফের ফেলে আসা সেই দিনগুলোর মতো আজ অনেক অনেক বছর পর দুই বন্ধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি ছাদে। আকাশের দিকে তাকিয়ে। জানি আজ শুধু আমরাই আকাশের তারা দেখছি না। শত শত তারার মধ্যে একটি তারা আমাদেরও দেখছে। আদরের ছোট্ট বোনটির স্যাক্রিফাইসের জন্য জানি সে-ও কাঁদছে অঝোরে।