এখন আর ফোন করার তাড়া নেই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তখন ল্যান্ডফোন ছিল। সেটা ছিল ২০০০ সাল। আমি আমেরিকায় আসার পর আম্মাকে সপ্তাহে একবার ফোন করতাম। আগেই বলে দিতাম, কোন দিন কখন বা কতটার সময় ফোন করব। তা-ও আমার বোনের পাশের বাসায়। কুমিল্লাতে। আম্মা সময়ের আগেই এসে বসে থাকতেন ফোনের পাশে। আমি ফোন করলে ১০ মিনিট কথা হলেই বলতেন, ‘তোর অনেক বিল আসবে, এবার রেখে দে। দরকারি কথা তো কিছু নেই।’ আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। বলতাম, এসব নিয়ে কথা বললে আর ফোন করব না। আমার তো অন্য কোনো চাহিদা নেই। না শাড়ি, না গয়না। শুধু তো ফোন করি। এর বিলও কি দিতে পারব না? আমি কথা বলেই চলতাম। দেখতাম আম্মাও রাজ্যের কথা বলছেন। আমি চাইতাম আম্মা তৃপ্তি নিয়ে কথা বলুন, মন ভরে কথা বলুন। শান্তি পান। আমি নিজেও খুশি হতাম।

আমি আমেরিকা থেকে সরাসরি ফোন করতাম। তখন নিউ জার্সিতে আমি যেখানে থাকতাম, সেখানে ফোনকার্ড ছিল না, যে কারণে প্রচুর বিল আসত। কিন্তু এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ ছিল না কোনো দিন। বরং এমন হয়েছে, এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা কথা বলেছি। যত বিল আসে আসুক। মনের শান্তি আগে। আম্মার সঙ্গে কথা বলার পর ফোন রেখে যে শান্তি পেতাম, যে সুখ পেতাম, তার সঙ্গে কি কোনো কিছুর তুলনা চলে? আম্মার সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার পর আমার শাশুড়িকে ফোন করতাম ঢাকায়। আমার শ্বশুরের বাসায় ল্যান্ডফোন ছিল। তাই সুবিধা ছিল। যখন ইচ্ছা আমি কথা বলতে পারতাম।

এই যে মনের ইচ্ছাটুকু পূরণ হতো, এতে অন্য রকম এক শান্তি পেতাম। একসময় আম্মা সেলফোন কিনে নেন। সম্ভবত সিটিসেল ছিল। ঠিক মনে নেই। আমি কথা বলতে পারতাম, এতেই শান্তি। আব্বা আক্ষেপ করে বলতেন, ‘বেলি কি আমার মেয়ে? ওর মা-ই তো ওর কাছে সব।’ (আমার ডাকনাম বেলি)।

আম্মা হাসতেন। বলতেন, তোর আব্বার সঙ্গে কথা বল। আমি বুঝতে পারতাম, আব্বা ফান করছেন। কারণ, আমি ফোন রাখার পর আম্মাকে দাঁড়ি-কমাসহ সব জিজ্ঞেস করতেন আমি কী বলেছি, কেমন আছি। আম্মা পরে আমার সঙ্গে কথা হলে বলে দিতেন। আমি চাইলেও আব্বা খুব একটা কথা বলতেন না, হাসতেন। বলতেন, ‘তোর মাকে ফোন করিস, তোর জন্য চিন্তা করে বেশি।’ আমি জানতাম আব্বাও চিন্তা করেন, তবে প্রকাশ ছিল কম। বাবারা এমনই হন। আপনজনদের কাছ থেকে দূরে থেকে বুঝেছি আপনজন কী। বিশেষ করে মা-বাবা।

লেখিকা
লেখিকা

একদিন আমি নিউইয়র্কে বেড়াতে গেলাম। আমার স্বামীর কাজিনের বাসায়। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, এখানে ফোনকার্ড পাওয়া যায়। চাইলে কিনে আনতে পারি। তারপর থেকে ফোনকার্ড ব্যবহার করতাম। অনেক সুবিধা ছিল। তারপর সেলফোন কিনলাম। আস্তে আস্তে যোগাযোগ সহজ হতে লাগল। এরপর প্রায় প্রতিদিন কথা হতো আম্মা-আব্বা ও শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে। অবশ্য আমার শাশুড়ি এক বছর পর আমার এখানে আসেন। ছয় মাসের মতো থেকে চলে যান দেশে। এরপর থেকে প্রায়ই আসা-যাওয়া করতেন। তবে আম্মা কখনো আসেনি আমেরিকায়। বলতেন, ‘তোর আব্বাকে একা ফেলে কীভাবে আসি। এলে দুজন একসঙ্গে আসব। সেই আসা আর কখনো পূরণ হয়নি।’

এখন আমার ফোনের অপেক্ষায় কেউ থাকে না। ফোন করলে ওপাশ থেকে কেউ বলবে না, আজ দেরি করে ফোন করলি? তুই ভালো আছস তো? আমার মায়ের কাছে আমি সেই ছোট রয়ে গিয়েছিলাম। যেখানেই থাকতাম, মনে হতো দেশে ফোন করতে হবে। আম্মা অপেক্ষা করছেন। আম্মা নেই, আমারও ফোন করার তাড়া নেই। আম্মা মারা গেছেন এক বছর হয়ে গেল। ৮ এপ্রিল আম্মার মৃত্যুবার্ষিকী। সময় কত দ্রুত চলে যায়। আম্মা নেই, এই ভাবনাটাই ভাবতে গেলে কেমন এলোমেলো লাগে সবকিছু।

আমরা যারা প্রবাসে থাকি, আমাদের সেলফোনই ভরসা। যতই ব্যস্ত থাকতাম না কেন, দেশে ফোন করতাম। আম্মা সেলফোন সব সময় কাছেই রাখতেন। আর নামাজ পড়ার সময় অন্য কাউকে বলে রাখতেন, আমি যদি ফোন করি, ধরে যেন বলে, তিনি নামাজ পড়ছেন।

আমার মা ধার্মিক ছিলেন। ছিলেন নরম মনের মানুষ। তাঁর কোনো চাহিদা ছিল না। ছিল শুধু সন্তানদের কীভাবে ভালো রাখা যায় আর ভালো রাখা যায় চারপাশের মানুষগুলোকে—এই চিন্তা।

লেখাপড়া জানা মানুষ ছিলেন। পড়তেন গল্পের বই, কবিতার বই। আর অবসর পেলেই আমাকে চিঠি লিখতেন। হাতের নানা রকম কাজ করতেন। মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে বলতাম, মানুষ এত কাজ করতে পারে? কীভাবে করে!

আমার সহজ-সরল মা ছিলেন বয়ে চলা নদীর মতো। তাঁর কোনো চাওয়া ছিল না, অভিযোগ ছিল না, অভিমান ছিল না। আমরা তিন বোন, দুই ভাই। আমি সবার ছোট। আমাদের সুখটাই ছিল তাঁর সুখ। আমাদের কার কী পছন্দ-অপছন্দ তাঁর মুখস্থ, অন্তত ছিল। যতবার বাংলাদেশে গিয়েছি, জেএফকে এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা এয়ারপোর্ট পৌঁছা পর্যন্ত আমার মা নামাজে থাকতেন, যেন নিরাপদে পৌঁছাতে পারি। আর সেলফোনটা সঙ্গে রাখতেন সব সময় যেন আমি ফোন করে পাই। এখন সেলফোন আছে। শুধু মানুষটাই নেই। কীভাবে এক বছর পার হলো, বুঝতেই পারলাম না।

আম্মা, ভালো থেকো ওপারে। আসলে মায়েরা কখনো হারান না, তাঁরা সন্তানের পাশে ছায়া হয়ে থাকেন।

আমার চলার পথে আমার মা-ও ছায়া হয়ে আছেন। ভালো থাকুন সব মা, এই কামনা করি।