স্বাভাবিক মৃত্যু কি খুবই অস্বাভাবিক?

রাজধানীর বনানীর বহুতল এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ আগুন। ছবি: খালেদ সরকার
রাজধানীর বনানীর বহুতল এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ আগুন। ছবি: খালেদ সরকার

উন্নয়ন নামক পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়া বর্ণনা করে হাসল আগুন। আমি বললাম, হাসছ কেন? সে বলল, স্বপ্ন ভাঙো। দুঃস্বপ্ন দেখছিলে? দেখো তবে চোখ খুলে। সত্যিই আমি দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম সেদিন সকালে। যাক বাবা, স্বপ্ন বলে ফেসবুকে বসলাম একটু। একটু পরেই কী যেন হয়ে গেল, আগুন, আগুন, আগুন। দুঃস্বপ্নেরও সাধ্য নেই এত বড় দুঃস্বপ্ন দেখায় সে। বিবিসির সংবাদদাতা বললেন, ‘হঠাৎ দেখি লোকজন দৌড়াচ্ছে। ভবন থেকে হাত নাড়ছেন অনেকে। তারপরে আমরা সবাই একের পরে এক পড়তে লাগলাম, দেখতে লাগলাম বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। রশি ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছেন একজন—“মা বাঁচাও বাঁচাও” বলে। কিছুক্ষণ পরে আকাশচুম্বী ভবন থেকে পড়ে গেল আরেকজন। কে দেয় এই সবের অনুমোদন? হায়, এত বড় ভবনে ফায়ার এক্সিট নেই। তাই এক মৃত্যু থেকে বাঁচতে বেছে নিচ্ছে আরেক মৃত্যু। কী নিদারুণ চয়েস...।’

ততক্ষণে ফায়ার সার্ভিস, এয়ারফোর্স এসেছে, যেটা স্বস্তির একটা বার্তা দিচ্ছিল। কিন্তু সেই স্বস্তি বেশিক্ষণ রইল না। আসলে তাদের সঙ্গেও নেই প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। মানুষ নিচে পড়ে যাচ্ছে। নিচে পড়ে যাওয়া মানুষের জন্য নেটের ব্যবস্থা না রেখে এ কেমন উদ্ধার তৎপরতা? আচ্ছা, আমার একটা প্রশ্ন, নিচে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ ওপর থেকে পড়া মানুষগুলোর জন্য হাতটা অন্তত বিছিয়ে দিলে ওরা বাঁচত না? আবেগ থেকেই বলা হচ্ছে হয়তো। সেই পরিস্থিতিতে বিষয়টা এত সহজ না। তবু আমরা ফায়ার সার্ভিসের এবারের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট। এই দুঃসহ সময়ে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ছাড়া যা করেছে কম নয়।

পত্রিকার পাতায় একজন বলছেন, এক বন্ধু তার সহকর্মী বন্ধুকে বারবার ফোন করে বলছেন: দোস্ত ওপরে ওঠ! হেলিকপ্টার আইছে! রাব্বী নামের ছেলেটা মরে গেছে। পকেটের ফোনটা তখনো তার জীবিত। বস্তাবন্দী লাশের পকেটে রিংটোন বাজছিল অবিরত। ফোনের ওপাশে নিশ্চয়ই প্রিয়জন। কেমন লাগছিল তার তখন? বস্তা খুলে ফোনটা রিসিভ করেছেন উদ্ধারকর্মী। কী বলবেন সেই প্রিয়জনকে তিনি? একটা মা চিৎকার করে রাস্তার ওপরে বসে কাঁদছেন। ছেলে তাঁর বিল্ডিংয়ের ওপরে। ওপর থেকে উদ্ধারকর্মীদের হাতে বেরিয়ে আসা একজন বলছেন, এর বেশি বলতে পারব না। বেরিয়ে আসতে পেরেছি—এই বড়। ভেতরে দেখেছি কেবল জীবন আর মৃত্যুর তফাত।

তফাত করে দেখলাম দুঃস্বপ্নটা তুলনামূলক সহনীয় মাত্রার বীভৎস ছিল। আমাদের বর্তমানের থেকে বীভৎস। এক দিনে অনেক অপমৃত্যুর খবর খেতে হয় আমাদের নাশতার সঙ্গে। এত নিরুপায় আমরা কখন হলাম, প্রশ্ন করে আগুন হাসে। আগুন। আগুন। আগুন। আগুন দেখতে কয়টা মানুষ আগুন হয়েছে? সেই অঙ্কটা এই অসময়ে করে আরও অসময় করে তুলতে চাই না একে। হাজার হাজার এই মানুষের ভেতরে তবু কিছু মানুষ আছে। যে আগুন ধ্বংস করে না, তৈরি করে।

ওই যে ছোট্ট ছেলেটা? আপনারা ইতিমধ্যেই দেখে থাকবেন। চোখে বারুদ, বুকে ব্যথা নিয়ে ছেলেটা বসে আছে পাইপের ছিদ্র ধরে। বিস্মিত আমরা। বাচ্চা মানুষটা রাষ্ট্রের ছিদ্র বন্ধ করে মানুষ বাঁচাতে চেষ্টা করছে! ছাই হয়ে যাওয়া স্বজনের জন্য এক আকাশ আশা এইটুকুই যেন। ওই যে কিছু মানুষ পাইপ ধরে আছে মাথায়, কাঁধে। এমন কাঁধ আরও কয়েকটা বেশি হলে একদিন ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ কথাটা অবশেষে সঠিক হবে। একদিন বাচ্চা ছেলেটার থেকে মানুষ হওয়ার শিক্ষা নিয়ে অযথা ভিড় করব না আমরা। পারলে যে যার মতো সহযোগিতা করব। নয়তো দূরে থেকেও যারা কাজ করছে, তাদের মানসিক স্ট্রেংথ হব। আমাদের দুঃস্বপ্নরা স্পর্ধা না পাক বাস্তবতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার। ওরা দুঃস্বপ্নেই থাক। আমরা বাঁচতে চাই। স্বাভাবিক একটা মৃত্যু চাই। আমাদের স্বজনেরা স্বাভাবিক একটা মৃত্যু চায়। স্বাভাবিক একটা মৃত্যু কি খুবই অস্বাভাবিক?

জাহান রিমা: ইমার্জেন্সি ডেন্টাল, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।