যে সাগরের ঢেউগুলো মনুষ্যত্বের

এতিম শিশুদের সঙ্গে সাগর শাহনেওয়াজ
এতিম শিশুদের সঙ্গে সাগর শাহনেওয়াজ

না, না কম আবেগের স্তিমিত কোনো নদী নয়। অন্য কোনো জলের উৎসের কাছে পৌঁছানোর আগেই যে নদী জলহারা হয়ে যেতে পারে, সে নদী আমি চাইলাম না। শাখা নদী, উপনদী, হ্রদ হয়ে যে নদীর ভাবনা সংকীর্ণ হয়ে যেতে পারে, সে নদী আমি চাইলাম না। সে নদীর কথা লিখতে আসিনি আমি। বলতে এসেছি তার কথা যে স্বয়ং নদীরও নিক্ষেপ করা নুড়ি, বালি, পলি ধারণ করে নিজের বুকে, আপন স্বভাবে। সাগর স্বভাবে। বলতে এসেছি, প্রত্যেক জেলায় একজন সাগর থাকা উচিত। ভাবছেন সাগর আবার জন হলো কেমন করে! বলছি তবে। এই সাগরের পূর্ণ নাম হলো সাগর শাহনেওয়াজ। একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁর কাছে আসে মাইক্রো, কার ও গাড়ি। আপন পরিসরে তিনি একজন শৌখিন গায়কও।

নিন্দুক হলে তাঁর পরিচয় দেবেন এভাবে—ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান তিনি! আর প্রকৃত মানুষ যাঁরা; তারা তাঁর পরিচয় দেবেন এভাবে—এমন সাগর যদি অন্তত একটা করে কোনো জেলাতে, উপজেলাতে থাকে, তাহলে সেই জেলা-উপজেলা কোনোভাবেই আর মনের গরিব থাকে না। সেই জেলাতে কারও মন এই ভেবে খারাপ হয় না; অর্জনের স্বীকৃতি সবাই দেয় না। মানুষ মানুষের জন্য না।

জীবন দৌড়ে আমরা কে নেই? সবাই আছি। কিন্তু কজন মানুষ আছেন এই দৌড়ের ভেতরে খবর নেন, জীবনের দৌড়ে কে অর্জন করল আপন বলয়ে কাজের স্বীকৃতি? কজন মানুষ আছেন এই দৌড়ের ভেতরে খবর নেন, এতিমখানার ৩৭টি শিশু আজ রাতে খেয়েছে কি? আমি জানি না। এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম বলে জানার আকাঙ্ক্ষা আপনাদেরও হতে পারে আশঙ্কাজনকভাবে কম।

কম। কারণ...বৃষ্টি হচ্ছে। রোমান্স আসছে। ভলিউম বাড়িয়ে গান শুনি আমরা অনেকেই। কজন মানুষ আছেন, মনের ভলিউম বাড়িয়ে বৃষ্টির কারণে কোনো ঘরে পানি ঢুকে কোনো মানুষ খুব কষ্ট পাচ্ছে বলে, কষ্ট পাচ্ছেন? খবর আছে! খবর। নিজস্ব সুখের। কজন মানুষ সেই সুখের খবর পৌঁছে দেন সবার কাছে? সুখটাকে নিজ উদ্যোগে করে দেন সবার। লেখক তিনি নন, কিন্তু লেখেন। কী লেখেন? মন উজাড় করে মানুষের অর্জন লেখেন। দুঃখ দেখেন। মন বেশি ভালো থাকলে বলেন, অবহেলিত বন্য ফলের আলাদা স্বাদের ব্যাকরণ।

যে সাগরের কথা বলছি, সেই সাগর এমনই। সাগর শাহনেওয়াজ তাঁর পূর্ণ নাম। সন্দ্বীপ উপজেলার সন্তান। তাঁর স্বভাব লিখছি শব্দে। লিখতে যাচ্ছি। থমকে যাচ্ছি। ভাবছি। বুকের ভেতর কতটা উদারতার জল জমা থাকলে একটা মানুষ তাঁর দৃষ্টিগোচর হওয়া উপজেলার সব মানুষের অর্জনে উদ্বেলিত হন? খুশি হন। কতটা নির্মোহ হলে যিনি চেনেন না তাঁকে, তাঁকে নিয়েও তাঁর মনে সুন্দর কথা থাকে?

সাগর শাহনেওয়াজের জন্মদিন ছিল ১০ মার্চ। ১২ বছর আগে জন্মদিনে তাঁর মা চলে যান পৃথিবী ছেড়ে। আমার কাছে মনে হয় আনন্দ আর দুঃখের এই যে মিলন, এই মিলনই তৈরি করেছে তাঁর আলাদা এই ব্যক্তিত্ব। সেই জন্যই তিনি একই সঙ্গে মানুষের দুঃখ ও সুখ দুটি বিষয়ই গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। করেন বলেই সবার দুঃখে, সবার সুখে তিনি জেগে থাকেন আনন্দে। জেগে থাকেন ব্যথায়।

জেগে থাকা এই মানুষটার কথাই বলতে এসেছি আমি। আমি বহুদিন চেয়েছি পাগলের মতো মানুষকে ভালোবাসা এই মানুষটার কথা শব্দে তুলতে। পারিনি। কেমন করে পারব? আজ তাঁর শৈশব মনে করিয়ে দেওয়া বনের বেতইন-চালতা কথা লিখতে বসিতো, কাল দেখি তিনি শৈশবে আর নাই। আছেন বর্তমানে। বর্তমানে তিনি স্টিলের দোতলা ভবনের স্বপ্নে ইট গাঁথছেন তাঁদের জন্য, যাঁদের ঘরের ছনটাও আজ নেই। তিনি এমন। এমনই। রাজনৈতিক কোনো কর্মী না হয়েও মানুষের মনে বইয়ে দেন সুস্থ সমাজব্যবস্থার রীতিনীতি। তাঁর তত্ত্বাবধানে, তাঁর মতো তাঁর কিছু বন্ধুদের সহায়তায় অসংখ্য অসহায় প্রতিবছর সহায়সম্বল পান। স্টিলের দোতলা বাড়ি এতিমদের জন্য তৈরি করেছেন তিনি। দ্বিতীয়টার কাজ চলছে এখনো। ঈদের জামা, নতুন জুতা, বারোমাসের ফল তাঁর হাত ধরেই মুখে উঠে কিছু মানুষের। এই হলো মানুষ। এই তো তিনি।

মানুষের আনন্দ তাঁকে আনন্দিত করে। মানুষের কষ্ট তাঁকে ব্যথিত করে। নিজের দিনকে যিনি বণ্টন করে দেন মানুষের অন্তরে। আমি তাই অন্তর থেকে চাই প্রত্যেক জেলাতে থাকুক আবেগে উত্তাল, কাজে সক্রিয় এমন একজন সাগর শাহনেওয়াজ। যে সাগরে প্রকৃত মানুষের সংজ্ঞা থাকে। নিবেদিত প্রাণের ঢেউ থাকে। আচ্ছা, আচ্ছা! ঢেউয়ের কথা এলই যখন বলার আছে আরও কথা। এই সাগরের অসংখ্য ঢেউ থাকলেও তিনটা ঢেউয়ের কিন্তু নাম আছে! নাজিয়া শাহনেওয়াজ। অর্ধাঙ্গিনী হন তাঁর। সালসাবিলা শাহনেওয়াজ। তনুজা হন তাঁর। তিহামি শাহনেওয়াজ। পুত্রসন্তান হন তাঁর।

সেন্সেবল মানুষ যাঁরা তাঁরা বুঝতে পারবেন, এই তিন ঢেউয়ের মানসিক ও বাহ্যিক সহায়তা না থাকলে, সাগর কখনো উত্তাল হতে পারত না! নাজিয়া শাহনেওয়াজ নামের আগুন সুন্দরী ঢেউরা মনপাগলা শাগরদের মতো মনের মতো না হলে কী আর এত উত্তাল হতে পারে সাগর! করতে পারে মানুষের জন্য অহর্নিশ, মানুষের হয়ে কাজ? তাই সৈকতে দাঁড়িয়ে থেকে আমরা যারা দেখি বলতেই পারি, তাঁরাও পান ধন্যবাদ।

বলতে পারি, এমন অসংখ্য সাগরে ভরে থাক পৃথিবী। এই চাওয়াটা বেশি হয়ে গেলে অন্তত প্রতিটা জেলা–উপজেলাতে এমন একজন সাগর থাক! যে সাগরের ঢেউগুলো সব মনুষ্যত্বের। যে সাগরের মনের কাছে হেরে যাবে অমানুষ, জিতে যাবে শুধুই মানুষ।