আমার উঠোনে রক্ত

ক্রাইস্টচার্চের এই মসজিদে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। ছবি: আল নূর মসজিদের ফেসবুক পেজ থেকে
ক্রাইস্টচার্চের এই মসজিদে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। ছবি: আল নূর মসজিদের ফেসবুক পেজ থেকে

জীবনে কখনো এতটা মন খারাপ হয়নি এর আগে। এতটা আবেগতাড়িতভাবে দিন পার করিনি এর আগে কখনো। ছোটবেলায় একবারই শুধু এমন মন খারাপের কাছ দিয়ে গেছি। কিন্তু সেটাও একসময় ভুলে গিয়েছিলাম। শুক্রবার থেকে আবার সেটা বারবার মনে পড়ছে।

আমাদের পাশের গ্রামের মাঝ বরাবর রেললাইন চলে গিয়েছে। দিন ও রাতের বিভিন্ন সময়ে রেলগাড়ি যায়। আমি আর মেজ ভাই রেলগাড়ির শব্দ শুনি আর মনে মনে ঠিক করি একদিন আমরাও যাব রেলগাড়ি দেখতে। পথের পাঁচালির অপু-দুর্গার মতো আমরাও একদিন রেলগাড়ি দেখতে চলে যাই। আমরা কোনোভাবেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, রেলগাড়ি এত বড় হয়। আর মাত্র দুটি লোহার পাতের ওপর দিয়ে কীভাবে যায়, কেন কাত হয়ে পড়ে যায় না? এমনি আরও কত প্রশ্ন আমাদের মনে ভিড় করেছিল। রেললাইন ও রেলগাড়ি তখন পর্যন্ত আমাদের কাছে ছিল অপারবিস্ময়ের বস্তু। কিন্তু আমাদের বিস্ময়ের সীমানা মনে হয় তখন পর্যন্ত পূর্ণতা পাচ্ছিল না?

একদিন সকালে মা বললেন, পাশের গ্রামের এক নারী রেলে কাটা পড়ে মারা গেছেন। কোনোভাবেই এটা আমাদের ছোট মস্তিষ্কের মজ্জায় ঢুকল না। আমি আর মেজ ভাই মায়ের পিছু নিয়ে সেই ঘটনা দেখতে গেলাম। এটা ছিল আমার জীবনের প্রথম ও এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা। ওই নারীর শরীরটা রেললাইনের কোথায় পড়েছিল সেটা মনে নেই। কিন্তু তার মাথার ঘিলুটা একেবারে রেলের একটা পাতের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল। এরপর যতবারই আমি খেতে বসতাম, ততবারই মনে হতো আমি যেন হাত দিয়ে সেই ঘিলু মাখাচ্ছি। এরপর অনেক দিন আমি খেতে পারতাম না, যতটুকু খাওয়া হতো সেটুকুই শেষ। এভাবে কত দিন চলেছিল সেটা মনে নেই, তবে কয়েক বছর চলেছিল এই সমস্যা।

বুয়েট লাইফে আমাদের সময় একটা ভিডিও গেম ছিল যেটাতে একটা ভবনে বেশ কিছু মানুষ সন্ত্রাসীদের হাতে আটকে পড়েছে। আর খেলোয়াড় খেলতেন তাদের উদ্ধার করার মিশন নিয়ে। সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে গেমটা খেলত এবং সব বন্দীকে মুক্ত করে আনত। সেটা করতে গিয়ে দু–একজন মানুষ যে মারা যেত না তা কিন্তু নয়। কিন্তু আমি এই মারা যাওয়ার ব্যাপারটা নিতে পারতাম না। আমার মনে আছে, ভবনে ঢোকার মুখেই একজনকে জিম্মি বানিয়ে সামনে নিয়ে এসে একজন সন্ত্রাসী ভবন থেকে বের হয়ে আসত। সেই সন্ত্রাসী থাকত ঠিক জিম্মির পেছনে তাই তাকে গুলি করতে গেলেই প্রায় সব সময়ই জিম্মি মানুষটা মারা পড়ত আর আমি খেলা থেকে উঠে পড়তাম। কারণ জিম্মি মানুষটা খুবই করুণ গলায় বলত, হেল্প মি! এই আওয়াজটা যান্ত্রিক হলেও কেন জানি তার মধ্যে অদ্ভুত একটা মায়া ছিল। যেটা আমার মনকে নাড়িয়ে দিত। আমি ভাবতাম, আমি যেহেতু তাকে বাঁচাতে পারব না তাই তাকে মেরে ফেলার অধিকার আমার নেই। আমরা যখন পাস করে বের হয়ে আসব তখন আরেকটা গেম খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সেটা হচ্ছে ম্যাক্স পেইন। সেই গেমে একজন অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিপরীত পক্ষকে একের পর এক মেরে ফেলত।

গত সপ্তাহেই ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম—আমার এক টুকরো উঠোন। অফিস থেকে ফেরার সময় বাস থেকে নেমে একটা পার্কের মধ্যে দিয়ে কোনাকুনি হেঁটে আসতে হয়। এই কোনাকুনি হেঁটে পার হতে দুই–তিন মিনিট সময় লাগে। কিন্তু আমার প্রায়ই মিনিট দশেক লেগে যায়। এই দেরি হওয়ার কারণ এই পার্কটার পরিবেশ। কোনাকুনি না হেঁটে একটু বাঁয়ে ঘুরলেই একটা জায়গা, যেটার আমি নাম দিয়েছি উঠোন। ঠিক গ্রামবাংলার উঠোনের পাশে যেমন বিভিন্ন জাতের গাছ থাকে এই জায়গাটুকুও তেমন। গোলাকৃতি জায়গাটা ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা আর তার নিচে রয়েছে গুল্ম জাতীয় কিছু উদ্ভিদ। আর এক কোনায় রয়েছে একটা বাঁশঝাড় যেটা উঠোনটাকে দিয়েছে পূর্ণতা।

হামলায় আহত ব্যক্তিদের ক্রাইস্টচার্চ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ছবি: এএফপি
হামলায় আহত ব্যক্তিদের ক্রাইস্টচার্চ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ছবি: এএফপি

মাঝখান দিয়ে লাল ইটের বাঁধানো রাস্তা। এখান দিয়ে হাঁটার সময় ইচ্ছে করে রাস্তাটার ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ে নীল আকাশে পাতাদের নাচ দেখতে কিন্তু শহুরে ব্যস্ততায় সেটা আর করা হয়ে ওঠে না। রোদ ঝলমলে দিনে এখানে রাজ্যের ঝিঁঝি পোকা ডাকে। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় যেন গভীর রাত হয়ে গেছে। আশপাশের গাছগুলোর বয়স অনেক। তাদেরও ঘন পত্রপল্লব দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মনের সব বিস্বাদ দূর হয়ে যায়। উঠোন পেরিয়ে এই গাছগুলোকে না দেখলে মনে হয় তারা যেন আমার ওপর অভিমান করছে। তাই প্রত্যেকটা গাছের পাশ দিয়ে যাই আর আলতোভাবে ছুঁয়ে দিই তাদের কাণ্ড পাতা।

আমি জেনেছি নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার চেয়েও সুন্দর ও শান্ত দেশ। আমার ছাত্রী টুম্পা সেখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছে। পাশাপাশি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। গত বছর ওর বিয়ে হলো। একা একটা দেশে মেয়েটা বিয়ে করল। আমাকে যেতে বলেছিল কন্যাপক্ষ হয়ে। কিন্তু সাধ আর সাধ্য সব সময় মেলে না। তাই মনের মধ্যে এই আক্ষেপটা থেকেই যাবে বাকি জীবন। ওর কাছ থেকেও শুনেছি নিউজিল্যান্ডের সৌন্দর্যের অনেক গল্প। আমার অত্যন্ত প্রিয় চলচ্চিত্র ‘দ্য লর্ড অব দ্য রিংস’। ছবির হবিটদের বাড়িগুলো নাকি ওখানে। একবার তামিম ভাই ও সিঁথি ভাবিরা ওখানে বেড়াতে গিয়ে হবিটদের ছোট ছোট ঘরগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে দিলে সেটা দেখে আরও আপ্লুত হয়ে গেলাম। তাই পরিকল্পনা ছিল যদি কখনো অস্ট্রেলিয়ার বাইরে যাই, তাহলে শুরুতেই নিউজিল্যান্ডে যাব। এর মধ্যেই এত কিছু ঘটে গেল।

দিনটা শুক্রবার হওয়াতে কাজের চাপ একটু কম থাকার কথা। কিন্তু সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে ফাঁকি মারায় অনেক কাজ জমেছিল। অফিসে যতই কাজ করি না কেন, ফেসবুকের পাতাটা সব সময় খোলাই থাকে। কিন্তু মিনিমাইজ করে রাখি। মাঝেমধ্যে খুলে দেখি কেউ কোনো মেসেজ দিল কিনা। এমনই একবার হঠাৎ করে একটা খবরে চোখ পড়ে গেল। একজন শেয়ার দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি সহকর্মী মিককে কথাটা বলতেই তিনি গুগল করে হাজারো তথ্য বের করে ফেললেন। এই ছেলেটার আদিপুরুষ আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী। তাঁর সঙ্গে আমার প্রায়ই ধর্ম ইতিহাস নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়।

ইতিমধ্যে মিক গুগল করে বাংলাদেশের অনেক তথ্য বের করে ফেলেছেন। কোনোটা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন। আমাকে আয়ারল্যান্ডের অনেক ডকুমেন্টসের লিংক দিয়েছেন। আমি নিজেও খুঁজে খুঁজে অনেক কিছুই পড়েছি। আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসও বাংলাদেশের ইতিহাসের মতো অনেক মানুষের রক্তে ভেজা, তবু ওরা হাল ছাড়েনি। একটা সুন্দর দেশ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

এরপর দেখতে শুরু করলাম আরও ভয়াবহ খবরগুলো। কানাডা থেকে বন্ধু জিতু একটু পরপরই আপডেট দিচ্ছিল। ওর নিউজফিডটা দেখেই প্রথম জানলাম, ঘাতক অনেক আগে থেকেই একেবারে নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনা করে সেটা আবার মেনিফেস্টোর আকারে তার টুইটার অ্যাকাউন্টে নাকি প্রকাশও করেছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল ঘাতক ভিডিও গেমের মতো করে মানুষ মেরেছে। যেটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে খেলা সেই গেমগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। তবে এখানে সে উদ্ধারকারীর ভূমিকায় নেই। বরং ম্যাক্সপেইন গেমের হিরোর মতো খুঁজে খুঁজে একটা একটা করে মানুষ মেরেছে। সেই সময়টায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেরও মসজিদে থাকার কথা ছিল। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে দেরি হয়ে যাওয়াতে তাদের মসজিদে পৌঁছাতে মিনিট পাঁচেকের দেরি হয় এবং মসজিদের কাছে গিয়েও আহত একজনের কাছে খবর পেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে সক্ষম হয়।

নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা
নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা

এরপর মৃত ব্যক্তির সংখ্যা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যেতে থাকে। শেষ খবর পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির সংখ্যা ৫০ ছিল। একটা মানুষ তার হৃদয়ে ঠিক কতটা ঘৃণা পুষে রাখলে এমন একটা হত্যাকাণ্ড চালাতে পারে, সেটা আমার জানা নেই। আমি নিশ্চিত তার কোনো অভিবাসী বন্ধু নেই। তাই সে জানে না যে অভিবাসীরা শুধু তাদের জীবিকার অংশে ভাগই বসাচ্ছে না তারা তৈরিও করছে অনেক নতুন নতুন জীবিকার সুযোগ। আর ধর্মের ব্যাপারটাও সে একইভাবে একপেশে হিসেবে বিচার করেছে। পৃথিবীর কোনো ধর্মই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেয় না বরং শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যেতে বলেছে আজীবন। শুধু দু–একটা ধর্মযুদ্ধের স্মৃতি দিয়ে সেটাকে বিচার করা মোটেই সমীচীন নয়। এরপর হয়তো পৃথিবীর আবারও কোনো এক প্রান্তে হামলা হবে আবার সেটার প্রতিকারে আরও হামলা হবে। হয়তো এভাবেই চলতে থাকবে নিজের বিরুদ্ধে নিজের যুদ্ধ। নিজের বিরুদ্ধে নিজের যুদ্ধ বলছি, কারণ তারা অন্য একজন মানুষকেই মারছে, অজুহাত যাই হোক না কেন।

প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ভেবেছিলাম মানুষ আরও উদার হতে শিখবে। কারণ, হাতের মুঠোয় সব তথ্য পাওয়া যায়। তাই সত্য–মিথ্যার দ্রুত যাচাই করা সম্ভব হবে। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে ঠিক এর উল্টো। ধর্ম জাতপাতের বিভাজনে পৃথিবীতে মেরুকরণ হচ্ছে দ্রুতই। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে মানুষের মনের অন্ধকার দিকের ভাবনাও প্রকাশ পাচ্ছে দ্রুতই। যদিও তারা মুষ্টিমেয়। যেমন এই ঘটনার পর অস্ট্রেলিয়ার একজন সিনেটর এটাকে অন্য একটা রং দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শান্ত মানুষগুলো বরাবরের মতোই শান্ত আছে। আসলে পৃথিবীর সব মানুষই শান্তি চায়। কিন্তু হাতে গোনা কিছু মানুষ অশান্তিপ্রিয়। আমার কেন জানি মনে হয়, তারা বড্ড একা মানুষ। তাদের কোনো বন্ধু নেই। তারা মানুষের সঙ্গে তেমন একটা মেশে না। কারণ মানুষের সঙ্গে মিশলে, বন্ধুত্ব করতে জানলে, কখনোই অন্য একজন মানুষকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করা সম্ভব না। যতই হোক না সে অন্য ধর্মের বা অন্য দেশের।

অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের অনেক কিছুই এক। বহু আন্তর্জাতিক জোটেও তাদের একই মতামত প্রতিফলিত হয়। তাই অস্ট্রেলিয়ার মতো নিউজিল্যান্ডও আমার কাছে নিজ বাড়ির আঙিনার মতোই। সেখানে এত রক্ত দেখে তাই নিজের মনকে আর প্রবোধ দিতে পারছি না। জানি না এই ঘোর আদৌ কাটবে কিনা? হয়তো বা প্রবাস জীবনের একটা কালো দিন হিসেবে মন এটাকে সযত্নে তার স্মৃতির ভান্ডারে জমা করে রাখবে। আমার মেয়ে তাহিয়াও তার বান্ধবীর বাসা থেকে টেলিভিশনের পর্দায় এই খবর দেখেছিল। তারপর থেকেই বিভিন্ন প্রশ্ন করে যাচ্ছে। যার কোনো সদুত্তর আমার জানা নেই। এই ধরনের ঘটনাগুলো শিশুমনকে অনেক বেশি কাতর করে তোলে। তাই আমার মনে হয় শিশুরাই বেশি ভেঙে পড়ে। ঘাতক মসজিদের মধ্যে একজন শিশুকেও ছাড় দেয়নি। এটা পরে খবরে জেনেছি। তখন মনে হচ্ছিল, একজন মানুষ ঠিক কতটা একাকিত্বে ভুগলে শিশুদেরও তার শত্রু মনে করে।
...

লেখকের ই–মেইল: <[email protected]>