২৫ মার্চের কালরাতকে স্মরণ আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে গত বছরের মতো এবারও ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে গণহত্যাবিষয়ক সেমিনার। দেশটির বাংলাদেশ দূতাবাস এই সেমিনারের আয়োজন করে। দূতাবাসে আয়োজিত এ সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন দেশটির পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছাত্রছাত্রী, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ১৯৭১ সালের গণহত্যার শিকার ৩০ লাখ শহীদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। বাংলাদেশ ও ব্রাজিলের জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে সূচিত এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী পড়ে শোনানো হয়।
অনুষ্ঠানের মূল অংশে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জুলফিকার রহমান টেল অব আ ফরগটেন জেনোসাইড (Tale of a Forgotten Genocide) শিরোনামে একটি সেমিনার উপস্থাপনা করেন। সেমিনারে যেসব বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের মতো বিভ্রান্ত এক রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তানের কল্পকাহিনি। তৎকালীন পাকিস্তানের পুরো জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও সংখ্যালঘু উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিবর্ষণে ভাষাশহীদদের জীবনদান। এই যুগান্তকারী ঘটনা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। বাঙালি জনগণকে দাবিয়ে রাখার রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ হিসেবে বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের সাংস্কৃতিক বিদ্বেষমূলক আচরণ। রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকরণ। উর্দু হরফে বাংলা লিখতে বলার মতো ধৃষ্টতা প্রদর্শন। বাঙালির জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলার অশুভ চেষ্টা। বাঙালি জনগণের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক শোষণ। বাঙালি জনগণের যাবতীয় রাজনৈতিক অধিকার হরণ ইত্যাদি।
সেমিনারের দ্বিতীয় অংশে জুলফিকার রহমান এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের বর্ণনা উপস্থাপন করেন। ১৯৪৮ সালে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’, জিন্নাহর এ ধৃষ্টতার জবাবে বাঙালির প্রথম প্রতিবাদী উচ্চারণ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বিজয় ও সরকার গঠন। দুই মাসের মধ্যে সেই সরকার বরখাস্ত করে কুচক্রী পাকিস্তানিদের গভর্নরের শাসন জারি। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার ভিত্তিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আগরতলা মামলা। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে বঙ্গবন্ধুর জেলমুক্তি। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষাপটে ত্রাণকাজে পাকিস্তান সরকারের ব্যাপক অবহেলা। সেই বছরেরই ৭ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি। রাজনৈতিক আলোচনা চালানোর পাশাপাশি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বাঙালি জাতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বান। ২৪ মার্চ পর্যন্ত আলোচনায় অচলাবস্থা এবং সেই অবস্থাতেই পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের গোপনে ঢাকা ত্যাগ। ২৫ মার্চের কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা শুরু। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে বাঙালির বিজয় আর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
সেমিনারের শেষ অংশে রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের সংগ্রাম এবং বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কার্যক্রমের বিষয়েও আলোচনা করেন।
অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে বাংলাদেশ গণহত্যাবিষয়ক একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। ব্যথাতুর হৃদয়ে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা প্রামাণ্যচিত্রে বর্ণিত নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলোর বর্ণনা শোনেন ও দেখেন পিনপতন নিস্তব্ধতায়।
সেমিনার ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্রাজিলিয়ানদের আগ্রহ দেখে তিনি শিগগিরই বাংলাদেশ বিষয়ে আরেকটি সেমিনারের আয়োজন করবেন মধ্যে ঘোষণা দেন। সবশেষে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতিতে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সবাই মোমবাতি প্রজ্বালন করে সম্মান প্রদর্শন করেন। বিজ্ঞপ্তি