আমার ঘর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সিডনির ক্যাম্বেলটাউন হসপিটাল। রিসেপশনের সামনে সোফায় আনুমানিক ২৫-২৬ বছর বয়সের একটি মেয়ে বসে আছে। মেয়েটি ইতালিয়ান বলেই মনে হলো। তমাকে সঙ্গে নিয়ে রেবা এসেছিল তার অসুস্থ খালাম্মার সঙ্গে দেখা করতে। বের হওয়ার সময় মেয়েটির প্রতি দৃষ্টি পড়তেই রেবা বলে, আরে, জেরিন এখানে বসে আছে যে! অনেক দিন দেখা হয় না। তমা, চল দেখে আসি।

কৌতূহলী তমা বলে, মেয়েটা কে?

: আমার বান্ধবী। আচ্ছা পরে বলব। এখন চুপ থাক। হয়তো ওর কোনো সমস্যা চলছে।

মেয়েটির কাছে গিয়ে রেবা বলে, জেরিন, তুমি এখানে?

: হুঁ, ডাক্তারের কাছে এসেছি। ইনসমনিয়ায় ভুগছি। ঘুম হয় না।

: কেন, কী হয়েছে?

দৃষ্টি নত করে জেরিন বলে, তুমিই যদি জিজ্ঞেস করো আমার কী হয়েছে, তবে বুঝবে আর কে।

বলেই জেরিন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ পরই আবার তমার প্রতি ইঙ্গিত করে রেবাকে বলে, তোমার সঙ্গে উনি কে? তোমার বান্ধবী?

: হ্যাঁ। সোহেলের ওয়াইফ। বান্ধবী তো বটেই।

চোখ দুটি বড় বড় করে জেরিন বলে, সোহেলের ওয়াইফ! ও আচ্ছা।

বলেই তমার প্রতি কয়েক সেকেন্ড মারাত্মক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। একসময় স্থির চোখ দুটো আড়াল করে নীরবে সোফা ছেড়ে উঠে ভেতরে চলে যায় জেরিন।

কী এক অদৃশ্য ইঙ্গিতে তমার বুকটা কেঁপে ওঠে।

দুই মাস হতে চলেছে তমা স্পাউস ভিসায় সিডনিতে এসেছে। পরবাসে অপরিচিতের ধোঁয়াশা। দেশের কথা মনে পড়ে বারবার। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। স্বামী সোহেল মহাব্যস্ত। পাঁচ মিনিট সময়ও তার নেই। দুটো কথা বলা—বয়েই গেছে। ওর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়া, একটা দেশ জয় করাও মনে হয় এর চেয়ে অনেক সহজ। এত আশার এই অস্ট্রেলিয়া। দেশে থাকতে এই অস্ট্রেলিয়ার কথা ভাবতেই স্বপ্নের শিহরণে শরীরটা কেঁপে উঠত। তবু তার মনটা আশা খুঁজে ফেরে। সেদিন শপিং করার সময় দেখতে বাঙালি মনে হওয়ায় তমাই প্রথম এগিয়ে এসে কথা বলে রেবার সঙ্গে। এভাবেই পরিচয় এগিয়ে চলে। আজ জেরিনের কথাবার্তায় কী এক সংকেত পেয়ে রেবাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না তমার।

নীরবও থাকতে পারল না। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে পার্কে এসে অতি সংকোচে তমা রেবাকে জিজ্ঞেস করে, মেয়েটা কে?

রেবা হঠাৎ আঁতকে উঠে বলে, হাতজোড় করে অনুরোধ করছি, তুমি জানতে চেয়ো না, তমা। অনেক দিন পর দেখা। কেমন সুন্দর ছিল মেয়েটি। ওর এ অবস্থা দেখে নিজেও স্থির থাকতে পারছিলাম না। এই আরকি।

: না। আমাকে জানতে হবে।

: অল্প দিন হয় অস্ট্রেলিয়ায় এসেছ। তোমার মন এখনো এ দেশের অনেক কিছুর সঙ্গেই মানিয়ে চলতে প্রস্তুত নয়। এখানে এমন কিছু বিষয় আছে, যা দেশে ঘটলে স্বামী-স্ত্রীতে খুনোখুনি বেধে যেত। বাংলাদেশের ধ্যানধারণায় আটকে থাকলে এখানে চলে না।

: ও আচ্ছা। তোমার আইডিয়াটা মন্দ না।

রেবা নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে, স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই দুজনের দোষ-গুণ সব ব্লেন্ড করে নিজের সুখশান্তি নিজেই তৈরি করে নিতে হয়। এখানে তোমার শান্তি যেমন তোমার, নিজেদের মধ্যে অশান্তি তৈরি হলে তা-ও তোমাকেই ভুগতে হবে। কেউ শেয়ার করতে আসবে না। আরও কিছুদিন যাকো। আস্তে আস্তে সব টের পাবে।

: তার মানে বিবাহপ্রথাটা এখানে বাংলাদেশের নিয়ম মেনে চলে না। ঘাস–ছাওয়া মাঠে মুক্ত ষাঁড়। তাই না?

: কিছুটা ওই রকমই। কখনোবা দুদিকেই ওই রকম। আস্তে আস্তে বুঝতে পারবে।

কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে তমা বলে, বোঝাবুঝির কী আছে। বাংলাদেশেও এসব আছে। নিজের দেশ হলেও আমরা আর কতটুকুইবা জানি। তবে হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত আছি। ঘটনা বলো।

: না। ক্ষমা করো। আমি পারব না। প্লিজ। চ্যাপ্টারটা ক্লোজ করো।

নিজেকে সংযত করে তমা মনে মনে বলে, তোমার কি ধারণা, তুমি না বললে বিষয়টা আমি জানব না? মেয়েটা আমার দিকে এভাবে তাকাল কেন?

ঘটনা সেদিনের মতো ওখানেই চাপা পড়ে রইল।

তারপর প্রায় তিন মাস কেটে গেছে। হঠাৎ করেই সোহেল এক রাতে আর বাসায় ফেরেনি। তমা বেশ কয়েকবার ফোন করলেও কোনো রেসপন্স নেই। রাত দুটার দিকে সোহেল এসএমএস পাঠায়। সকাল আটটায় সে বাসায় ফিরবে।

পরদিন সকালে সোহেল বাসায় আসে। একটা লম্বা ঘুম দিয়ে বেলা তিনটায় ঘুম থেকে ওঠে। দেখতে পায় তমা তার পাশেই বসে আছে।

তমা সোহেলের প্রতি স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেও সোহেলের চোখ বড় অস্থির। সময় ও পরিবেশ থেকে এ কয় দিনে যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে তমার। কারও অভিজ্ঞতা ধার করে আজ আর বলতে হবে না এটা কালো আর এটা সাদা। তার চোখে এখন বিপুল শক্তি। আজ মনে হচ্ছে সোহেল আর তমার বাস্তবতার মাঝে ফারাক অতি সামান্যই।

: ঘুম হলো?

: হ্যাঁ, হয়েছে।

: হাসপাতালে আবার কখন যাবে?

: এই একটু পরই।

: জেরিনের শরীর এখন কেমন?

: ভালো না। বাঁচবে বলে মনে হয় না। আমাকে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক করতে গিয়ে মেয়েটা নিজেই শেষ হয়ে গেছে।

: ও তাই?

মনের অজান্তেই তমার অতি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলোর সঙ্গে সোহেলের মনটা মিশে যাচ্ছিল। হঠাৎ সচেতন হয়ে সে কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়ে।

: ও হ্যাঁ, তুমি তো জানো না। জেরিন কেউ না। জাস্ট কাগজপত্রে। ইয়ে, কন্ট্রাক্ট আরকি। ওসব কিছু না। তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না।

: হ্যাঁ সোহেল। তোমার এ অস্থিরতা আমি বুঝতে পারছি। স্বামী বলতে যা বোঝায়, আমার কাছে তুমি তা নও। আমিও নিজেকে আর তোমার স্ত্রী ভাবি না।

সোহেল আহত হরিণের মতো এদিক-ওদিক চেয়ে বলে, তমা, কী বলছ এসব!

: না। এত বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। জীবনে খুব কঠিন সময়গুলোয় যে পাশে থাকে, সেই প্রকৃত বন্ধু। তোমার ভেতরে তৈরি হওয়া শূন্যতাটুকু আমি বুঝতে পারছি।

সোহেলের চোখ দুটো ভিজে আসে।

তমা সেদিকে খেয়াল না করে বলে, মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা ওভারসিজ স্টুডেন্টকে মাপার কোনো স্কেল মধ্যবিত্তদের মাঝেই আজও তৈরি হয়নি। ভরসা দেওয়ার কেউ নেই। পেছনে ফিরে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই। অথচ তার অসহায় মনটাকে নিয়ে শিয়াল-কুকুরের মতো কাড়াকাড়ি করার লোক অনেক আছে। তাই তো বলছি, আজ থেকে আমি তোমার স্ত্রী নই। আমি তোমার দুঃসময়ে পাশে থাকা বান্ধবী। ওই সব কাবিন আর কী সব ম্যারেজ সার্টিফিকেট এখনই ছিঁড়ে ফেলে দেব। আমি তোমাকে অধিকার করতে চাই না। আবিষ্কার করতে চাই।

শোয়া থেকে উঠে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে সোহেল বলে, তমা, আমাকে এমন করে বুঝবে স্বপ্নেও ভাবিনি। তমা, আমার অনেক কষ্ট। অনেক কষ্ট। বাংলায় কথা বলার শান্ত, সুন্দর একটা বাঙালি মেয়েকে ভালোবাসার শান্তি আমাকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়। এ দেশে বাধ্য হয়ে ইংলিশ বলি, তবে আপন ঘরে ভালোবাসার ভুবনে বাংলা আর বাঙালিই আমার একমাত্র শান্তি। তাই ভেবেছিলাম, জেরিনের সঙ্গে কখনো দেহ বিনিময় করব না। বলেই সোহেল নীরবে অশ্রুভেজা চোখ দুটি আড়াল করে।

: হ্যাঁ বলো। তুমি নির্ভয়ে বলতে পারো।

নিজেকে স্বাভাবিক করে সোহেল বলে, দেশে আমার একটা ভালোবাসা ছিল। দেশ ছেড়ে আসার সময় তাকে কথা দিয়ে আসতে পারিনি। আমার নিজেরই ভিত্তি নেই। কিসের ভরসায় দেব কথা। সে–ও আর আমার পথ চেয়ে বসে থাকেনি। একদিন ফেসবুকে দেখি বিয়ের সাজে ওর কিছু ঝলমলে ছবি। আপলোড করে ওর এক বান্ধবী। ছবিগুলো দেখে জীবনের প্রতি আমার সব আগ্রহ হারিয়ে যায়। স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথে না হলেও মনে হচ্ছিল যেকোনো সময় হয়তো মরে যাব। হয়তো ড্রাইভ করতে গিয়ে নয়তো রাস্তা পার হতে গিয়ে। কারণ, সেদিন হাঁটতে গিয়েও আমার ভুল হচ্ছিল। ওই রাতে হঠাৎ করেই জেরিন বাসায় আসে একসময়...। তারপর আমার কেমন যেন ভালো লাগতে শুরু করে। হঠাৎ করেই বুকের ভেতর জমা হওয়া কষ্টগুলো মুছে যায়। মনে হলো জগতে বেঁচে থাকাই সবচেয়ে সুন্দর। আজ তোমার সামনে এই সোহেলের বেঁচে থাকা ওই সময়গুলোর কাছে কৃতজ্ঞতায় দায়বদ্ধ।

এক অদ্ভুত হাসিতে তমা বলে, শান্তি, সুন্দর দেহ বিনিময় শান্তির পাশাপাশি দুজনের মধ্যে এক দায়বদ্ধতাও তৈরি করবে। খুবই স্বাভাবিক। তবে একটা বিষয় কি জানো, জীবনে যেকোনো শূন্যতা ঠিক ওই শূন্যতার দাবি মেনেই পূরণ করতে হয়। নইলে বিকৃতিই বাড়ে কেবল। আচ্ছা, একটা কথার জবাব দাও তো, তুমি জীবনে অনেক পরিশ্রম করেছ। অনেক কষ্ট করে এই বিদেশের মাটিতে একটা অবস্থান তৈরি করেছ। বল তো এত সব কেন করেছ?

জড়ানো কণ্ঠে সোহেল বলে, কেন আর করেছি। আজীবন দুঃখ-দারিদ্র্যে জর্জরিত মা-বাবা আর ভাইবোনদের মুখে একটু হাসি ফোটাব বলে।

: নিজের জীবনে শান্তি তৈরি করতে না পারলে মানুষ অন্যকে শান্তি দিতে পারে কি?

মাথা নেড়ে সোহেল বলে, জানি না।

খেয়ালি হাসিতে তমা বলে, তোমার জীবনে শান্তি দরকার না?

সোহেল রহস্যময়ভাবে নীরব। কী যেন ভাবছে।

: শোনো, শান্তি পেতে হলে বিক্ষিপ্ত মনটাকে ঘরে ফেরাতে হয়। এই দেখ, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ।

এ পর্যায়ে তমা সোহেলের প্রতি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চেয়ে আছে সোহেল তমার প্রতিও। এভাবে একসময় দুজনেরই সর্বাঙ্গে অদম্য নেশা-ধরা শিহরণ জাগে।

বাসরের রোমাঞ্চকেও হার মানানো এক অসাধারণ সঙ্গম শেষে দুজনই মুক্ত আকাশে উড়ন্ত পাখির মতো ইঙ্গিতে কিছু কথা শেষে সোহেল বলে, তমা, একটা অনুরোধ রাখবে?

: বল।

: আমরা আজীবন একে অপরের কল্যাণকামী বন্ধুই থাকি। তবে সার্টিফিকেটগুলো ছিঁড়ে ফেলার দরকার নেই। তোমার সিটিজেনশিপের অ্যাপ্লাই করতে ওগুলো লাগবে।

: ঠিক আছে। তাই হবে। ছিঁড়ব না।

ঠিক তখনই সোহেলের মুঠোফোনে একটা খুদে বার্তা আসে। সোহেল আর তমা দুজন একই সঙ্গে বার্তাটি পড়ে।

তারপর?

একে অপরের দিকে চেয়ে দুজনই বাক্যহারা।
...

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
ই–মেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: < Ishaque Hafiz >