বিস্মৃত রক্তস্নান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চাইলেই খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই হয়তো বাদলের খালি খিদে পায়। গতরাতে সাকলে দুমুঠো ভাত আর সামান্য সালুন পড়েছিল পেটে। এতটা বেলা হয়ে গেল, খিদে তো পাওয়ারই কথা। খাওয়ার কোনো বন্দোবস্তও চোখে পড়ে না বাদলের। এখন খাওয়ার কথা বললেই মা খেঁকিয়ে উঠবেন।

—দ্যাশের অবস্থা কেরোসিন আর তর খালি প্যাটের চিন্তা! গুল্লি খায়া প্যাট ভরা গিয়া হারামজাদা।

গুলি খেয়ে পেট ভরানো গেলে বাদল হয়তো সেটাই করত। এমনই ভয়াবহ খিদে পেয়েছে তার। পেটের ভেতর কেমন একটা অনুভূতি পাক খেয়ে খেয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে শরীরের এদিক–সেদিক। বাদলের কেমন অবশ অবশ লাগে। খিদে একদম সহ্য করতে পারে না। বকুলদের বাড়ি গিয়ে খাবার চাইবে কি না, একবার ভাবে। প্রায়ই সে খিদে মিটাতে বকুলদের ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে চলে যায়। চাচি তাকে যত্ন করে খেতে দেয়। বকুলের বাবা সম্পর্কে বাদলের ছোট চাচা।

বাবার সঙ্গে কোনো একটা বিষয় নিয়ে ছোট চাচার ঝামেলা হওয়ায় দুই বাড়ির সম্পর্কে গাঢ় শীতলতা জেঁকে বসছে দিন দিন। বাবা-মা কেউ চান না বাদলেরা বকুলদের ছায়া মাড়াক। সেখানে প্রায় তাদের ঘরে গিয়ে খেয়ে আসছে শুনলে আর রক্ষা নেই। গত পরশুই ছোট চাচি আদর করে তাকে শুঁটকি ভর্তা আর চিতই খেতে দিয়েছে। ছোট চাচির মনটা মায়ায় ভরা। চাচাও বাবার মতো বদরাগী না।

আসলে বড়দের মধ্যে ফেনিয়ে ওঠা জটিলতা ছোটদের সেভাবে স্পর্শ করে না। বাদল কিংবা ওর বাকি দুই ভাইবোন অথবা একমাত্র চাচাতো বোন বকুল, কাউকেই দুই পক্ষের বড়দের তিক্ততা আঁচড় কাটেনি। তাদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক। কখন বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সুট করে বেরিয়ে পড়বে, বাদল সুযোগ খুঁজতে থাকে। মায়ের চোখ ফাঁকি দেওয়া খুব কঠিন না। সমস্যা বাবাকে নিয়ে। শহরের অবস্থা সুবিধার না বলে বাবা রিকশা নিয়ে বের হননি। নিয়মিত রোজগারে বাধা পড়া মানেই বাদলদের একবেলা, কখনো গোটা দিনটাই উপোস দেওয়া। এ রকম সময়ে মা–বাবা দুজনেরই মেজাজ থাকে জ্বলন্ত চুলার মতো দপদপে।

বস্তির ঘরে ঢোকার আর বের হওয়ার একটাই দরজা। সাধারণ বাসাবাড়ির মতো চাইলেই বের হওয়ার বিকল্প পথের বাহুল্য এসব ঘরে থাকে না। গায়েপড়া মানুষের মতো ঘরগুলো একে অন্যের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকে। যেকোনো বস্তির এটা একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। জায়গার অভাবজনিত কারণটা বড় হলেও গরিব মানুষগুলোর মনে হয় একে অন্যের গা ঘেঁষে থাকতে তেমন অস্বস্তি হয় না। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা শব্দটা এই জগতে অনাহূত কিংবা বাহুল্য বিশেষ। ওপাশে সামান্য গলা তুলে করা আলাপচারিতা অনায়াসে লাগোয়া ঘরের মানুষের কানে এসে পৌঁছে যায়। হোক সেটা ঝগড়া বিবাদে ব্যবহৃত খিস্তিখেউরই কিংবা নারী-পুরুষের বিশেষ সময়ের শিৎকার।

বাদলেরা চকবাজার এলাকার এই বস্তিতে আছে বহু বছর ধরে। ওদের তিন ভাইবোনের জন্ম এখানে। বস্তির অলিগলি বাদল হাতের তালুর মতো চেনে। চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলেও সে ঠিক ঠিক জায়গায় গিয়ে পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু এখন সে যেখানে গিয়ে পৌঁছাতে চায়, তার জন্য ঘর থেকে একবার বের হওয়া দরকার। তারপর যেকোনো একটা পথ ধরে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে ঠিক পৌঁছে যাবে। কিন্তু সুযোগটা সে পাচ্ছে কোথায়!

খিদেটা আর আগের মতো শরীর অবশ করা অবস্থায় নেই। সেটা এখন কেমন একটা ব্যথায় রূপ নিয়েছে। এই ব্যথা কমাতে হলে খাওন চাই। আজ ছোট চাচার ঘরে যাওয়াটা বিপজ্জনক হতে পারে। বাবা ঘরে আছে। তার চেয়ে হাসপাতালের দিকে যাওয়া সম্ভব হলে ফরিদা খালার কাছ থেকে কয়েক আনার বন্দোবস্ত হতে পারে অনায়াসে। সে জন্য তাকে ঘরের বাইরে পা দিতে হবে। দেশের পরিস্থিতি নাকি খুব খারাপ, তাই তাদের হুটহাট বাইরে যাওয়ায় কড়াকড়ি।

তা সত্ত্বেও বাদল মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়েছিল গত পরশু। প্রবর্তকের মোড় পর্যন্ত গিয়েছিল। পাশেই হাসপাতালের সামনের বটগাছটার তলায় বসে ফরিদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে বানানো তাস খেলেছে। বাদল প্রায়ই তার বন্ধুদের নিয়ে হাসপাতালের এই গাছতলায় মার্বেল বা তাস খেলার আড্ডা জমায়। এই জায়গাটা ওর খুব পছন্দের। হাসপাতালে আসা–যাওয়া করতে থাকা মানুষজন দেখা যায়। সামনের বড় রাস্তার ছুটন্ত সাইকেল, রিকশা, গাড়ি নিয়ে ওরা মজার এক খেলা খেলে প্রায়। একটা গাড়ি ছুটে আসতে দেখলে বলতে হয় গাড়িতে কয়জন লোক? শুধু সংখ্যা বললেই হবে না, তার মধ্যে কয়টা মাইয়া মানুষ, কয়টা বেডা মানুষ বলা লাগবে। গতকাল গাড়ির সংখ্যা কম ছিল। খেলা তেমন জমেনি। এ ছাড়া দেশের খারাপ অবস্থার তেমন আর কোনো আলামত বাদলের চোখে পড়েনি। মায়ের হুদাই ডর!

ছোবড়া বেরিয়ে পরা, আসল রং হারানো তেল চিটচিটে তোশকের ওপর ছোট দুই ভাইবোন নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে। তার পাশের মাদুরে বাবা চোখ ঢাকা দিয়ে হাতখানা আড়াআড়ি করে কপালের ওপর তুলে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। এক পায়ের ওপর রাখা অন্য পায়ের পাতা থেকে থেকে নড়ে ওঠার কারণে বোঝা যাচ্ছে, বাবা সজাগ আছেন। ঘরের দোরটা সামান্য খোলা থাকায় সকালের যেটুকু আলো বুক ফুলিয়ে ঘরে আসতে সাহস করছে, মা সেই আলো সদ্ব্যবহারে মগ্ন হাতে বাবার ছেঁড়া লুঙ্গির ক্ষত ঢাকায় ব্যস্ত। গতকাল প্রবর্তক মোড়ে হঠাৎ মিলিটারি, মিলিটারি রব শুনে অন্যদের মতো প্রাণ নিয়ে কোনো মতে রিকশা টান মেরে পালাতে গিয়ে পরনের বহু ব্যবহৃত লুঙ্গিটা ছিঁড়ে গেছে। বাবার দুটো মাত্র লুঙ্গি।

সাহস করে বাদল মাকে জিজ্ঞাসা করে বসে, মা সহাইল্লালা খাওনের কিসু নাই?

সেলাইয়ে ব্যস্ত হাতখানা সামান্য সময়ের জন্য থমকে যায়। চোখ তুলে মা একবার তাকান তাঁর সদাই খাই খাই করা সন্তানটির দিকে। বাদলকে অবাক করে দিয়ে মা বলে ওঠেন, নারে বাজান, অহন খাওনের কিসু নাই। মাদাইন্নালায় খামুনে এহবারে। অহন এট্টু গুড় দিয়া পানি খা।

প্রত্যাশিত গালাগালির বদলে মায়ের এমন অভাবিত প্রস্তাবে বাদল অবাক হতে ভুলে যায় প্রথমে। তারপর গুড়ের খোঁজে ত্রস্তে ঘরের কোণটায় চলে যায়। গুড়ের ঠোঙাটা তার চেনা। গতকাল মোড়ের দোকান থেকে এক আনায় দুই খান পাটালি গুড়ের ঢেলা সে নিজেই কিনে এনেছিল। আলাইবালাই কাটানোর জন্য মসজিদে শিরনি সদকা দেবে মা। যত্নে সাজানো কিছু পুরোনো কৌটার ভিড় ঠেলে তুলে নেয় পাটালির ঠোঙাটা। দাঁতে কামড়ে খায় খানিকটা গুড়। খানিকটা ভেঙে নেয় হাতে। ঘরের কলসিতে পানি নাই। কানাভাঙা পানির মগটা হাতে নিয়ে মাকে পাশ কাটিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়।

মা জরিনা বেগম সর্তক চোখে বাদলকে পর্যবেক্ষণে রাখেন। বলা যায় না যে রকম দস্যি ছেলে ফুড়ুৎ করে তাঁকে ফাঁকি দিয়ে কেটে পড়তে পারে। দেশের অবস্থা ভালো না।

পাশের ঘরের রহিম ভাই গত রাতে বাদলের বাপকে সাবধান করে দিয়ে গেছেন। এখন যেন হুটহাট রিকশা নিয়ে যেখানে–সেখানে চলে না যান। সাবধানে থাকতে হবে। ঢাকা শহরে মিলিটারি পাখির মতো মানুষ মেরে সাফা করতে করতে দেশের অন্য শহরেও ঢুকছে। শহরের লোকগুলানরে মারা শেষ করে গ্রামে গ্রামে হানা দেবে। চট্টগ্রামেও গোলাগুলি হইছে টাইগারপাস ষোলোশহর এলাকায়। পাহাড়তলীতে বিহারিরা পাগলা কুত্তা হয়ে গেছে। অনেক মানুষ মরছে ওখানে।

বাদলের বাবা জানতে চান, আমরা তো সরলসিদা মানুষ, রাজনীতি করি না। অগোর কিসুতেই নাই। মিলিটারিরা আমাগো মারব ক্যান? আমরা তাগো কী করছি?

রহিম মিয়া গত মাসে ঢাকা শহর ঘুরে এসেছেন। সেখানকার সামান্য জানা ঘটনায় নিজের ভাবনা মিশিয়ে যা মনে আসে বলে যান। বিজ্ঞের মতো তিনি জানান, তোরার দোষ তোরা বাঙালি। তোরার দোষ তোরা নৌকাত সিল মারগিলি। আঁই ঢাহা শরততুন হুনি আইসসি, রাস্তাঘাট গরম। মিলিটারি লামাই দিবু যে হোনো সমত। ইয়াহিয়ার বাইচ্চা কেউরে ছাইড়ত ন। বেয়াকরে ফিডি সোজা গরি ফালাইবু। ফালাফালি গরি হোনো লাব নাই।

—আমাগো তো সরকারই ভুট দিতে কইছিল, তাই ভুট দিসি। এহন আমাগো দুষ হয়া গেল। আমাগো গুলি করব ক্যান? এইডা কী মগের মুলুক?

—অত হতা ন বুঝি। এন্ডে বন্দুক যার খমতা তার। আঁরা তো হালিয়াই বাঁশখালী যাইয়ুম গুই অউরোর বাড়িত। তোর তো কুমিল্লা যাইবার উফায় নাই। এন্ডেই থাক, সাবধানে তাকিস ফোয়া ছা লইয়েরে।

দুজন পুরুষের কথোপকথন বাদলের মা চুপচাপ শুনে গেলেও অজানা আতঙ্কে তাঁর শরীরে কেমন কাঁপুনি ধরে। মহাবিপদের আশঙ্কায় তাঁর কেমন বেদিশা লাগে। ছোট দুই ছেলেমেয়ে মোটামুটি শান্তই। তাদের বশে রাখা খুব একটা কঠিন না। তার সব চিন্তা বাদলকে নিয়ে। নিষেধ ভাঙার বেপরোয়া নেশা আছে বাদলের মধ্যে। সেটা নিয়েই তাঁর ভয়।

কোনো ছল করে ছেলে যেন চোখের আড়াল হতে না পারে, সে কারণে নানা ছুঁতোয় তাকে আটকে রাখার চেষ্টা জরিনা বেগমের। এই যেমন এখন সেলাইয়ের ছুঁতো ধরে দরজা আগলে বসেছেন সকাল সকাল। বাইরের মটকা থেকে মগ ভরে পানি নিয়ে আয়েশ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পানি খায় বাদল। মুখ ভরে পানি নিয়ে ছিটায় এদিক–ওদিক।

—এক্কাইয়া পানি ছিটানির কাম নাই। ঘরে আয় বাদল।

মায়ের ডাকে বাদল পেটের নিচটা চেপে ধরে বলে, মুইত্যা আহি মা, খাড়াও।

মায়ের প্রহরায় প্রস্রাবের উসিলায় বাদল বস্তিঘরের এদিক–সেদিক ঘুরে আসার সুযোগ পায়। ঘরে মন টেকে না তার একদম। তার বাইরে যাওয়ার ওপর নেমে এসেছে কঠিন বারণ।

দুই.

পরদিন সকালে ভরপেট খাওয়া হয় অনেক দিন পর। পাতলা খিচুড়ি, বেগুন ভর্তা, শুকনা মরিচ ভর্তা দিয়ে ঠেসে খায় সবাই। বাদল দুই-তিনবার চেয়ে নিয়েছে। হিসাব ভুলে মা শান্ত মুখে হাতায় করে তুলেও দিয়েছে। পাশের ঘরের রহিম মিয়ারা গ্রামে রওনা দেওয়ার আগে ঘরের চাল, ডাল, আনাজপাতি যা ছিল সব বাদলের মাকে দিয়ে গেছেন সেই কাকডাকা ভোরে। সেই উৎসের জোরে সকালের খাওয়াটা জোরালো হলো।

ঠেসে খেয়ে ভরা পোয়াতির মতো পেট নিয়ে বাদল তোশকে হাত–পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে। ভরপেট খেয়ে ছোট ভাইবোন দুটো এখন চাঙা। তারা এক কোণে বসে কড়ি খেলায় ব্যস্ত। বাবা দরজায় ভর দিয়ে বিড়ি ফুঁকছে আর পাশে বসে থাকা মায়ের সঙ্গে বিড়বিড় করে কী সব বলছে। ঘরের এসব টুকরো দৃশ্য দেখতে দেখতে বাদলের পেট মোচড় দিয়ে ওঠে।

পেটে মোচড় পড়ায় তড়বড় করে উঠে বসে বাদল। পায়খানার একটা বেদম বেগ সামাল দিতে পেট খাঁমচে হুড়মুড় করে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। দরজার সামনে আলাপরত দুজনই বাদলকে ওভাবে উঠে পড়তে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। ছেলের ভাবগতিকে জরিনা বেগমের বুঝতে বাকি থাকে না, পায়খানা পেয়েছে বাদলের। এই এক অভ্যাস, খাওয়া জোরদার হলেই বাদলের বেগ পায়। তা ছাড়া তখন যেভাবে হাঁসের মতো কতকতিয়ে গিলেছে, পায়খানার আর দোষ কী!

ছেলেটাকে চোখে চোখে রাখার জন্য মা আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ে।

—খাড়া বাজান, আমি আসতাসি।

বাদল মায়ের আগে আগে চপল পায়ে বদনা হাতে বারোয়ারি পায়খানার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে চোখ ইশারায় তাকে ভেতরে গিয়ে কাজ সেরে আসার ইঙ্গিত করে। এখন পায়খানার এদিকটায় ভিড়বাট্টা তেমন নাই।

জরিনা বেগমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইটভাটায় কাজ করা সেলিনা খালা চিন্তাগ্রস্ত মুখে এগিয়ে আসেন।

—কী গো বাদলের মা, তোমরা এইহানেই থাকবা ঠিক করসো, নাকি সইরা যাইবা?

বুক ঠেলে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাসটা ফেরত পাঠিয়ে জরিনা বলে, না গো খালা, যামু আর কই? এইহানেই থাহুম।

নারী দুজন আসন্ন বিপদ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথোপকথনে কিছু সময়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

বাদল ভালো মানুষের মতো কাজ সেরে বেরিয়ে, মা আর সেলিনা নানির আলাপে মগ্ন দৃশ্যটা দেখে। মায়ের দিকে হাঁটা দিতে গিয়েও কী মনে হওয়ায় চট করে বাঁক ঘুরে পাশের গলিটায় সেঁধিয়ে যায়। গত দুদিন ঘরে থাকতে থাকতে হাত পায়ে খিল ধরে গেছে। শহরে নাকি কারফু দিছে, তাই ঘর থেকে বের হওয়া মানা। কারফু সে জানে না। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার আনন্দটা বেশ জানে। হাসপাতালের সামনে সবুজ খোলা মাঠ, গাছগাছালির বাগান। খেলাধুলার জায়গা না হলেও ওখানে পা ছড়িয়ে বসে থাকতে বেশ লাগে। রাস্তার ওপাশে মার্বেল খেলে ওর বন্ধুরা। এই সময়টায় মামুন, ফরিদকে বটগাছ তলায় পাওয়া যাবে। এই যে ওকে চোখে চোখে পাহারা দিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা। সেটাই বুঝি বাদলকে নিষেধের দেগে দেওয়া রেখা অতিক্রমের হাতছানি দেয়। মুহূর্তে পেয়ে যাওয়া সুযোগটা লুফে নিয়ে কী এক ঘোরে বাদল ছুটতে থাকে হাসপাতালের মোড় লক্ষ্য করে।

ছুটতে, ছুটতে, পথে তেমন গাড়ি–ঘোড়া চোখে পড়ে না বাদলের। লোক চলাচলও তেমন নাই। চারপাশটা কেমন থমথমে। একবার মনে হয় ফিরে যায়। মা বেচারি এখনো হয়তো দাঁড়িয়ে আছেন তার অপেক্ষায়।

এখন ফিরে গেলেও মা বুঝবেন না তাঁর চোখ ফাঁকি দিয়ে সে পালিয়েছিল। পর মুহূর্তেই মনে হয়, ধুর! দেখেই আসা যাক ঘটনা কী। মিলিটারি স্বচক্ষে দেখেনি বাদল। পুলিশ দেখেছে। তার মতো ছোট ছেলেদের মিলিটারি নিশ্চয়ই কিছু করবে না। বড় জোর বকাঝকা করতে পারে। বকাঝকা তো ওদের কাছে গায়ের ময়লা। মৃদু একটা হাসিতে ভরে ওঠে বাদলের গোলগাল মায়াভরা মুখটা।

হাসপাতালের কাছে পৌঁছে হাঁপাতে হাঁপাতে চারপাশটা দেখে অবাক হয় বাদল। এ জায়গা এত সুনসান অবস্থায় সে কখনো দেখেনি। গেটের কাছ ঘেঁষে ছোট্ট দোকানের ঝাপটা বন্ধ। প্রতিদিন যেখানে কিছু রিকশা জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এখন সেখানটা খাঁ খাঁ করছে। কেউ নাই কোথাও। ফরিদ বা মামুন কাউকেই দেখতে পায় না আশপাশে। গত দুদিন এদিকে আসেনি সে।

বটগাছ তলায় এসে বসে বাদল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখবে। ফরিদরা এলে ভালো, নইলে সে ফিরে যাবে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে কয়টা বাজে আন্দাজ করতে চায় বাদল। প্রতিদিন এই সময়টাতে হাসপাতালের সামনে হইহট্টগোলে আলাদা একটা চেহারা নেয় পুরো এলাকাটা। আজকের এই থমথমে পরিবেশটা বুকে কেমন কষ্ট কষ্ট অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে সন্তর্পণে। বাদলের খামোখাই কেমন কান্না পায়।

এই প্রথম তার মনে হয় কাজটা সে ঠিক করেনি। ঘরে ফেরা দরকার। ঠিক তখন বাদলের চোখ পড়ে হাসপাতালের দালান ঘেঁষে দাঁড়ানো কয়েকজন অস্ত্রধারী সৈনিকের দিকে।

সর্বনাশ! ওরা কারা? মিলিটারি? ওদের জন্যই তাহলে চারপাশ এত সুনসান!

মন বলছে পালাতে হবে। এখনই সরে পড়া দরকার। বাদল আস্তে আস্তে পেছনে ঘুরে চকের দিকে ছুটতে যাবে, এমন সময় বাজখাই কণ্ঠে কেউ ডেকে ওঠে। বাদল তাকিয়ে দেখে ওই বেখাপ্পা চেহারার লোকদের একজন হাতছানি দিয়ে ওকেই ডাকছে। ধরা পড়ে গেল সে। আর উপায় নাই। গুটিসুটি পায়ে এগিয়ে যায় ওদের দিকে।

লোকটা বিজাতীয় ভাষায় কিছু একটা বলছে গাছটা দেখিয়ে। যার অর্থ বাদল কিছুই বুঝতে পারে না। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে, ভেতর থেকে আরেকজনকে ডেকে আনা হয়। সে তাকে ভাঙা বাংলা আর উর্দু মিশিয়ে কিম্ভূত ভাষায় বোঝাতে সক্ষম হয়, বাদলকে সামনের গাছটায় উঠতে হবে। গাছের ওপর একটা পতাকা উড়ছে। ওই রকম পতাকা নিয়ে মিছিল দেখেছে সে রাস্তায়। কয়েক দিন আগেও ওই পতাকা শহরের সবখানে উড়েছে। অলিতে গলিতে, বাড়ির ছাদে ছাদে। মিলিটারির ভয়ে গত কদিনে সবাই নামিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এই পতাকাটি রয়ে গেছে। এখন বাদলকে গাছে উঠে বাতাসে অহংকার ছড়িয়ে উড়ছে যে পতাকা, ওটা নামিয়ে আনতে হবে। বাদল অবাক হয়, যেদিন গফুর চাচা এই পতাকাটা গাছে বেঁধেছিল, সেদিন অনেকের সঙ্গে বাদলও উপস্থিত ছিল। কিছু মানুষকে কাঁদতেও দেখেছিল বাদল। সে কান্না আনন্দের না দুঃখের, তার সবটা না বুঝলেও এটুকু বুঝেছিল, এই পতাকা অনেক বড় কিছু, একে সম্মান দেখাতে হয়। উপস্থিত মানুষগুলো সেদিন পতাকার দিকে হাত তুলে সালামের ভঙ্গি করেছিল। পুলিশেরা যেমন করে। কিন্তু এই খাম্বার মতো লোকগুলো পতাকাটা নামিয়ে আনতে বলছে কেন? এরা কারা?

—বুঝ লিয়া?

কিম্ভূত বাক্যটা উড়ে আসার পর মুহূর্তে একটা সবল হাতের তীব্র থাবা বাদলকে গাছের কাছে নিয়ে আসে। বাদল কতবার উঠেছে এই গাছে। শুধু এই গাছে না, যেকোনো গাছ বাইতে ওস্তাদ বাদল। ঘটনার আকস্মিকতায় এখন যেন বুঝই পাচ্ছে না কীভাবে গাছে উঠতে হয়! মুহূর্তকাল থম ধরে দাঁড়িয়ে থেকে জড়তা নিয়েই গাছে ওঠে। পতাকাটা খুলে হাতে নেয় বাদল। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা খাম্বাগুলো পতাকাটা নিচে ফেলার ইশারা করে। এমন জিনিস ছুড়ে নিচে ফেলতে বাদলের মন সায় দেয় না। সে যত্ন নিয়ে পতাকাটা ভাঁজ করে বুকের কাছটাতে ধরে। কেমন সুন্দর কর্পূরের গন্ধ পতাকার শরীরজুড়ে! নাকি কোনো ফুলের?

ওদের কথা অগ্রাহ্য করায় নিচ থেকে হুংকার ভেসে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একঝাঁক গুলি ছুটে এসে বাদলকে তীব্রভাবে আলিঙ্গন করে।

গাছের ডালে ডালে বাস করা অসংখ্য পাখপাখালি হঠাৎ নৈঃশব্দ্যের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করা গুলির শব্দে দারুণ ত্রাসে উড়ে পালায় দিকশূন্যপুরে। বাদলের শরীরটা একটা মোচড় দিয়ে গাছের ডালে বাড়ি খেয়ে আছড়ে পড়ে নিচের সবুজ ঘাসের গালিচায়। ওর খোলা দুই চোখে তখনো জমাট বিস্ময়! বুকের কাছে ধরে থাকা লাল–সবুজ পতাকা ভিজে উঠেছে বুকের রক্তে। সর্বক্ষণের সঙ্গী পকেটে রাখা মার্বেলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে এদিক সেদিক...।

পাদটীকা: একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পর চট্টগ্রাম শহরে ক্যাপ্টেন রফিকের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে প্রবর্তক মোড় ও মেডিকেল–সংলগ্ন এলাকা ইপিআর সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ২৯ মার্চ ১৯৭১ সকাল পর্যন্ত। সেদিন বিকেলে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি জাকির হোসেন রোডে একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে অনুরোধ করে অসুস্থ কাউকে আনার জন্য। অ্যাম্বুলেন্সটি ফিরে এলে অসুস্থ রোগীকে ভেতরে নেওয়ার জন্য ডাক্তার–নার্স ছুটে এলে দেখা যায় দরজা খুলে ভেতর থেকে পাকিস্তানি সৈন্য বেরিয়ে আসছে। এভাবে ভাঁওতা দিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দখলে নেয় পাকিস্তানিরা।

পরদিন সকালে কারফিউ চলছিল। হাসপাতালের সামনের একটা গাছে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। পাকিস্তানিরা একটা কিশোরকে বলে গাছে উঠে পতাকাটা নামিয়ে ফেলতে। কিশোরটি ভয়ে ভয়ে গাছে উঠে পতাকা খুলে নেয়। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে যখন পতাকাটি ভাঁজ করছিল তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। ছেলেটার নিথর দেহ একটা ভারী পাথরের মতো ঝুপ করে পড়ে গেল গাছের নিচে। তারপর পাকিস্তানিরা হাসতে হাসতে সেখান থেকে চলে গেল।

তথ্যসূত্র: লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম (পৃষ্ঠা ১৩৫, ১৩৭)
...

নাহার তৃণা: ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র।