অগ্নিকাণ্ড রোধে করণীয়

রাজধানীর বনানীর বহুতল এফ আর টাওয়ারে আগুন। বনানী, ঢাকা, ২৮ মার্চ। ছবি: খালেদ সরকার
রাজধানীর বনানীর বহুতল এফ আর টাওয়ারে আগুন। বনানী, ঢাকা, ২৮ মার্চ। ছবি: খালেদ সরকার

আগুন লাগার ঘটনা সবচেয়ে বেশি বোধ হয় আমেরিকায় ঘটে। কারণ আমেরিকায় বেশির ভাগ বাড়িঘর কাঠের। তার ওপর আছে বারবিকিউর অভ্যাস। শর্টসার্কিটের কারণেও ধরে আগুন। এ ছাড়া আরও নানান ইস্যুতো আছেই। মোট কথা, আমেরিকায় আগুন লাগলে ছড়াতে সময় লাগে না। তাই এখানকার ফায়ার ফাইটারদের নিয়মিত দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। জরুরি ডাক পাওয়ার দুই মিনিটের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে হয়।

আমেরিকায় আমাদের সাধারণ জনতাকেও আগুনের ব্যাপারে শিক্ষিত করা হয়। স্কুল–কলেজে শেখানো তো হয়ই, কর্মক্ষেত্রেও নিয়মিত ট্রেনিং দেওয়া হয়। আমার মনে আছে, যখন ওয়ালমার্টে কাজ করতাম, স্থানীয় ফায়ার ফাইটাররা আমাদের দোকান থেকেই শপিং করতেন। যাঁরা ওয়ালমার্টে কখনো শপিং করেননি, তাঁদের জ্ঞাতার্থে, ওয়ালমার্ট একটি বিশাল দোকান। বিশাল মানে আসলেই বিশাল। কমসে কম এক থেকে দুই ঘণ্টা তো যাবেই। মাছ-মাংস দোকানের এক প্রান্তে হলে ঘরের জিনিসপত্র দোকানের সম্পূর্ণ উল্টো প্রান্তে। মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ইলেকট্রনিকস, জামাকাপড়, আসবাব, বইখাতা ইত্যাদি। তো এই ঘণ্টাখানেক সময় ব্যয় করে ফায়ার সার্ভিসের জওয়ানেরা শপিং কার্ট ভর্তি করে বাজার করতেন। ক্যাশিয়ারের কাছে চেক আউট করতে যাবেন, এমন সময়ে ডেপারচারের বার্তা আসত। সব ছেড়ে ছুড়ে সেই দোকান থেকেই দৌড়। এই যে বিগত ঘণ্টাখানেকের শপিং, আবারও শূন্য থেকে শুরু করতে হবে, এই সবের পরোয়া করার সময় নেই।

আগুন লেগেছে। মানুষের সাহায্য দরকার। প্রতিটা সেকেন্ড জীবন–মৃত্যুর মাঝে ব্যবধান গড়ে দেয়। এই শিক্ষাটা শুধু ফায়ার ফাইটারদেরই নয়, সাধারণ জনতারও আছে। তাই রাস্তায় ফায়ার ট্রাকের সাইরেন শুনলে মানুষ সাইড দিয়ে দেয়। যারা দিতে চায় না, তারাও সাইড দিতে বাধ্য। কারণ এ দেশে তা না করলে কঠিন শাস্তির বিধান আছে।

রাস্তায় যদি বাম্পার টু বাম্পার ট্রাফিকও হয়, তার পরও কীভাবে কীভাবে যেন সাইড দেওয়া হয়ে যায়। আমি নিজেও আইল্যান্ডের ওপর নিজের গাড়ি তুলে দিয়ে একবার সাইড দিয়েছিলাম। আরেকবার রং ওয়েতে গাড়ি সরিয়ে এনে জায়গা দিয়েছিলাম। আর এমনিতে রাস্তায় ভিড় না হলে আমরা সবাই স্রেফ ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যাই। ইমার্জেন্সি ভেহিক্যাল উল্কার বেগে ছুটে যায়।

গত কয়েক দিনে আপনারাও নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, আগুন লাগাটা খুবই সিরিয়াস বিষয়। আপনার বাড়িতে আগুন লাগলে আপনি যদি পুড়ে না–ও মরেন, তার পরও নিশ্বাসের সঙ্গে কার্বন টেনে অজ্ঞান হয়ে মরতে পারেন। প্রতিটা সেকেন্ড লাখ টাকার চেয়েও দামি। তাই ফায়ার সার্ভিসের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা শুধু নৈতিক নয়, সামাজিক অপরাধও বটে। আমাদের দেশের আইনে এ জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থদণ্ডের বিধান চালু করা উচিত। পুলিশ জাল ফেলে উৎসুক জনতাকে গ্রেপ্তার করবে। আদালত ওদের লাখখানেক টাকা জরিমানা করবেন। তারপর হয়তো বাবাজিদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে ছবি তোলার শখ কিছুটা হলেও মিটবে।

এফ আর টাওয়ারের আগুন নেভাতে পানি ছুড়ছে ফায়ার সার্ভিস। বনানী, ঢাকা, ২৮ মার্চ। ছবি: খালেদ সরকার
এফ আর টাওয়ারের আগুন নেভাতে পানি ছুড়ছে ফায়ার সার্ভিস। বনানী, ঢাকা, ২৮ মার্চ। ছবি: খালেদ সরকার

এখন জেনে নিই আগুনের ব্যাপারে কী কী সাবধানতা আমাদের নেওয়ার প্রয়োজন।

সবার আগে বুঝতে হবে অগ্নিকাণ্ডের জন্য কী কী উপাদান কাজ করে। যদি সেটা জানতে পারি, তাহলে সাবধান হতে সুবিধা হয়।

১. আগুন অথবা অত্যধিক তাপ। ইংরেজিতে বললে a source of ignition (heat), হতে পারে সেটা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট অথবা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে। আগুন যদি না–ও থাকে, অত্যধিক তাপ থেকেও কিন্তু অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। পুরান ঢাকায় একবার বিয়ে বাড়ির রান্নার তাপে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ঘরে রান্নাবান্নার ফলে অত্যধিক তাপ সৃষ্টি হয়েছিল। নিচে কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি থাকায় সেটা আগুন ছড়িয়ে দেয়।

২. জ্বালানি (a source of fuel (something that burns)), আগুন জ্বলার পরে যদি আশপাশে জ্বালানি থাকে, তবে সেটা সেই আগুনকে শক্তিশালী করে তোলে এবং সেটা ছড়াতে শুরু করে। এবারও পুরান ঢাকাকে উদাহরণ হিসেবে টানব। কেমিক্যাল মজুত করে রাখলে কোনো অবস্থায় সেখানে এক স্ফুলিঙ্গ আগুনও যদি পৌঁছে, তাহলেই দাউ দাউ করে আগুন ছড়াতে শুরু করবে।

৩. অক্সিজেন। অনেকেই জানেন না। অক্সিজেন ছাড়া আগুন জ্বলতে পারে না। আগুন ধরার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম কাজ হচ্ছে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে ফেলা। বদ্ধ ঘরের হাওয়ায় অক্সিজেন যদি না থাকে, আগুন দুর্বল হয়ে যায়। আপনি নিজেই গ্লাস উল্টো করে কাগজে আগুন ধরিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তাই কেউ জানালার কাচ ভাঙার চেষ্টা করবেন না। তাহলেই পুড়ে মরবেন। একই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, সেই ঘরে যেন মানুষ না থাকে। তাহলে অক্সিজেনের অভাবে তিনিও মারা যাবেন।

এই হচ্ছে অগ্নিকাণ্ডের তিনটি কারণ। এ ছাড়া আর কোনোই কারণ নেই।

তাহলে আমাদের করণীয় কী?

১. আগুন যেন না লাগে, সেটা খেয়াল রাখা। অফিস আদালতে আগুন নিয়ে কাজ–কারবার না করাই ভালো। জন্মদিনের কেকে মোমবাতি জ্বালানো জরুরি নয়। তার পরও যদি জ্বালাতে চান, সেখানে অগ্নিকাণ্ডের রিস্ক নেওয়া হবে। সেটা কি ঠিক হবে? এভাবেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম সম্ভাবনা থাকলেও এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।

২. ঘরের ভেতরে ম্যাচের কাঠি, সিগারেট, লাইটার ইত্যাদি অ্যালাউ না করা। চুলা জ্বালানো কাজে ওসব লাগলে নির্দিষ্ট স্থানে রাখুন। অনেক সময় শিশুরা না বুঝেই ওসব নিয়ে খেলতে গিয়ে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। বাড়ির বাইরেও জ্বলন্ত সিগারেট, জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি যেখানে–সেখানে ছুড়ে না ফেলা। খুব ছোটবেলায় আমাদের চট্টগ্রামের বাসার অদূরে এক বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেখেছিলাম। ওটা নাকি কারও ছুড়ে ফেলা সিগারেট থেকে শুরু হয়েছিল। আস্ত বস্তি পুড়ে ছাই হয়েছিল, মরেছিল অনেক গরিব মানুষ। কেবল একজনের সিগারেটের কারণে।

৩. বৈদ্যুতিক তার, সার্কিট ইত্যাদি নিয়মিত চেক করা। যদি কোথাও কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়, তাহলে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া। অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, বৈদ্যুতিক আগুনে পানি ঢালা চলবে না। এতে আগুন ভয়াবহ রূপ নেবে। সে ক্ষেত্রে আপনাকে মেইন সুইচ অফ করে দিতে হবে। তারপরে ফোম বা বালি ছিটাতে হবে। কিন্তু পানি না।

এফ আর টাওয়ারের সামনের সড়কে হাজারো মানুষ। বনানী, ঢাকা, ২৮ মার্চ। ছবি: খালেদ সরকার
এফ আর টাওয়ারের সামনের সড়কে হাজারো মানুষ। বনানী, ঢাকা, ২৮ মার্চ। ছবি: খালেদ সরকার

৪. দাহ্য পদার্থ বাড়িতে না রাখা। রাখলেও সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করা। বিশেষ করে যেখানে আগুন লাগার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকে, সেখানে অবশ্যই এসব পদার্থ না রাখা।

৫. প্রতিটা কমার্শিয়াল দালানে ইমার্জেন্সি ফায়ার এক্সিট আছে কি না, সেটা দেখা। যদি না থাকে, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা করা। যদি তার পরও কেউ ব্যবস্থা করতে না চান, তাহলে আইনের আওতায় এনে শাস্তির বিধান করা।

৬. ফায়ার এক্সিট না থাকলে কোনো কমার্শিয়াল ভবন নির্মাণের অনুমতি না দেওয়া।

৭. প্রতিটা দালানের প্রতি তলায় কিছু দূরত্বে অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থা থাকা, যাতে হাতের নাগালে পাওয়া যায়। সেই দালানে নিয়মিত কাজ করা প্রায় প্রত্যেক কর্মচারীকেই অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটার ট্রেনিং দেওয়া। এটা রকেট সায়েন্স নয়। একটা পিন টেনে একটা লিভার চাপ দিতে হয়। কিন্তু ট্রেনিং না থাকলে এই অতি সহজ কাজটিই তাঁরা করতে অক্ষম হবেন।

৮. মাসে একবার হলেও নিয়মিত ফায়ার ড্রিলের ব্যবস্থা করা। ফায়ার অ্যালার্ম বাজিয়ে ভবন খালি হলে কোন দিক দিয়ে বেরোতে হবে, সেটা অনুশীলন করা, যাতে বাস্তবে আগুন লাগলে মানুষ দিশেহারা হয়ে না যান।

৯. ফায়ার ডিটেক্টর বা অ্যালার্ম প্রতিটি বাড়ি ও অফিসে রাখা। ব্যাটারিচালিত এসব অ্যালার্ম ছাদে ঝুলে থাকে। বিন্দুমাত্র শব্দ করে না। কিন্তু সামান্য ধোঁয়ারও অস্তিত্ব টের পেলে এমনভাবে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেবে, আপনি সাবধান হতে বাধ্য। অনেক ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডের সময়ে মানুষজন অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। বুঝতেই পারেন না পাশের ঘরই আগুনে পুড়ছে। যতক্ষণে টের পাবেন, ততক্ষণে সব শেষ।

১০. নিয়মিত ওপরের নিয়মগুলোর অনুশীলন করা।

আমাদের দেশে ফ্লাইওভারের চেয়েও জরুরি বিষয় হচ্ছে ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা করা। বিদেশের অলিগলিতে ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকে। রাস্তাঘাটের অনুষঙ্গ বলা যায়। মানলাম, আমাদের দেশের জনসংখ্যা একটু বেশিই। তাই বলে কি তাদের প্রাণের মূল্য নেই?

আরেকটা কথা, যেকোনো বড় বিপদ আসার আগে ছোটখাটো বিপদ আসতেই থাকে। সিগন্যাল বলতে পারেন। আমরা যাতে সাবধান হতে পারি। আমরা কি আসলেই হচ্ছি? একটা ঠিকঠাক মাত্রার ভূমিকম্প হলে আমরা কি প্রস্তুত জানমালের এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য? অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ঢাকা শহর তখন মৃত্যুপুরী হয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।

এখন সবাই আঙুল তুলে বলছেন রাজউকের নকশা মেনে ওই সব ভবন নির্মাণ হয়নি। এই কাজটা যদি ১০ বছর আগে করতেন, তাহলে কি এই দুর্ঘটনা ঘটত? ঘুষখোর সরকারি কর্মচারী থেকে ভবনের লোভী মালিক, সবাই এই মৃত্যুর মিছিলের জন্য দায়ী।

এখনই সময়, ঢাকা শহরের যাবতীয় ‘আনফিট’ বাড়িঘর যা আছে, হোক সেটা ভূমিকম্পের জন্য রিস্কি অথবা অগ্নিকাণ্ডের জন্য, সেগুলোকে ফিট বানাতেই হবে। সাময়িক অসুবিধা হবে, কিন্তু আমার সন্তানের অপঘাতে মৃত্যুর আশঙ্কা যে কমবে, সেটাই কী যথেষ্ট নয়? না হলে আল্লাহ না করুক, এমন একদিন আসবে যখন আমরা হায় হায় করে কূল পাব না।

লেখকের ই–মেইল: <[email protected]>