উলসানের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রদর্শনকেন্দ্রে একদিন

সেই প্রত্নতাত্ত্বিক প্রদর্শনকেন্দ্র
সেই প্রত্নতাত্ত্বিক প্রদর্শনকেন্দ্র

ছবি ৪-১
ছবি ৪-২ 
ছবি ৪-৩ 

‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’, কবিগুরুর এই তত্ত্বে বিশ্বাসী আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজন ঘটা করে দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া থেকে বাড়ির কাছাকাছি নির্জন নিরিবিলি কোনো জায়গায় ঘুরতে বেশি পছন্দ করি। গত সপ্তাহে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাড়তি নিয়ামক হিসেবে সারা দিন থেমে থেমে টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছিল। এই বৃষ্টির মধ্যে আমার বের হওয়ার তেমন ইচ্ছে না থাকলেও বউ দেখি ঘরে তৈরি খাবার বাইরে বসে খাবে বলে ছোট একটা পোঁটলা রেডি করে বসে আছে। অগত্যা গাড়ি নিয়ে দুজন বেরিয়ে পড়লাম অজানা গন্তব্যে।

কিন্তু আকাশের এই মন খারাপের দিনে যাব কোথায়? কাছাকাছি না দেখা যেই জায়গাটার কথা প্রথম মনে হলো। সেটার অবস্থান আমার অফিসের ঠিক পাশেই। পাহাড়ের পাশ ঘিরে সুন্দর গোছানো একটা জায়গা। বছরখানেক ধরে যাব যাব করেও খুব কাছে বলে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই ভাবলাম, আজ ওখানে যাব। দক্ষিণ কোরিয়ার উলসান সিটির নতুন শহর ইয়াকসাদোংয়ে আমার অফিসপাড়া। এই এলাকায় সব বাড়িগুলো ইউরোপিয়ান ডুপ্লেক্স স্টাইলে তৈরি। রাস্তা আর ফুটপাত সবকিছুর মধ্যেই একটা অভিজাত আমেজ আছে। গাড়ি পার্ক করে পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে সরু রাস্তা দিয়ে হালকা বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে কিছু দূর হেঁটে যেতেই চোখে পড়ল কোরীয় ভাষায় লেখা ‘제방유적전시관’ যার অনুবাদ করলে হয় ‘নদীর তীর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রদর্শনকেন্দ্র’।

স্ত্রীর সঙ্গে লেখক
স্ত্রীর সঙ্গে লেখক

দরজার কাছে যেতেই দুজন কোরীয় নারী এগিয়ে এলেন আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য। ভেতরে প্রবেশ করতেই বেশ সুন্দর করে গোছানো একটি জাদুঘর চোখে পড়ল। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। জাদুঘরটি পুরোপুরি মাটির নিচে একটি দ্বিতল ভবনে। আজ থেকে ১ হাজার ৩০ বছর আগে এই নদীর পাড়ের মানুষের জীবনযাপনের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য করা হয়েছে। খুবই চমৎকার আর আধুনিক গঠনশৈলীর মাধ্যমে সেই সময়কার মানুষ কীভাবে তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নদীতে বাঁধ দিয়ে চাষাবাদের জন্য নদীর পানি ব্যবহার করত, তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বাঁধকে মজবুত করার জন্য তারা কোথাও শামুক ঝিনুকের খোলসের স্তর, আবার কোথাও কাঠ বা লাকড়ি মাঝে কাদা দিয়ে ঢালাই করে দিত। এক নারী আমাদের গাইড হিসেবে সেই ইতিহাস বর্ণনা করছিলেন। ওপরের তলার এক পাশে বাচ্চাদের জন্য ত্রিমাত্রিক ভিডিও সুবিধাসহ আধুনিক ডিজিটাল ইতিহাস শিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর অন্য পাশে সেই সময়কার ব্যবহৃত কৃষি উপকরণের সংগ্রহশালা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা আছে। এত সুন্দর একটা জায়গা শহর থেকে একটু ব্যাক প্লেসে হওয়ার কারণে অনেকের কাছেই অজানা রয়ে গেছে। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে গাইডসহ আমাদের চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা হলো। আসার সময় আমরা বাঙালি আতিথেয়তা হিসেবে বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া রুটি-শর্মা তাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম। আমাদের আপ্যায়নে তিনি খুশি হলেন।

সন্ধ্যা নামার কিছুটা বাকি থাকায় বউ বায়না ধরল তাকে মোটর ওয়েতে ড্রাইভ করতে নিয়ে যেতে হবে। বউয়ের বায়না না মানলে হয় না। তাই পাশেই নতুন তৈরি হওয়া তার খুব পছন্দের একটা মোটর ওয়েতে রওনা দিলাম। এই রাস্তাটা হচ্ছে উলসান শহরের দক্ষিণ দিক থেকে রেলস্টেশনের দিকে যাওয়ার জন্য একটি বাইপাস সড়ক। যা কখনো পাহাড়ের মাঝ বরাবর সুড়ঙ্গ করে, কখনো বা পাদদেশ দিয়ে আবার কখনো বা দুই পাহাড়ের ভ্যালি দিয়ে তৈরি করা। নতুন রাস্তা বলে গাড়ির চাপ অনেক কম থাকে। এই সড়কে কিছুক্ষণ গাড়ি চালানোর পর মনে হলো ‘মাউনা ওসানভিউ’ রিসোর্টে গেলে কেমন হয়? অফিস থেকে আমাদের বাসায় যাওয়ার যে রাস্তা, সেটা দিয়েই ওই রিসোর্টে যাওয়া যায়। গাড়ির নেভিগেশনে খুঁজে দেখলাম মাত্র ছয় কিলোমিটার পথ। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে আবার রওনা দিলাম রিসোর্ট দেখতে। এই ছয় কিলোমিটার পথ, টানা পাহাড়ের ওপর দিয়ে যেতে হয়, শুধু যেতে হয় না; রীতিমতো নিচু থেকে ওপর দিকে উঠতে হয়।

বার্ড-আই ভিউতে মাউনা রিসোর্ট। ছবি: ইন্টারনেট
বার্ড-আই ভিউতে মাউনা রিসোর্ট। ছবি: ইন্টারনেট

ঠিক বিমানে চড়লে যেমন হয়, পাহাড়ের ওপরে ওঠার সময় সে রকম ভাবে কান ধরে আসছিল। তার ওপর রিসোর্টে যাওয়ার পুরো রাস্তাটাই সাপের মতো এঁকেবেঁকে করা হয়েছে। মেঘেরা আমাদের ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছিল, সঙ্গে হালকা টিপটিপ বৃষ্টি। সত্যি অন্য রকম এক রোমান্টিক পরিবেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার দিনগুলোতে প্রিয়তমাকে সঙ্গে করে ঠিক এ রকম একটি সন্ধ্যা কাটানোর ইচ্ছে ছিল অনেক দিন। কিন্তু রাস্তা বেশি আঁকাবাঁকা হওয়ায় আমার মনোযোগটা বেশি ছিল গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের দিকে। অবশেষে পাহাড় ডিঙিয়ে, হালকা মেঘের সিঁড়ি ভেঙে আমরা পৌঁছালাম মাউনা রিসোর্টে।

যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা নেমে মাগরিবের সময় হয়ে গিয়েছে। তাই গাড়ি পার্ক করে গাড়ির মধ্যেই নামাজ পড়ে বের হয়ে পড়লাম জায়গাটা ঘুরে দেখার জন্য। সমুদ্রের কাছাকাছি ও পাহাড়ের অনেক ওপরে হওয়ায় অনেক শীত অনুভূত হচ্ছিল।

পাহাড়ের ওপরে সারি সারি ডুপ্লেক্স কটেজ, পার্ক, গলফ মাঠ, খালি পায়ে হাঁটার জন্য ওয়েলবিং রাস্তা। সঙ্গে চোখ যত দূর যায় সমুদ্রের তীর অবধি অবারিত পাহাড় প্রান্তর। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল বলে চারপাশের বাতি ছাড়া আর কিছু ভালো করে চোখে পড়ছিল না। আমরা সেই নির্জন নৈসর্গিক পরিবেশে ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করলাম। জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকে সেদিনের মতো প্ল্যান ছাড়া উপভোগ করার বাসনা নিয়ে এরপর ফিরে এলাম আপন নিরালায়।

ছোট-বড় অনেক সুন্দর কটেজ দিয়ে সাজান মাউনা রিসোর্ট
ছোট-বড় অনেক সুন্দর কটেজ দিয়ে সাজান মাউনা রিসোর্ট