দায়ভার আসলে কার?

এফ আর টাওয়ার
এফ আর টাওয়ার

একজন মানুষ, যে অন্য সবার মতো সকালে সুস্থ দেহ ও মন নিয়ে কাজে এসেছে। পথে হয়তো বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছে। বাচ্চাকে আদর করে বিদায় নিতে নিতে বলেছে, ঠিকভাবে থেকো, ক্লাসে দুষ্টুমি করবে না, সবটুকু টিফিন খেয়ো কিন্তু। বাচ্চার উত্তর শুনতে শুনতে আবার গাড়িতে বা রিকশায় উঠেছে। বাচ্চা বলেছে, বাবা, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরো। বাবা, লাভ ইউ। দুজন দুজনকে হাত নেড়েছে।

যে বাবা, যে মা সেদিন (২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার) ওই আগুনে পুড়ে মরেছেন, আমি ভাবছি, কত কষ্ট পেয়েছেন মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত! মা অন্য দিনের মতো ব্যস্ত পায়ে টিফিন বানিয়েছেন সবার জন্য। বাচ্চার ব্যাগ গুছিয়েছেন। স্বামীর নাশতা, লাঞ্চ দিয়েছেন। হয়তো একসঙ্গে বেরিয়েছেন দুজনে। পথে আলাদা হওয়ার সময় বলেছেন, ঠিকমতো যেয়ো, সময় মতো খেয়ো। আমাকে গাড়ি পাঠাতে হবে না, তুমি সময়মতো ফিরো। হয়তো কারও স্ত্রী ফোন করেছিলেন, আজ বাইরে একসঙ্গে খাব।

আগুনের মৃত্যু অনেক সময় নিয়ে মৃত্যু। একটা জ্যান্ত মানুষের যন্ত্রণার মৃত্যু। জীবিত একজন সুস্থ মানুষের পুড়ে মৃত্যু। নরকের আগুন কী আমি জানি না। তবে এমন করে পুড়ে মরার আগে কিছু সময়ের যন্ত্রণা ও কষ্ট নেওয়া অনেক নারকীয়। তখন কি তাঁর চোখে বাচ্চার চেহারা ভাসছিল? বাই বাই, লাভ ইউ বাবা, লাভ ইউ মা, সেই কচি নাড়ানো হাত দুখানা বারবার তাঁর চোখে ভাসছিল! একসঙ্গে সব কটি প্রিয়জনের মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন! হয়তো ফোন করে শেষবারের মতো কথা বলতে চেয়েছিলেন! হয়তো কিছু আগেও ফোনে বলেছেন, বাঁচব কি না জানি না, তুমি বাচ্চাদের দিকে খেয়াল নিয়ো। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আর অন্য প্রান্তে ওই মানুষগুলোর প্রিয় সব মুখ উন্মুখ হয়ে কেউ টেলিভিশনের পর্দায়, কেউ রাস্তা থেকে সারাক্ষণ ঊর্ধ্বমুখী থেকেছেন আর আল্লাহর কাছে তাঁদের প্রাণভিক্ষা চেয়ে চেয়ে আর্তনাদ করেছেন।

এমন চিত্র আর কত দেখবে এ দেশের মানুষ? অনিয়মের চর্চা, নিয়ম নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার ফল ভোগ আর কত করবে সাধারণ মানুষ? এমন দুর্ঘটনায় পড়লে বলি, ভাগ্য খারাপ আর বেঁচে গেলে আলহামদুলিল্লাহ। আর অনিয়মকারীদের ওপর আল্লাহর অসীম রহমত, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে, কেউ খোঁজে না তাদের!

এই একই বিল্ডিংয়ে (এফ আর টাওয়ার) আগুন লেগেছিল ২০০৮ সালের ৩১ আগস্ট। আমার আপন ছোট ভাই ১৪ তলায় আটকা পড়েছিল। আমাকে ফোনে জানালে আমি তাকে সেদিন জানালার ওই গ্লাস ভাঙতে বলেছিলাম। বলেছিল, সরু সিঁড়ি ধোঁয়ায় ভরা, সেদিকে যাওয়া যায় না। ওপরে–নিচে যাওয়ার কোনো অবস্থা নেই। আমি ফোনে কথা বলে যাচ্ছিলাম। সে-ই প্রথম ব্যক্তি, যে ফায়ার ব্রিগেডের সেই ১৪ তলা পর্যন্ত ল্যাডারে প্রথম উদ্ধার হয়েছিল। আমি টেলিভিশনের পর্দায় সেই দৃশ্য সরাসরি দেখেছি। ওই ইলেকট্রিক মইটি সেদিন প্রথম ব্যবহার হয়েছিল। তাও সেটি ক্রয় করা হয়েছিল কারওয়ান বাজারের আগুনের ঘটনার পরে।

উল্লেখ্য, ওই ল্যাডারের উচ্চতম ক্ষমতা ছিল ১৪ তলা পর্যন্ত। আর আমার ভাইও ছিল সেই ১৪ তলায়। তাহলে বলুন, তার ওপরের তলার লোকেরা কেমনে মুক্ত হবেন? সেই একই ভবন আবারও আগুনকবলিত। পর্যাপ্ত ফায়ার স্কেপের ব্যবস্থা না করেই আবারও সেখানে তেমনই হাট বসানো হলো। এ দায়ভার কার? এমন আরও আরও আধুনিক সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের হাটবাজার এই আধুনিক ঢাকা। কার বা কাদের দায় দেব?