ম্যানিলায় মৃত সাগর

মৃত সাগরের লবণে তৈরি প্রসাধনী
মৃত সাগরের লবণে তৈরি প্রসাধনী

এই দাঁড়াও দাঁড়াও, যাও কোথায়! বিনে পয়সায় অর্গানিক সাবান দিচ্ছি, নিয়ে যাও!

প্রস্তাবটি শুনে থমকে দাঁড়ালাম। আসলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছিলাম ইরিতে (আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট) যাওয়ার কোস্টার বাস ধরতে। বিকেল চারটা বাজতে আর মিনিট দশেক বাকি। চারটায় কোস্টার বাস ইরির উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। সকালে ছোট্ট শহর লস ব্যানোসে অবস্থিত ইরি থেকে এই কোস্টার বাস আমাদের নিয়ে এসেছে ৬০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে ফিলিপাইনের রাজধানী শহর ম্যানিলার বাণিজ্যিক কেন্দ্র মাকাতিতে। নিয়ে এসেছে, যেন আমরা পকেট উল্টিয়ে টাকাপয়সা সব সাফ করে সারা দিন ধরে শপিং করতে পারি। পরিচ্ছন্ন পকেটওয়ালা আমাদের উদ্ধার করে আবার ইরিতে ফেরত নিয়ে যাবে সেই একই কোস্টার বাস বিকেল চারটায়। সেটি মিস করলে কেনা কোনো আইটেম আবার বিক্রি করে ইরিতে ফেরার টাকা জোগাড় করতে হবে! সেই ঝক্কিতে যেতে চাচ্ছি না বলেই কোস্টার বাসটির স্টপিং পয়েন্ট অভিমুখে এই নাভিশ্বাস যাত্রা।

কিন্তু এদিকে অর্গানিক সাবান বিনে পয়সায় চলে যাচ্ছে। কবি বলেছেন, ফ্রিতে যদি মবিল পাও, একটুখানি চেখে নাও! কবির কথা তো অমান্য করতে পারি না। কাজেই আমি আমার হন্টন গতিতে ঝাঁকি দিয়ে ব্রেক কষলাম। নিজেকে নিরপেক্ষ গিয়ারে নিয়ে বিনে পয়সায় অর্গানিক সাবান সাধা সুকন্যার পাশে দাঁড়ালাম।

সুকন্যা, শপিং মলের করিডরে কসমেটিকসের ভ্রাম্যমাণ দোকান খুলে বসেছে।

: এই নাও সুগন্ধি অর্গানিক সাবানের স্যাম্পল।

ছোটখাটো গড়নের ফিলিপাইনের মেয়েটি একটা টিস্যু পেপারে মুড়ে একটুখানি আধা স্বচ্ছ বস্তু দিল।

: বাহ দারুণ।

বস্তুটি খাবলে নিয়েই আমি আবার ছুট দেওয়ার উদ্যোগ নিই।

: দাঁড়াও দাঁড়াও! তুমি কি জানো এই সাবান যে সে সাবান নয়। এটা মৃত সাগরের কাছে তৈরি হয়েছে। মৃত সাগরের লবণ আছে এতে। ওহ তুমি মৃত সাগর কী জিনিস তা জানো তো?

মেয়েটি কিছুটা সন্দেহ নিয়ে তাকায়।

: ওই যে, চিত হয়ে যে সাগরের পানিতে শুয়ে পত্রিকা পড়া হয়, সেই সাগর।

আমি পাণ্ডিত্য ফলাতে পেরে গদগদ হই।

: ওহ তুমি দেখি জানো!

মেয়েটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়।

এবার আমি হে হে করে পগারপার হতে চাই।

: মৃত সাগরের লবণ দিয়ে বিনে পয়সায় হ্যান্ড স্পা দিচ্ছি। নিতে চাও? মেয়েটি আমার পথ রোধ করে নতুন মেওয়া সাধে!

বিনে পয়সায় মবিল খাওয়ানো কবি আবার আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলাতে থাকে। কিন্তু ওদিকে কোস্টার বাসের কী হবে!

: কত সময় লাগবে তোমার স্পা করতে! ভয়ে ভয়ে জানতে চাই।

: কিচ্ছু সময় লাগবে না। হাত বাড়াও দেখি! মেয়েটির গলায় এবার কর্তৃত্বের সুর।

আমি দুই হাত বাড়াতেই আমার দুই হাতে এক থাবা লবণ ঢেলে দিল পাশের কৌটা থেকে।

: দুই হাত ঘষতে থাকো। এভাবে দেখো!

মেয়েটি নিজের দুই হাত ঘষতে থাকে। তার দেখাদেখি আমিও দুই হাতে লবণ ঘষতে থাকি। হাত একটু একটু জ্বলছে।

: আরে শুধু শুধু লবণ ঘষে হাত ক্ষয় করছি কেন? বিনে পয়সায় মবিল খেতে খেতে আমার হঠাৎ বোধোদয় হয়।

সারার সঙ্গে লেখক
সারার সঙ্গে লেখক

: কী বললে! প্রবল অবিশ্বাস নিয়ে মেয়েটি আমার দিকে তাকায়। এটা শুধু শুধু লবণ! তুমি মৃত সাগর কী বস্তু আসলেই জানো তো? তুমি জানো, মৃত সাগরে ফি বছর সারা দুনিয়ার কত লোক হামলে পড়ছে রোগশোক খেদিয়ে চাঙা হতে! মৃত সাগরের লবণ ব্রণ, অ্যাকজিমা, শ্বাসকষ্ট সারায়।

আরও কী কী সব আরোগ্যময় রোগের নাম মেয়েটা বলে গেল এক নিশ্বাসে। ব্রণ, অ্যাকজিমা পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু শ্বাসকষ্ট সারাবে কীভাবে? আমি ভিরমি খাই।

হঠাৎ ঝট করে মনে পড়ে গেল পাড়ার ছোট ভাই জসিমের কথা। আজকাল সে আকুপ্রেসারের মাধ্যমে চিকিৎসার পাঁড় ভক্ত হয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই সে বোঝায় চিকিৎসাবিদ্যায় হাত আর পায়ের তালুর মাহাত্ম্য। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রাণভোমরা ঘুমিয়ে আছে এই হাত আর পায়ের তালুতে। ঠিক জায়গামতো টিপ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্নায়ুকেন্দ্র জাগিয়ে দিতে পারলেন তো আপনার ছুটি, ডাক্তারেরও ছুটি। ব্যথা–বেদনা, মন খারাপ সব উধাও! একবার আমি ঘাড়ে ব্যথা পেলাম। জসিম হাসি হাসি মুখে আমার আকুপ্রেসার চিকিৎসা শুরু করল। ঘাড়ের ব্যথা সারাতে আমি হাতের তালুর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রবল চাপ খেতে থাকলাম। পরে অবশ্য আমি ঘাড়, সেই সঙ্গে হাতের তালুরও ব্যথার জন্য ওষুধ খেয়েছিলাম। মানুষ বড়ই অস্থির জাতি। একটু ধৈর্য ধরবে না আবার ফলও চাইবে। আমি অস্থির হয়ে কপ করে ওষুধের দ্বারস্থ হয়েছিলাম।

আজ এই মেয়ে বলছে মৃত সাগরের লবণে শ্বাসকষ্ট পালাবে! তার কথায় আমার মনে হলো, কী জানি, হয়তো হাতের কোনো মোক্ষম স্নায়ুকেন্দ্রে এবার লবণগুলো কাজ করবে! বিজ্ঞান কতশত ভুতুড়ে দিকে বাঁক নিচ্ছে, তার কতটুকুই–বা বুঝি। শ্বাসকষ্টে হাঁসফাঁস করে মরছি কবে থেকে। এখন সামনে শুধু এক খাবলা লবণের দূরত্ব। তারপরই আমার ফুসফুস আর অনাবিল অক্সিজেনের মধ্যে আর কোনো যানজট থাকবে না।

আমি নতুন উদ্যমে লবণ দিয়ে হাত ঘষতে থাকি। মেয়েটি আমার হাতে একটু একটু পানি স্প্রে করে আর আমি অবিরাম ঘষি। আমার হাতের নিচে রাখা চীনামাটির বাটিতে পানিগুলো জড়ো হতে থাকে।

: কত দিন হাত ধোও না বলো তো?

শাসনের সুরে মেয়েটি বলে।

আমি অপ্রস্তুতভাবে তাকাই।

: দেখো পানি কালচে হয়ে গেছে। মেয়েটি চীনামাটির পানি দেখিয়ে বলে।

: দেখো আমি সেই কখন লস ব্যানোস থেকে এসেছি, সারা দিন ঘোরাঘুরি।

আরও বিভিন্ন কারণ বলতে যাচ্ছিলাম ওই কালচে পানি দেখে।

: আরে দূর, আমি তো ফাজলামি করছিলাম! মেয়েটি হাসতে থাকে। এগুলো তোমার হাতের মৃত কোষ। মৃত সাগর তোমার হাতের সব মৃত কোষ সরিয়ে ফেলেছে।

বাহ, আমার হাতে এখন আর কোনো মৃত কোষ নেই। একটা সফল হ্যান্ড স্পা আমি এইমাত্র শেষ করলাম। সেটাও আবার মৃত সাগরের ম্যাজিক্যাল লবণ দিয়ে। এই অভাবনীয় সুখানুভূতি নিয়ে কোস্টার ধরার জন্য আমি আবার পা বাড়াই।

: কী যাই যাই করছ। পরিচয়ই তো হলো না তোমার সঙ্গে। আমি সারা। তুমি?

: হিশাম।

: তোমার বয়স কত? বউ আছে?

জানালাম যে আমার বউ আছে, বয়সও জানালাম।

: কী বললে? আমি তো তোমাকে অনেক কম বয়সী ভেবেছিলাম। একদম বোঝা যায় না তোমার বয়স।

মাথা–মনকে বোঝাতে চাইল যে এটি তেল। লুব্রিকেন্ট। এটি ছাড়া যন্ত্রের মসৃণ সঞ্চালন হয় না। কিন্তু মন তো মাথার নাক গলানো সইবে না। মন বলে, মাথারে, তেল হলে আমার হবে, তুই নিজের চরকায় তেল দে!

: শোনো এই যে দেখো, কত ভালো ভালো কসমেটিকস। এগুলোতে মৃত সাগরের লবণ আছে। তোমার বউয়ের জন্য এই তিনটা কসমেটিকস কিনে ফেলো। তোমার জন্য দাম কমিয়ে রাখব। সে তিনটা কৌটা বেছে আমার সামনে রাখে।

মৃত সাগরের লবণ
মৃত সাগরের লবণ

আর মাত্র তিন মিনিট সময় আছে কোস্টার বাস আসার। ওই তিনটা কৌটা যাচাই করে দেখার, দাম নিয়ে দেনদরবার করার সময় আমার নেই। তা ছাড়া আগেই বলেছি, আমার পকেটও এখন মোটামুটি পরিষ্কার। নতুন ক্রয় অভিযান ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার সুযোগই বেশি।

: দেশে যেতে দেরি আছে আমার। এখন কিনলে খামোখা কসমেটিকসগুলোর মেয়াদ ফুরাতে থাকবে। শোনো আমি প্রতি মাসে আসি এখানে। যাওয়ার আগে নিয়ে যাব তোমার কাছ থেকে। আমি তাড়াতাড়ি বলে দূর হতে চাই।

: আরে আমার দোকানের কী ঠিক আছে নাকি! পরে কী আর এখানে বসব? এখানে–ওখানে বসি। পরে তো চিনবেও না আমাকে।

: ঠিক আছে, আসো আমরা সেলফি তুলি। তাহলে ছবি দেখে তোমাকে চিনে খুঁজে নেব।

হাসি হাসি মুখে আমরা সেলফি তুলে ফেললাম। মৃত সাগরের লবণ আর কসমেটিকসের ছবিও বাদ গেল না। তারপরই ফাঁদ থেকে কোনো রকমে জান নিয়ে পালানো ইঁদুরের মতন দিলাম ছুট!

পেছনে অখুশি মেয়েটি তখন বলে চলেছে, কিন্তু! মৃত সাগর...!
...

হিশাম আল রাব্বী: আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, ফিলিপাইনে অন জব ট্রেইনি হিসেবে কর্মরত।
ই–মেইল: <[email protected]>