আমার মেয়ে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমার বড় মেয়ে তিতলি অটিস্টিক। তিতলি আমাদের দুই দিকের পরিবারের সবচেয়ে বড় সন্তান। সে পৃথিবীতে আসার আগেই ওকে নিয়ে দুই পরিবারের সবার কত স্বপ্ন। কী নাম রাখা হবে সেটা নিয়ে রীতিমতো ঠান্ডা যুদ্ধ নানি আর দাদির মধ্যে। সেই যুদ্ধ মেটাতে জাহিদ ঘোষণা দিল, আমাদের বাচ্চা, নামও আমরা ঠিক করব। মেয়ে হবে জানতাম, সেটা নিয়ে জাহিদ ভীষণ উত্তেজিত। ‘বুঝলে, আমার মেয়ে ভীষণ চঞ্চল হবে।’ জাহিদ একা একাই কত কিছু বলত। আমার পেটে কান ঠেকিয়ে বলত, ‘দেখছ না, তোমার পেটেই কেমন ছটফট করছে।’ আমি শুনতাম আর হাসতাম। ওর সেই না দেখা চঞ্চল মেয়ের নাম ঠিক করে রেখেছিল তিতলি। এই শব্দের অর্থ প্রজাপতি।

সোনার চামচ দিয়ে নাতনির মুখ দেখেছিলেন আমার শাশুড়ি। নানা-নানি, দাদা-দাদি, চাচা, ফুফুদের আদরে তিতলিকে বিছানায় শোয়ানোর সুযোগও দিনের বেলা পাওয়া যেত না। সবার আদরে কোলে কোলেই বড় হচ্ছিল সে।

যে–ই দেখতে আসত, বলত, ‘কী ফুটফুটে বাচ্চা, আর কী ভীষণ শান্ত।’ ছোটবেলায় মেয়ে আমার খুব কম কান্নাকাটি করত। সময়মতো খেত। বেশি রাত জাগত না। আমাকে একটুও জ্বালায়নি সে। এমন লক্ষ্মী বাচ্চা আসলেই খুব কম দেখা যায়। সবার চোখের মণি সে। দিনগুলো কী সুন্দর কাটছিল। যেই বয়সে বাচ্চারা হাসে, সে হেসেছে তার কিছু পরে। বাচ্চাদের হাসি প্রথম দিকে এমনিতেই অর্থবোধক থাকে না। তারা হাসে অকারণে। আমরাও সেই অকারণ হাসি দেখে উচ্ছ্বসিত হতাম। শব্দ করত অর্থহীন। সেই সব শব্দ আমার আর জাহিদের কাছে গানের চেয়েও মধুর লাগত। দেড় দুই বছর বয়স পর্যন্ত তেমন কোনো অর্থপূর্ণ শব্দ সে বলেনি। বাবা অথবা মাও না। কিন্তু সেটা নিয়ে আমাদের কারও কোনো দুশ্চিন্তা হয়নি।

তা ছাড়া, ওর জন্মের বছর দেড়েক পরে আমার মা মারা গেলেন। মায়ের মৃত্যুতে আমি বেশ ভেঙে পড়েছিলাম। শাশুড়ি মা মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে এই প্রসঙ্গ তুলতে গেলে আমার মুখ ভার হয়ে যেত। ‘সব বাচ্চা কি এক রকম হয় মা? একেক বাচ্চা একেক বয়সে হাঁটে, একেক বাচ্চা একেক বয়সে কথা বলে। তা ছাড়া ও তো শব্দ করে, বোবা হলে তো শব্দ করত না।’ শাশুড়ি মা কী একটা বলতে গিয়েও বলতেন না। দুই পার হয়ে যখন তিন চলছে, তখন একদিন জাহিদ বলল, ‘আচ্ছা, তিতলিকে ডাকলে বা ওর পাশে জোরে শব্দ হলেও তাকায় না কেন?’ বাবা এই কথাটা বলতে পারলেও, আমার মায়ের মন কোনোভাবেই কোনো কিছু মেনে নিতে চাইছিল না। এদিকে আর বছরখানেক পরে তো স্কুলও শুরু করতে হবে। তখন তো কথা শিখতেই হবে। চিন্তা আমারও তত দিনে কিছুটা শুরু হয়েছে। জাহিদের দিকে খুব করুণ চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘কী বলতে চাইছ?’

আমার দিকে তাকিয়ে জাহিদ আমার মন খারাপটা টের পেল। তারপর আমার হাতটা হাতে নিয়ে বলল, ‘ওকে একটা কানের ডাক্তার দেখাই, চলো।’ জাহিদের কথায় রাজি হলেও আমি জানতাম, ওর কান ঠিকই আছে। না হলে সে শব্দ করত না। পরদিন অফিস থেকে আগে বেরিয়ে আমরা ওকে নিয়ে গেলাম একজন বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি সব দেখে বললেন, ‘আমি তো কোনো অসুবিধা দেখছি না।’ ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার পথে জাহিদকে ভীষণ বকা দিলাম, ‘খামাখা ভয় দেখিয়ে দাও। আমার মেয়ে ঠিকই আছে।’

কারও কাছে কিছু স্বীকার না করলেও সারাক্ষণই একটা অস্বস্তি হতো, এত সময় লাগছে কেন কথা বলতে? অনেকে বলল, কোনো কোনো বাচ্চার বেশ দেরি হয়। কেউ কেউ বলল, সারা দিন চাকরি করো। কাজের মেয়ে আর বুড়ো শাশুড়ি হয়তো ওর সঙ্গে কথাই বলে না। এসব কথায় তীব্র অপরাধবোধে মন ছেয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত নিজের সব অস্বস্তিকে চাপা দিয়ে চুপি চুপি একজন শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলাম।

শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বললেন, ‘আপনার বাচ্চা একজন স্পেশাল চাইল্ড, যাদেরকে বলে অটিস্টিক। ও শারীরিক ভাবে সুস্থ। কিন্তু মানসিক ম্যাচিউরিটি কম। অর্থাৎ বয়সের সঙ্গে শরীর বাড়লেও ওর মন থেকে যেতে পারে অনেকটা শিশুর মতো।’

‘তার মানে কী, ও কথা বলতে পারবে না? স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে না?’ আমি হয়তো আর্তনাদই করছিলাম। এসি চেম্বারে বসেও কুল কুল করে ঘামছিলাম আমি। আমার হাত শক্ত করে ধরেছিল জাহিদ। আর আমাদের পাশে বসে অদ্ভুত শব্দ করছিল তিতলি।

সেদিন থেকে শুরু হলো আমার অন্য রকম জীবন। বলা যায় জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ। কথা বলছে না। শুরু হলো খোঁজখবর। অনেক খুঁজে পাওয়া গেল স্পিচ থেরাপির সন্ধান। সপ্তাহে তিন দিন অফিস কামাই দিয়ে ওকে নিয়ে যেতাম ওখানে। অফিস থেকে বের হতাম যখন আগে আগে। নিজেকে চোরের মতো মনে হতো। প্রথম প্রথম সবাই সহানুভূতি দেখালেও, মাস তিনেক পরে বস একদিন ডেকে বললেন, ‘এভাবে তো আর চলছে না রুমানা। এবার যে তোমার একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তোমার যদি আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হতো, তাহলেও একটা কথা ছিল। তোমাকে চাকরি থেকে বিদায় দিতে আমারও খুব খারাপ লাগবে।’

মাথা নিচু করে বললাম, ‘আমি বুঝতে পেরেছি স্যার।’ লজ্জায় চোখ তুলতে পারছিলাম না, সেই চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছিল আমার হাতের ওপরে। এত দিনের চাকরিটা ছেড়ে দিতে কী যে খারাপ লাগছিল। কাজে আমার অনেক সুনাম ছিল। চাকরিটা ছিল আমার অস্তিত্বের একটা অংশ।

পাস করার পর থেকে কখনোই ঘরে বসে থাকিনি। কিন্তু দিনগুলো ঠিকই চলে যায়। তিতলিকে থেরাপিতে নিয়ে যাওয়া, ওর খাওয়া, গোসল, বাথরুম—সব দেখাশোনা আর সেই সঙ্গে বিভিন্নভাবে চেষ্টা ওকে কিছুটা স্বাভাবিক করে তুলতে। ওর ভেতরে জীবন জাগাতে আমি নিজেই ভেতরে-ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। একে তো এত বড় ধাক্কা সামলে নেওয়া, চাকরি ছাড়তে বাধ্য হওয়া, তার ওপরে কেউ যখন বাঁকা কথা শোনাত বা করুণা দেখাত তখন অসহ্য লাগত। ধীরে ধীরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও যোগাযোগ কমিয়ে দিলাম। সারা দিন মনমরা হয়ে থাকতাম। শুধু মেয়েটা যখন অকারণে হাসত হা–হা করে বা মাঝে মাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরত তখন খুব ভালো লাগত। ওকে বুকে জড়িয়ে আমি আমার কষ্ট ভুলতাম। হোক অটিস্টিক, কিন্তু আমারই তো সন্তান।

এক বছরের সাধনায় তিতলি কিছু কিছু শব্দ বলতে শিখল। যেদিন প্রথম ‘মা’ ডেকেছিল, আমার ইচ্ছে করছিল সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিই চিৎকার করে। জাহিদকে অফিস থেকে ফোন দিয়ে আগে আগে আনিয়েছি। ইদানীং ওর সঙ্গেও আমার প্রয়োজনের বাইরে কথা হয় খুব কম। ও অনেক চেষ্টা করেছে। আমারই কিছু ইচ্ছে করত না। একটা অপরাধবোধও কাজ করত। মনে হতো, এই যে তিতলি বাবা ডাকছে না, দাদি ডাকছে না, অন্য দশটা বাচ্চার মতো বাড়িতে প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে না, বিনা কারণে চিৎকার করে সারা বাড়ির সবাইকে অস্থির করছে, এই সবকিছুর জন্য দায়ী আমি, ও যে আমারই অংশ। এই নীরবে দূরে সরে যাওয়া আমি সেদিন জাহিদকে ফোন দিয়ে খুশিতে ফেটে পড়েছিলাম, ‘তিতলি আজ আমাকে মা ডেকেছে, আমার তিতলি কথা বলতে পেরেছে, তুমি এখুনি বাড়ি আসো।’ জাহিদ ভীষণ অবাক হয়েছিল আর তার চেয়েও বেশি খুশি।

ও যখন বাড়িতে এল, তিতলি তখন সারা বারান্দা দৌড়াচ্ছে আর ময়না পাখির মতো বলছে ‘মা মামা মা মামা...।’

ওকে কোলে নিতে গিয়েও থমকে যায় জাহিদ। তত দিনে আমরা জেনে গেছি তিতলিকে যখন-তখন বিরক্ত করা যাবে না, তাহলেই সর্বনাশ। তিতলির বদলে আমাকেই পাঁজাকোলা করে তুলে নিল ও। আমিও বাধা দিইনি। নিচু হয়ে জাহিদ যখন চুমু খেল, আমার শরীর অবশ হয়ে আসছিল। কত দিন নিজের দিকে ফিরেও তাকাইনি, আর জাহিদের দিকেও।

সে রাতে আমাদের অনেক ভালোবাসা হলো। বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল জাহিদ। আমাদের মেয়েটার মুখে ছোট্ট দুটো শব্দ আমাদের দুটি প্রাণে যেন একটু খানি আশার আলো জ্বালিয়ে দিল। জাহিদের বুকে মাথা রেখে বলেছিলাম, ‘আমি দুঃখিত, তোমাকে অনেক দিন দূরে সরিয়ে রেখেছি।’ আমার মাথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে জাহিদ বলেছিল, ‘তোমার দুঃখ কি আর আমার চেয়ে আলাদা?’

মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে একসময় আঙুলগুলো থেমে গেল। আমাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘রুমু, এক কাজ করলে কেমন হয়, আরেকটা বেবি নেই, চলো, একটা সুস্থ বাচ্চা এলে বাড়ির পরিবেশটা পাল্টে যাবে।’ ‘সুস্থ’ শব্দটা বড় কানে বাজল আমার। তবে কি আমার তিতলি অসুস্থ। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ঝট করে সোজা হয়ে বসলাম আমি। আমার চোখে রাজ্যের অবিশ্বাস, ‘কী বলছ তুমি? যদি আরেকটা বাচ্চাও অটিস্টিক হয়?’

‘তুমি না চাইলে তো আর কিছু হবে না।’ আমাকে শান্ত করে জাহিদ। অনেক দিন পরে একটা শান্তির ঘুমে গড়িয়ে পড়ি আমি। বিধাতা তখন হাসছে, সে রাতেই আমার মাঝে বীজ বুনে দিয়েছিলেন আরেকটি অনাগত সন্তানের, আমার অজান্তেই। (চলবে)
...

তামান্না ইসলাম: ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।