তালেব আলীর অনুশোচনা-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তালেব আলী সম্বন্ধীকে সালাম দিল। সম্বন্ধী বাড়িতে এসেছে। কী খাবে না খাবে, এই নিয়ে তালেব হইচই শুরু করে দিল। বউকে বলল, গুলেজান ভাইজানকে খাইতে দিছ নাকি খালি মুখে শুধু গল্পই করতেছ? তালেব আরও বলল, পুকুরে বড় মাছ ধরতে দেখি জাইলারে খবর দিই। সম্বন্ধীকে বড় রুই খাওয়াতে হবে।

গুলেজানের ভাই তালেবের ওপর কড়া নজর রেখেছে। সে ইতিমধ্যে খুঁত ধরার চেষ্টা করছে। তালেব তাকে দুবার জিজ্ঞাসা করল, সে কখন এসেছে। সম্বন্ধী তালেবকে বলেই ফেলল, তালেব তুমি ঠিক আছ তো? এই নিয়ে তুমি আমাকে দুবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে। সালামও দিয়েছ কয়েকবার। তোমার শরীর ভালো তো?

তালেব বলল, তাই নাকি ভাইজান, আমি আসলে...। তালেব সম্বন্ধীকে বেশ ভয় পায়। তাই কী বলতে কী বলে ফেলে! তালেব বলল, ভাইজান, মুসলমানদের একবার কেন বারবার সালাম দিলেও কোনো ক্ষতি নাই।

সম্বন্ধী তালেবের কথায় গলায় কাশি দিয়ে বলল, না মানে, বলছিলাম কী, তোমার শরীর ভালো তো?

: জি, আমি ভালো আছি ভাইজান!

এর মধ্যে মেয়ে গুলফানের ডাক—বাবা, মা ডাকতেছে। মামারে নিয়া খাইতে আসো।

গুলেজান তার ভাই আসা উপলক্ষে অনেক কিছু রান্নাবান্না করেছে। জেলে ডেকে পুকুর থেকে বড় মাছ ধরিয়েছে, আবার সঙ্গে গুঁড়া মাছও। তালেব খেতে বসে বউকে বলল, বাহ গুলেজান, এত দিনে একখান বুদ্ধিমানের মতন কাম করছ। ভাইজানের উপলক্ষে খাওয়ার ব্যবস্থা খুব ভালো করছ। তাই তার সঙ্গে আমরাও নানান পদের মাছ খাইতে পারলাম। তোমার যে আজকাল কী হইছে? রান্নাবান্নায় মন নাই!

: বাবা, বুদ্ধিমান না, কও বুদ্ধিমতী?

: হ তাই তো রে মা, আসলে আমার ভুল হইছে। তোর মা আসলে বুদ্ধিমতী।

: গুলেজান হারাধন কাকা আর পরান চাচা তাগো বাড়ি মাছ পাঠাইছ?

: হ, পাঠাইছি।

: বাবা, আমি দাদাগো বাড়ি গিয়া মাছ দিয়া আইছি। হারাধন দাদা তোমারে যাইতে কইছে।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে তালেব বেড়িয়ে গেল তার কাজে। গুলেজানের ভাই তার বোনকে জিজ্ঞাসা করল, এই হারাধন আর পরান এরা কারা?

: ভাইজান এরা হইতেছে, আমার শ্বশুরের ছোটবেলার বন্ধু। খুব ভালো মানুষ। গুলফানের বাপরে নিজের ছেলের মতন ভালোবাসে।

: নিজের বাপ মরেছে কোন কালে? ওর বাপ এখন ওই দুইজনের ঘাড়ে ভর করছে, যত্ত সব!

: ভাইজান, গুলফানের বাপের কানে গেলে কেলেঙ্কারি হয়া যাবি।

: গুলেজান তুই চুপ কর। এই দুইজনের পরামর্শেই তালেবের আজ এই দশা। নইলে ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র এভাবে মানুষকে বিলিয়ে দেয়? তুই কোনো চিন্তা করিস না। যা করার আমি করব। ওর ভিমরতি ছুটাইয়া দিয়া তারপর আমি এখান থিকা যাব।

ভাইকে ডেকে গুলেজানের সমস্যা মনে হচ্ছে আরও বাড়বে বই কমবে না। এখন গুলেজানের চিন্তা কমার চেয়ে আরও দুই গুণ বেড়ে গেল! এর আগের বারও তার ভাইজান এসে গুলেজানের সংসারে অনেক অশান্তি বাড়িয়েছিল। এবার তার ভাইজান আবার কোন অশান্তি বাধায় কে জানে? গুলেজান ভয়ে অস্থির।

তালেব তার সম্বন্ধীর মতিগতি নিয়ে খুব শঙ্কিত। সম্বন্ধীর কাজই হচ্ছে বোনকে দেখতে এসে নয়ছয় বোঝানো। এবার আবার কোন মতলবে এসেছে, কে জানে! তালেব তার বউ গুলেজানের মতন ভালো মেয়ে জীবনে কম দেখেছে। তালেব তার সম্বন্ধী এলে খুব ভয়ে ভয়ে থাকে আর দিন গুনতে থাকে কবে সে বাড়ি থেকে যাবে!

: গুলফান এদিকে আয় তো মা?

: বাবা, আমারে ডাকছ?

: হারে মা, তোর মামার মতিগতি আমার খুব একটা ভালো ঠেকতেছে না। সে তো খালি খালি এই খানে আসার মানুষ না! এইবার আবার কোন মতলবে আসছে আল্লাহই জানেন।

: বাবা, আমার মনে হয়, মা মামারে খবর দিয়া আনছে। মা তুমারে নিয়া একটু চিন্তার মধ্যে দিয়া দিন কাটাইতেছে। তুমি ঘরের সব সুন্দর সুন্দর জিনিসপত্র ফালাইয়া দিছ! বাবা, আসলেই তো এই যে আগের দিনের খাট–পালং এগুলো কত মূল্যবান। আর তুমি কি না, সেই সব মানুষরে এমনি এমনি বিলায়া দিছ। এই কারণেই মায়ের ধারণা তোমার মাথা খারাপ হয়া যাইতেছে।

: তোর মামা কি ডাক্তার নাকি কবিরাজ? যে তারে খবর দিয়ে আনা লাগবি? সেই কারণেই তো তোর মামা আমার দিকে শকুনি চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেছে। গুলফান মা, তুই বল, তোর মায়ের এই কাজটা করা কি ঠিক হইছে? আর আমারে দেইখা তোর কি মনে হয় তোর বাবার মাথা খারাপ? আমার ওপর তোমাগের বিশ্বাস নাই? আমি যা করতেছি সিডা আমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। সিডা আমি কারও সাথে আলাপ করতে চাই না। আমার সমস্যা আমি আমার পরিবারকে দিবার চাই না।

: বাবা আমি কোনো দিনও মনে করি না আমার বাবার মাথা খারাপ। যে যাই ভাবুক না ক্যান, আমি তো আমার বাবাকে চিনি।

লেখিকা
লেখিকা

তালেব তার বউ গুলেজানের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, গুলেজান, তোমার শরীর ভালো তো? নাকি মাথায় তেল পানি বসায়ে দেব!

: ক্যান, আমার কী হইছে যে আপনে আমার মাথায় তেল পানি বসাবেন?

: গুলেজান কী হয় নাই সেডাই আমারে বলো। তুমি যে সমস্ত কাম কাজ করতেছ, তাতে আমি সত্যি সত্যি পাগল হয়া যাব।

: হায় আল্লাহ আমি আবার কী করলাম?

: কী করোনি শুনি? আমার মাথা খারাপ হয়া যাইতেছে বলে, তুমি তোমার ওই মতলববাজ ভাইরে খবর দিয়া আনো নাই? তোমার মনে নাই গেলবার উনি সংসারে কী অশান্তি বাধাইছিল! আর তুমি হইতেছ একজন সহজসরল মানুষ। যে যা বোঝায়, তুমি তাই বিশ্বাস করো!

: গুলেজান কাঁদতে শুরু করল আর স্বামীকে বলল, আফনে এত বড় কথা আমারে কইতে পারলেন? আমার ভাই কি সব সময় এ বাড়িতে আইসা পইড়া থাকে!

: শোনো গুলেজান, তোমার ভাইরে তো আমি আসতে না করি নাই। মুরব্বি মানুষ, মুরব্বি মানুষের মতো থাকলে ভালো হয়। উনি যতবার আসেন ততবারই কোনো না কোনো ভেজাল বাধায়! আর তোমারে উল্টাসিধা বোঝাবে এই তো তার একমাত্র কাজ।

গুলেজান স্বামীর ওপর রাগ হয়ে বলল, আস্তে বলেন ভাইজান শুনতে পাবি। আর আপনে যে কাম গুলান করতেছেন সেই গুলান খুব ভালো! আপনে ভালো কী মন্দ সিডা পরের কথা। আপনের মেয়ে বড় হইতেছে। মেয়েরে বিয়ে দিতে পারবেন?

: শোনো গুলেজান, আমার মেয়ের আজকে যদি বিয়ে দিবার চাই দেখবা, পুলা পুলার মা বাপেগের লাইন লাইগা যাবি! যাও আমার এখন এই সব প্যাঁচাল ভালো লাগতেছে না। আমারে একটু একলা থাকতি দেও।

তালেব আবার আকাশকুসুম ভাবতে শুরু করল। সে তার বাপের শেষ জীবনের পরিণতির কথা একেবারে ভুলতে পারে না। তালেব চায় না সেই সব অভিশাপ তার এবং তার পরিবারের ওপর আসুক। তাই যে যাই বলুক না কেন, সে যা করার তাই করবে। যে বাড়িত এখন তালেব বাস করছে এটা তার বাপের আমলের নাকি দাদার আমলের, সেটা তাকে খুঁজে বাহির করতেই হবে। এখন একমাত্র বাড়িটাই তাকে পীড়া দিচ্ছে। কত রাত যে তার না ঘুমিয়ে কাটাতে হচ্ছে সেটা শুধু সে নিজেই জানে। এই সব চিন্তাভাবনা করতে করতে সে দিনের রাতটাও গেল। ভোরের আজানের সুর ভেসে এল। তালেব উঠে নামাজ আদায় করে বারান্দায় গিয়ে বসল। মনে মনে ভাবল, কালকে বউকে অতগুলো কথা শোনানো তার উচিত হয়নি! তালেব বউকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। তাই তাকে খুশি করবার জন্য আবার জেলে ডেকেছে। সম্বন্ধীর জন্য পুকুর থেকে মাছ ধরাল! মাছ এনে বউকে দিয়ে বলল, এই নাও, ভাইজানের জন্য ভালো করে রান্না করো? গুলেজান, তোমার মনডা কি খারাপ? আসলে কালকে ওই কথাগুলো তোমারে আমি কইতে চাই নাই। আমার ভুল হইছে।

স্বামীর কথা শুনে গুলেজানের মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, আমি জানি আপনে যা কইছেন সিডা মন থিকা কন নাই। আপনে তো জানেন, ভাইজানের স্বভাবটা একটু ওই রকমি।

তালেব গেল নিরেনদের বাড়ি। নিরেন তার ছোটবেলার বন্ধু। একসময় এলাকায় এদের অনেক জমিজমা ছিল। খুব নামডাক ছিল তাদের। এখন তাদের আর কিছুই নাই। তারা এখন মানুষের জমি চাষাবাদ করে খায়?

: কিরে নিরেন, কী খবর? দেখাসাক্ষাৎ করস না, ব্যাপার কী? আছস কেমন?

: এই তো ভালো আছি।

: দেইখা তো মনে হয় না ভালো আছস! কইছিলাম কী আমাগো তো জমির অভাব নাই। তুই এক কাম কর, আমাগের বাড়ির উত্তর দিকে যে চার বিঘা জমি আছে, ওই জমিডা তুই চাষাবাদ কইরা খা। একসময় তো ওই জমি তোগেরি ছিল। আমার বাপ নাকি তোর বাবার কাছ থিক্যা কিনছিল।

তালেবের এই প্রস্তাব শুনে নিরেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মনে মনে বলল, তোর বাপ যে আমাদের ওই জমিটুকু কী করে নিয়েছিল, সেটা তো আমার অজানা না।

সঙ্গে সঙ্গে নিরেন বলে উঠল, নারে, তা আমি করতে পারব না। গরিব হইতে পারি, কিন্তু মান খোয়াতে পারব না। যদি বরগা চষতে কস সিডা চিন্তাভাবনা কইরে দেখা যায়।

তালেব বলল, সিডা আমি জানি, তুই এমনি এমনে নিবি না। তয়, তাই হবি যা বরগাই চষ। তোর যা মন চায় তাই আমারে দিস।

এরপর তালেব গেল হারাধন কাকার বাড়ি। সেখানে গিয়ে তার বাপ যে নিরেনদের জমি কিনেছিল, সেই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে চায়।

: হারাধন কাকা, আমার বাপ কি নিরেনের বাবার কাছে থিকা জমিডা সত্যই কিনছিল?

: আমি যা জানি সেইটুকু তোমারে কইতে পারব। শুনেছি নিরেনের বাবা মেয়ে বিয়ে দিবার জন্য টাকার ব্যবস্থা না করতি পেরে তখন তোমার বাবার কাছে কত টাকায় জানি জমিডা বন্ধক রাখছিল। তারপর নিরেনের বাবা আর টাকা ফিরত দিতে পারেনি। তারপর তোমার বাবা অল্পবিস্তর টাকা–পয়সা দিয়ে দলিল কইরা নেয়। এই কথা ক্যান জিজ্ঞাসা করতেছ? তালেব তুমি ভালো আছ তো বাবা? তোমার কাকিমা কইল বউমা নাকি আসছিল। কী জানি সব শুনলাম সবকিছু ঠিক আছে তো? বাবা তালেব তোমার যদি কোনো সমস্যা থাকে তো আমারে কইতে পার। ইদানীং তোমার মনডাও জানি কেমন থাকে।

: কাকা, না তেমন কোনো সমস্যা না। কাকা আমি একখান কথা জানবার চাই। এখন যে বাড়িতে আমি থাকি, এই বাড়ি বাবা কার কাছে থিকা কিনছিল? আমি আগে এইডা জানবার চাই। তারপর আমি আপনারে সবকিছু বলব।

: তোমার ওই বাড়িটি তোমার বাবার না। ওটা তোমার দাদার আমলের বাড়ি। পরে তোমার বাবা বাড়িটি অনেক মেরামত করেছেন। কেন বাবা, এই সব প্রশ্ন খুঁজে বেড়াতেছ কেন? বউমা তোমার কাকিমার কাছে কী যেন বইলা গেল! তুমি নাকি ঘরের সমস্ত জিনিসপত্র সকলকে বিলায়া দিয়ে নতুন কইরা কিনছ। তালেব বাবা, আসলে তোমার কী হইছে আমারে কও?

: কাকা আসলে আপনাদের বউমা না বুঝেই অনেক কিছু চিন্তা কইরা ফেলে! আজকালকার যুগে পুরানা জিনিসপত্র বদলায়া মানুষ তো নতুন জিনিস কিনে। আমিও তাই করছি, এতে দোষের কী হইল? সেইডাই তো আমি বুঝলাম না?

তালেব হাঁপ ছেড়ে বাঁচল বাড়িটি তার বাপের না। তার দাদার আমলের বাড়ি। নইলে এত শখের বাড়িটি ছেড়ে তাকে বেরিয়ে যেতে হতো! হারাধন কাকা আজকে তাকে বড় এক বিপদ থেকে রক্ষা করলেন।

গুলেজানের ভাই মোবারককে ডেকে বলল, ওই ব্যাটা মোবারক ওই খানে কী করস? তোর কোনো কামকাজ নাই? খালি দেখি এদিকে ওদিকে ফুরুত ফারুত, মতলব খানা কী?

: মামা কিছুই করতিছি না। মামা আপনের কিছু লাগব?

: তালেবের কী কোনো আক্কেল পছন্দ আছে? বাড়িঘরের প্রতি কোনো নজর নাই। সে আছে খালি দানদক্ষিণায় ব্যস্ত, যত সব।

: মামা এইমাত্র গরুর খাবার দিয়া পুকুর ঘাটে একটু বইছি।

: বাড়ির মালিক হইছে হাফ পাগল। সেই সুযোগে পুকুর ঘাটে বইসা পরিষ্কার বাতাস খাইবা, নাতো কী করবা? ফুল পাগল হইলে তো তোমাগের জন্য আরও ভালো। আর আমার বোন হইতেছে গিয়া একটা বোকা।

গুলেজান গরম চা বানিয়ে মেয়ে গুলফানকে পাঠাল তার মামাকে ডেকে আনতে।

: মামা, মা আপনারে ডাকে, চা খাইতে।

: যা আসতেছি, তোর বাপ বাড়ি ফিরছে?

: না মামা, তয় খুব শীঘ্রই ফিরবে। মামা, তাড়াতাড়ি আসেন, চা ঠান্ডা হয়া গেল। মামা দেখেন, কইতে কইতে বাবা আইসা হাজির। চলেন, এখন এক সাথে চা খাওয়া যাবি।

তালেব তার বউকে বলল, গুলেজান, কাকিমার কাছে কী বলছ?

: কী কইছি, আপনে যা করতেছেন তাই কইছি।

: শোনো গুলেজান বেগম ঘরের কথা বাইরে বলা কি ঠিক?

: আর আপনে যা করতেছেন, এই সবকিছু কি ঠিক?

তালেবের ইদানীংকালের কাজকর্ম মোটামুটি গ্রামের সকলেই জানে। সেই খবর শুনে তার বাপের ছোটবেলার বন্ধু পরান চাচা এলেন তালেবের খবর জানতে।

গুলেজানের ভাই বেশ কয়েক দিন শুধু তালেবের ভাবচক্কর দেখেই যাচ্ছে। এবার মুখ না খুলে সে থাকতে পারছে না। তাই সে তালেবকে জিজ্ঞাসা করল, তালেব, হঠাৎ তোমর কী হইল? তুমি এই যে মানুষরে দানখয়রাত করে বেড়াইতেছ। তুমি কি কোনো স্বপ্নে দেখছ?

: না ভাইজান, সে রকম কিছু না। আমি আসলে...আমি খালি এইটুকু কইবার চাই আল্লাহ তো আমারে কম দেয়নি। তাই মানুষরে দিয়ে থুইয়ে খাইলে তো কোনো অসুবিধা নাই।

: তুমি যা করতেছ এই রকম চলতে থাকলি ফুরাইতে আর বেশি দিন লাগবি না! আর থাকলেই বিলাইতে হবি, এই রকমের মানুষ আমি জীবনে দেখি নাই।

গুলেজান এসে তার ভাইকে বলল, চলেন ভাইজান, এই সমস্ত কথা এখন থাক। খাইতে আসেন, আমি পড়ছি যত জালায়! মেয়েকে ডেকে বলল, খাবারদাবার বেড়ে দিয়ে তাকে সাহায্য করতে।

: মা, আমি আসতেছি। মামা তাড়াতাড়ি চলেন, খাবেন। আপনের বোনের আবার হুট কইরা চিন্তাভাবনার তাপমাত্রা ওপরে উইঠা যায়। আবার তার দমও কথায় কথায় বন্ধ হয়া আসে।

: শোনো ভাগনি, তোমার বাবা যে কাণ্ডকারখানা করতেছে, তাতে আমার বোনের দম যে এখনো আছে সেটাই বড় কথা!

: মামা মানুষরে দিলি ফুরায় না আরও উন্নতি হয়। মাও তো মানুষরে কত কিছু দেয় আর বাবা দিলে সমস্যা কী?

মামা মনে মনে বলতে লাগল, যেমনি বাপ তার তেমনি মেয়ে। তালেবের নিজের করা হলে দরদটা বুঝত। বাপে অঢেল রেখে গেছে তো। তাই ওত ফুটানি। বাড়িতে এসে তার বোনকে বলল, তালেবের সাথে সাথে তোর মেয়েরও দেখছি, একি রোগে ধরেছে! অফুরন্ত আছে তো তাই টের পাচ্ছে না। তাওই সাহেব কত কষ্ট করে সম্পত্তি এই জমিজমা করে গেছেন।

: ভাইজান, খালি আমার শ্বশুর করবেন কেন? গুলফানের বাবা নিজেও কামাই করে কিনেছে। মাঝখান থেকে গুলফান বলে উঠল, মা, দাদা নাকি মানুষের সাথে কেরামতি কইরা জমিজমা বানাইছিল?

: দেখ গুলেজান, তোর মেয়ের কথা শুন!

: কী রে গুলফান? তোর সাহস তো কম না! এত আজেবাজে কথা তুই পাশ কোনখানে? দিনে দিনে বড় হইতেছ আর বেআক্কেল হইতেছ। নিজের দাদা সম্পর্কে এই সমস্ত কথা কেও বলে?

: মা, আমি খারাপ কী কইছি? কেরামতি কি কোনো খারাপ কথা নাকি?

: গুলেজান, তোমার মেয়ের এইবার যা দেইখা গেলাম, আবার সামনের বার এসে কী দেখব আল্লাহই জানেন!

তালেব গেল হারাধন কাকার বাড়ি। কারণ হারাধন কাকা কী কারণে যেন তাকে খবর পাঠিয়েছেন।

: কাকা আদাব, আপনার শরীর ভালো তো? আমি আরও ভয় পাইলাম যে আপনার আবার কিছু হইল নাকি?

: না বাবা, তেমন কিছু না। নিমেশের মা, তালেব আইছে, ওরে কিছু চা–নাশতা দেও? বাবা তুমি নিরেনগের ওই জমিডা চাষাবাদ করবার দিয়ে ওগেরে বাচায়া দিছ, নইলে না খায়া মরত!

: কাকা, আমি আপনার কাছে কোনো কিছুই গোপন করি নাই। আপনে আমার আব্বার সব কথাই জানেন। এই সমস্ত জমিজমা আমার ভোগ করতে দম বন্ধ হয়া আসে। মানুষের দীর্ঘশ্বাসে আমার পরিবার তলায়া যাক, সেইডা আমি চাই না। কাকা, রাতে আমার ঘুম হয় না। জমিজমা যদি মানুষরে দিতে যাই, সকলে আমারে পাগল বলবে। তাই কিছু করতে পারতেছি না। এই পাপ থিকা মুক্তি পাইতে কয়েক বংশের মেহনতি লাগবি। অকাম একজন করলি সেটা বংশপরম্পরায় মাশুল দিতে হয়। তয় আমি মনে মনে ঠিক করছি, যতটুকু করবার পারি আমি কইরাই যাব। কাকা, আমার হাতে তো একেবারে সময় নাই। বয়স হয়া গেল ৫৫ বছর!

: বুঝছি, এই যে তুমি নিরেনের পরিবাররে বাঁচাইছ, এডাও তো অনেক বড় প্রায়শ্চিত্ত। তোমার বাবার আত্মাডাও কিছুডা শান্তি হবি। আর তোমার বাবা তার কর্মের ফল দুনিয়া থিকাই নিয়া গেছে। মরার আগে কত কষ্ট কইরা মরছে। কত কম বয়সে তোমার বাবা মারা গেলেন। তার এই সম্পত্তি তিনি শান্তি মতন ভোগ করতে পারলেন না। তুমি অযথাই চিন্তা কইর না। তার কর্মের দায়ভার তিনি সাথে করে নিয়ে গেছেন।

: কাকা, আমার দাদা এত ভালো মানুষ ছিল, তার ছেলে হইয়া আমার বাপ রাজাকার হইল কী কইরা? আমি ভাবতেও পারি না। তিনি মারা গেছেন আর আমি সেই বোঝা বহন করতেছি।

: তালেব, তুমি শান্ত হও। গুলেজানের মতন একটা বউ, গুলফানের মতন একটি মেয়ে তোমার ঘরে। সেই ঘরে কোনো দিন কালো ছায়া লাগতেই পারে না। আর শোনো, তোমার মেয়ে বড় হইতেছে। এই সব কথা নতুন কইরা না তুলাই ভালো। এতে করে গুলফানের বিয়ে দিতে খুব কষ্ট হবি।

: কাকা আপনি আর পরান কাকার মতন মানুষকে আমি বাবা হিসাবে পাইলাম না ক্যান!

: শোনো তালেব, তুমিও আমার ছেলে। নিমেশ আর তুমি আমার কাছে একই রকম। আমি কোনো দিন তোমাক আর নিমেশরে দুই চোখে দেখি নাই। শহরে কবে চইলা যাইতাম। এখানে পড়ে রইছি, খালি তোমার ভরসায়। আর শোন, তোমার কাম তুমি কইরা যাও। হিসাবের খাতা তো তোমার হাতেও নাই, আমার হাতেও নাই। ওপরে যিনি বসে আছেন, তিনিই সব লিখতেছেন। আর বাড়িডা তোমার বাবার না। ওডা তোমার দাদার। তোমার বাবা কোনো দিন কোনোখানে কোনো একটা ভালো কাম করছিল। তাই ভগবান তারে তোমার মতন একটা ছেলে তার ঘরে জন্ম দিছিল। তোমার কর্মে তার পাপও অনেক মুক্তি হবি। বাড়ি যাও আর কোনো চিন্তাভাবনা কইরা পরিবারে অশান্তি বাড়াইয়ো না।

: কাকা অনেক বড় ফাঁপর থিকা বাঁচলাম। ভাবছিলাম বাড়ি ছাইড়া অন্যদিকে গিয়া বাড়ি বানাব।

: এই যে তুমি তোমার বউ, তোমার মেয়ে, মানুষের বিপদ দেখলে দৌড়ায়া আসো, এইডাই বা কম কিসের। ওপর আল্লাহ তোমাগো অনেক দিছে। মানুষের বিপদাপদে কিছু ব্যয় করবা। দেখবা মনডা কত শান্তি হয়। নিমেশ তো সময় পায় না, এই বুড়া মা–বাবার খবর নিতে। তুমি আর তোমার পরিবার, আমার আর পরানের দুইবেলা খোঁজখবর রাখো। আমাদের আশীর্বাদ তোমার আর তোমার পরিবারের ওপর সব সময় আছে।

এর মধ্যে পরান এল তার বন্ধু হারাধনের বাড়ি। সে তালেবের সব কথা শুনে তাদের বাড়ি গিয়েছিল। তালেব বাড়ি না থাকাতে এল বন্ধুর বাড়ি।

: আরে পরান, আইস তুমি কেমন আছ?

: আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? নিমেশের খবর কি?

: আমি তালেবদের বাড়ি থেকে আসলাম। গুলেজান বলল সে নাকি তোমার বাড়ির দিকে গেছে। তাই ভাবলাম ভালোই হলো তালেব আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে! কী তালেব, তুমি নাকি, কী সব শুরু করছ?

: শোন পরান, তুমি তালেবরে বোঝাও। তালেব তার বাবার কর্মের প্রায়চিত্ত করতে চায়। সেই চিন্তায় তার ঘুম হারাম।

: শোনো তালেব, আমি হারাধন আর তোমার বাবা ছিলাম ছোটবেলার বন্ধু। দেখ, আমরা এখনো বেঁচে আছি আর ওপরওয়ালা আমাদের অনেক ভালো রেখেছেন। অন্যদিকে দেখ, তোমার বাবার কী অবস্থা হলো! তোমার মা উনারে ছেড়ে সেই কত আগেই চলে গেছেন। তোমার বাবার জীবনে কোনো দিন আমি শান্তি দেখিনি। তারপর তো তার শেষ জীবনটা কারও অজানা না। তার কর্মের ফল তিনি এই দুনিয়া থেকে নিজেই পেয়ে গেছেন। তার সন্তান হয়ে তুমি তার মতন হওনি। তোমার মনটা হইছে তোমার আম্মা, মানে আমাদের শ্রদ্ধেয় ভাবির মতন। তালেব, তোমাকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি।

: চাচা, দোয়া করবেন আমি যেন ভালো কাজ করে দুনিয়া থিকা যাইতে পারি! আমি অনেক ভাগ্যবান, আপনেগের মতন ভালো মানুষ আমার মাথার ওপরে ছায়া হয়া দাঁড়ায়ে আছেন। চাচা, আমি দুনিয়া থিকা যাওয়ার আগে অনেক কিছু করবার চাই।

হারাধন কাকার বাড়ি থেকে তালেব বেরিয়ে পড়ল বাড়ির উদ্দেশে। দূর থেকে গুলফানের ডাক শোনা গেল, বাবা। তালেব দেখতে পেল দূরে গুলেজান দাঁড়িয়ে। স্বামীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। তালেব ধীরে ধীরে বউ গুলেজানের কাছে যেতেই গুলেজান কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে গুলেজান স্বামীকে বলল, আমি কিছুই চাই না। আপনি সবকিছু বিলায়ে দেন, ফেলে দেন। আমি শুধু আপনাকে চাই। পুরোনো সমস্ত কিছু আমি ফেলে দিয়েছি। আমি সব শুনছি। আপনার যদি মনে হয়, সবকিছু ফেলে দিয়ে গাছতলায় থাকতে হবে, তাতেও আমি খুশি। আমি আমার মেয়ে আর আপনাকে নিয়ে শান্তিতে বাঁচতে চাই। তালেব বউ গুলেজান আর মেয়ে গুলফানকে জড়িয়ে ধরল। (শেষ)

আগের অংশ পড়তে ক্লিক করুন: 

ডিনা চৌধুরী: মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।