মোনালিসার দেশে

মোনালিসার দেশে লেখিকা
মোনালিসার দেশে লেখিকা

কোনো একটা বইয়ে পড়েছিলাম, একটা ছেলে আইফেল টাওয়ারের চূড়ায় ওর ফিয়াসেকে প্রোপোজ করেছে। বইয়ে বর্ণনাটা এত রোমান্টিক ছিল যে, তখন থেকে স্বপ্নের শহর হিসেবে প্যারিস আমার মনে গেঁথে আছে।

কিছুদিন আগে সপরিবার আমরা গিয়েছিলাম লন্ডনে। আমেরিকায় ফেরার আগে ইউরোস্টার ট্রেনে ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে লন্ডন থেকে পৌঁছে গেলাম প্যারিস। আমাদের হোটেলটা আর্ক ডি ট্রায়ম্ফের (যে বিখ্যাত মনুমেন্টে ফ্রেঞ্চ রেভল্যুশনের সময়ের সব জেনারেলের নাম লেখা আছে) খুব কাছে। স্টেশন থেকে ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে চেক ইন করেই সেখান থেকে বের হয়ে গেলাম। আশপাশে প্রচুর হাই অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। রিজারভেশন না থাকলেও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করা লাগে না। খাবার খুব মজা। খাবার খেয়ে আর্কের কাছে হেঁটে গিয়ে রাস্তার এপাশ থেকে দেখে চলে গেলাম আইফেল টাওয়ার দেখতে। সেদিন ছিল তাদের স্বাধীনতা দিবস। আইফেল টাওয়ার বন্ধ। সন্ধ্যার পর যেতে বলল। এরপর মন খারাপ করে গেলাম টাওয়ারের সামনে ফুটব্রিজে। সেখানে লাভলক লাগাতে লাগাতে মানুষ এমন অবস্থা করেছে, ব্রিজ ভেঙে পড়ছে না কেন ভেবে খুব অবাক হয়েছিলাম। নিচে ক্যানেলে সবাই বোটে ঘুরছে। রাস্তার পাশ থেকে একগাদা আইফেল টাওয়ার কিনলাম, ছোট-বড়।

মোনালিসার দেশে লেখিকা
মোনালিসার দেশে লেখিকা

রাতে ডিনারের পর হোটেল থেকেই বলল, তাড়াতাড়ি আইফেল টাওয়ার যাও। কিন্তু কোনো ট্যাক্সি যাবে না। কেউ একজন বলল, প্লিজ হেঁটে চলে যাও। শত শত মানুষ হাঁটছে। রাস্তার পাশে সব দোকান খোলা। অনেক দোকানের ওপরে মানুষের বাসা। ওদের পিছে এক মাইল হেঁটে পৌঁছে গেলাম আইফেল টাওয়ারে সামনে। বসে গেলাম ঘাসে। কী সুন্দর মিউজিক বাজছে আর পুরো আইফেল টাওয়ার থেকে শুরু হয়ে গেল ফায়ারওয়ার্কস। অপূর্ব। অনেকক্ষণ দেখে আবার হেঁটে ফিরলাম হোটেলে। রাত তিনটায় হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি কত মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। হাসিখুশি কী প্রাণবন্ত এক শহর।

মোনালিসার দেশে লেখিকা
মোনালিসার দেশে লেখিকা

পরদিন ঘুম থেকে উঠে পড়িমরি করে হোটেলের উল্টোদিকে স্টারবাকসে নাশতা খেয়ে রেড বাস ট্যুরের টিকিট কেটে চলে গেলাম বাস ধরতে। অল্প সময়ে প্যারিস ঘুরতে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ওরা বিখ্যাত জায়গাগুলোর নাম আর কেন বিখ্যাত জানিয়ে দেয়। আমার মেয়ে প্যারিস থেকে ফিরে এসে আমাকে জানিয়েছিল, তার নাকি প্যারিসে গিয়ে ওদের স্পেশালিটি ডেজার্ট ট্রাই করার অনেক ইচ্ছা ছিল। মেয়েকে বললাম, কেন তখন বললি না? মা হিসেবে অসংখ্যবার মনে হয়েছে, বাচ্চাদের জন্য কিচ্ছু কখনো ঠিকমতো করতে পারিনি। আরও নতুন দুঃখ যোগ হলো তাতে। মা-বাবার সঙ্গে ঘোরার দিনও তাদের শেষ হয়ে আসছে। ইনশা আল্লাহ তাদের নিজের জীবন নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হয়ে যাবে। এই সময়টুকু তারা আমাকে দেওয়ার জন্য পরম করুণাময়ের কাছে অনেক শুকরিয়া।

আইফেল টাওয়ারে নেমে দেখি লম্বা লাইন। একটা লিফট খোলা শুধু। এবার আর হবে না ওঠা। ক্যাথিড্রাল অব নটর ডেম, প্যালেস অব ভার্সিলিস, সেন্ট চ্যাপেল, প্যালেস ডি লা কনকর্ড, লা কনসিয়ের্জ, যে টানেলে লেডি ডায়ানা মারা গেলেন, নেপোলিয়নের টোম্ব আরও কত কিছু বাস থেকে দেখে চলে এলাম লুভ মিউজিয়ামে। যেকোনো জায়গায় প্রায়োরিটি লাইনে টিকিট করে রাখা খুব জরুরি, না হলে ফ্রি ট্যান আমার মতো। গরমে মাথায় এক বালতি পানি ঢালার মতো কোনোরকমে লুভ দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

লেওনার্দো দা ভিঞ্চির অনবদ্য সৃষ্টি মোনালিসা
লেওনার্দো দা ভিঞ্চির অনবদ্য সৃষ্টি মোনালিসা

বিশাল মিউজিয়ামে বিখ্যাত সব আর্ট, মূর্তি চারদিকে আর ছাদে। দৌড়ে চললাম মোনালিসা দেখতে। কয়েক তলা পেরিয়ে অবশেষে দেখা পেলাম লেওনার্দো দা ভিঞ্চির অনবদ্য সৃষ্টি। এত ছোট? হাজার হাজার মানুষ ছবির সামনে। ধাক্কা খেয়ে কাছে পৌঁছাতেই হঠাৎ এক বয়স্ক চায়নিজ নারী সামনের দড়ির বেষ্টনী খুলে মোনালিসার সঙ্গে পটাপট ছবি তুলে দিলেন দৌড়। আর আমি গার্ডের ধাক্কা খেয়ে আবার বেষ্টনীর মধ্যে এসে কয়েকটা ছবি তুলে সামনের গিফট শপ থেকে মোনালিসা কিনে অন্য দিকে গেলাম। বহু দেশের আর্ট ভাগ করা আছে লুভে। মিসর, গ্রিস, ইসলামিক ও ফ্রেঞ্চ ছাড়াও অনেক দেশের। রাতে হোটেলে ডিনার করে ঘুম।

পরদিন চলে আসতে হবে ইংল্যান্ডে। সকালে হেঁটে আর্কের চূড়ায় উঠলাম। কী সুন্দর প্যারিস শহরটা। আইফেল টাওয়ারে উঠতে না পারার দুঃখ অনেকটা চলে গেল। সুইডেনে পিএইচডি করার কারণে বহু দেশে আমার বেটার হাফ আগেই ঘুরেছে পেপার প্রেজেন্ট করতে গিয়ে একা একা। তবে আর্কের চূড়ায় যে ওঠা যায়, তা সে জানত না। এরপর হাসিখুশি শহর প্যারিস থেকে লন্ডন হয়ে চলে এলাম আমেরিকায় নিজের ডেরায়।