ইস্তাম্বুলে পয়লা বৈশাখে এক টুকরা বাংলাদেশ

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে উৎসবমুখর ও আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপন করা হয়েছে বাংলা নববর্ষ ১৪২৬। ইস্তাম্বুলের বাংলাদেশ কনস্যুলেটের উদ্যোগে স্থানীয় মিমার সিনান ফাইন আর্টস বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয় সময় বিকেলে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করা হয়।

পয়লা বৈশাখ উদযাপনের জন্য দুপুর থেকেই ইস্তাম্বুলসহ তার আশপাশের বিভিন্ন শহর থেকে বৈশাখী পোশাক পরে এবং ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার হাতে জড়ো হতে থাকেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। অনেকে সঙ্গে নিয়ে আসেন কুলো, চালুনি, হাতপাখা, ঢোল, একতারা ও বাঁশি। মুখোশ পরে এবং হাতে ও গালে আলপনা এঁকে অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ মাতিয়ে রাখে কিশোর-কিশোরীসহ সব বয়সের বাংলাদেশিরা। আনন্দে উদ্বেলিত বাঙালিদের অংশগ্রহণে মনোরম বসফরাস প্রণালির তীরে গোটা মিলনায়তনটি ক্ষণিকের জন্য মনে হয়েছিল যেন এক টুকরা বাংলাদেশ।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

এ উপলক্ষে এক আলোচনা সভা এবং বাংলাদেশের শিশু একাডেমী ও ইস্তাম্বুলের বেছিকতাস মিউনিসিপ্যালটির শিশু সাংস্কৃতিক দলের অংশগ্রহণে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম আল্লামা সিদ্দীকী। স্বাগত বক্তব্য দেন ইস্তাম্বুলের বাংলাদেশ কনস্যুলেটের দূতালয়প্রধান ও কনসাল বিদোষ চন্দ্র বর্মন।

এম আল্লামা সিদ্দীকী সবার সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে বলেন, জীবনের সব পঙ্কিলতা পরিহার করে শুভবোধ ধারণ করে আমাদের সমৃদ্ধির ধারা এগিয়ে রাখতে হবে। বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাসের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করতে গিয়ে এম আল্লামা সিদ্দিকী বলেন, আমরা বাঙালিরা বর্তমানে যে বাংলা পঞ্জিকা ব্যবহার করি, তার প্রচলন শুরু হয় মোগলদের আমলে। মূলত প্রশাসনিক কারণে খাজনা আদায় সহজ করার লক্ষ্যে নতুন এ পঞ্জিকা চালু করা হয়। তিনি বলেন, মোগলদের আগেও বাংলার অধিবাসীরা নববর্ষ উদযাপন করত। তবে বৈশাখে নয়। হয়তো অগ্রহায়ণে ফসল তোলার সময়ে। সাম্প্রতিক অতীতে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ছায়ানট ১৯৬৫ সালে রমনা বটমূলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন শুরু করে, যা ছিল বাঙালি জাতির জীবনে প্রেরণা সঞ্চারী ও দ্যোতক।

বক্তব্য দিচ্ছেন এম আল্লামা সিদ্দীকী
বক্তব্য দিচ্ছেন এম আল্লামা সিদ্দীকী

বাঙালি জাতির মানস গঠনে ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ শাণিত করার পেছনে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের গুরুত্বের ওপর বলতে গিয়ে এম আল্লামা সিদ্দীকী উল্লেখ করেন, আত্মপরিচয়ের শেকড় ও বাঙালি জাতির সত্তা প্রোথিত রয়েছে এই উৎসবে। এ উৎসব বাঙালির জীবনকে নতুনরূপে রূপায়িত করে চলেছে। প্রসঙ্গক্রমে ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রার সমাজতাত্ত্বিক তাৎপর্য তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, লোকসংস্কৃতির মধ্যে লুক্কায়িত থাকে মানুষের অতীত সমাজের মূল্যবোধ, শ্রেয়বোধ, বিশ্বাস, প্রথা, কলা, নৈতিকতাবোধ, জীবন-সংগ্রাম, সৃজনশীলতা ইত্যাদি, যা আমরা আবহমানকাল ধরে লালন করে চলেছি। ইউনেসকো কর্তৃক মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘অপরিমেয় বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা আমাদের বাঙালি হিসেবে গর্বিত করেছে।

অতিথিদের সঙ্গে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা
অতিথিদের সঙ্গে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা

তুরস্কে বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশে আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলের বাংলাদেশ মিশন কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও পদক্ষেপ সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে এম আল্লামা সিদ্দীকী বলেন, তুরস্কের সরকার ও জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে বাংলাদেশ-তুরস্কের দ্বিপক্ষীয় মৈত্রী বন্ধন আরও দৃঢ় করার কাজ এগিয়ে চলেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেন তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বাঙালির শিল্প–সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবোধের চেতনায় গড়ে তোলেন সেই আহ্বান জানিয়ে প্রবাসীদের উদ্দেশে বলেন, বাঙালির আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তা বিকাশের শেকড় থেকে পরবর্তী প্রজন্ম যেন দূরে সরে না যায়, সেদিকে গভীর মনোযোগী হতে হবে।

স্যুভেনির বিনিময়
স্যুভেনির বিনিময়

স্বাগত বক্তব্যে বিদোষ চন্দ্র বর্মন উপস্থিত সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, আজ বাঙালির নববর্ষ। সব গ্লানি মুছে নতুন উদ্যমে শুরু হোক নতুন বছর। পয়লা বৈশাখকে বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তর বাঙালির মতো ইস্তাম্বুলেও আজ বাঙালি বর্ষবরণের আনন্দে মেতে উঠেছে। বিদেশের মাটিতে বাঙালি সংস্কৃতি লালনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি আগত অতিথিদের বলেন, মিশন কর্তৃক প্রবাসী বাংলাদেশিদের সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সমুন্নত রাখার কর্মসূচি বা অনুষ্ঠানমালা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর পরিচালক আনজীর লিটন আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যকার বিদ্যমান সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আগামী দিনে আরও শক্তিশালী হবে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিতি
অনুষ্ঠানে উপস্থিতি

আয়োজনের দ্বিতীয় ভাগে অনাচারকে প্রতিহত করার এবং সব বাধা পেরিয়ে জাতির অভিযাত্রায় ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রত্যয় নিয়ে ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটির মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দেশাত্মবোধক ও লোক ঐতিহ্যনির্ভর গান ও নৃত্য মিলনায়তনভর্তি দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে অনুষ্ঠানজুড়ে।

অনুষ্ঠান শেষে অতিথিদের বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। বিজ্ঞপ্তি