জাপানের গুম্মাতে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব
জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশি বাঙালিদের নববর্ষ উদ্যাপন সাধারণত টোকিওতে আয়োজিত টোকিও বৈশাখী মেলাকেন্দ্রিক। জাপানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সব বাঙালি এখানে সমবেত হন বৈশাখ উদ্যাপনের জন্য। ভেন্যুসংক্রান্ত জটিলতায় এ বছর ১৪ এপ্রিল টোকিও বৈশাখী মেলার পরিবর্তে ২১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এদিকে পয়লা বৈশাখের দিন ছিল রোববার। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পয়লা বৈশাখ হওয়ায় টোকিওর পার্শ্ববর্তী গুম্মা, সাইতামা ও তোচিগিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা গুম্মা প্রিফেকচারের ওইজুমি নামক স্থানে প্রথমবারের মতো উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে আয়োজন করেন বর্ষবরণ উৎসব ১৪২৬ ও বৈশাখী মেলা। আয়োজক ও আমন্ত্রিত অতিথিদের প্রায় সবারই এই প্রথম টোকিওর বাইরে বৈশাখ উদ্যাপনের অভিজ্ঞতা।
আয়োজনে বিশেষ অতিথি ছিলেন টোকিও থেকে আগত বাংলাদেশি সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা। অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ ছিল জাপানি শিল্পীদের সমন্বয়ে গড়া বাংলা ব্যান্ড ‘বাজনা বিট’-এর শিল্পী মায়ে ওয়াতানাবে ও শুনসুকে মিজুতানির উপস্থিতি।
দুপুর ১২টায় পিতা-পুত্র মোহাম্মদ শাহাদাত ও আয়ানের কোরআন তিলাওয়াত দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এরপর উপস্থিত সব শিশু-কিশোর বাংলাদেশের পতাকা হাতে মঞ্চে উঠে আসে। এদের নিয়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন এ অঞ্চলের বাঙালি কমিউনিটির জনপ্রিয় শিল্পী রাবিতা সুলতানা নওশি।
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর মঞ্চে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয় বিশেষ অতিথি ও বাজনা বিটের সদস্যদের।
বিশেষ অতিথিদের মধ্য থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন ব্যবসায়ী শাহিন চৌধুরী, টোকিও মেলা কমিটির সদস্য মোহাম্মদ জসিম, সাংবাদিক ও লেখক কাজী ইনসানুল হক, টোকিও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গুণীজন মুন্সি রেনু সুলতানা ও শিক্ষক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব স্বরলিপি কালচারাল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বর্তমান উপদেষ্টা আজাদ মুন্সি।
আয়োজকদের মধ্য থেকে বর্ষবরণের শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন আশফাকুর রহমান লাকী ও মৌরি বড়ুয়া।
বক্তব্যের পর মঞ্চে আসেন বাজনা বিটের শিল্পী মায়ে ওয়াতানাবে ও শুনসুকে মিজুতানি। তাঁরা একে একে পরিবেশন করেন ‘ধনধান্য পুষ্পেভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ ও ‘আমি বাংলায় গান গাই’ এবং ব্যান্ডের মৌলিক গান ‘তোমার উজ্জ্বলতার ছোঁয়ায়’। তাদের শেষ পরিবেশনা ছিল কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর স্মরণে ‘চলো বদলে যাই’। দারুণ উপভোগ্য ছিল এই দুই শিল্পীর বাংলা সংগীত পরিবেশনা। এরপর উদ্বোধন করা হয় গুম্মা প্রিফেকচারের প্রথম ইনডোর বৈশাখী মেলা। বিশেষ অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে লাল ফিতা কেটে মেলা উদ্বোধন করেন বাজনা বিটের দুই শিল্পী।
সীমিত পরিসরের এই ইনডোর মেলায় স্টল ছিল মোট আটটি। বাচ্চাদের খেলনা ও খাবারের স্টল, মিষ্টির স্টল, জুয়েলারি ও শাড়ির স্টল, আর্ট একজিবিশনের স্টল ছাড়াও ছিল কিওদাই রেমিট্যান্স ও গিয়াস ট্যুরস ট্রাভেলসের স্টল। মেলার স্টলগুলোয় ছিল অতিথিদের উপচে পড়া ভিড়। মেলার পাশাপাশি চলতে থাকে উৎসবের অন্য ইভেন্টগুলো।
মঞ্চায়িত হয় নাট্যকার সালাহউদ্দিন জাহিদ রচিত বৈশাখের বিশেষ নাটিকা ‘ভাবি ও বৈশাখ’। এতে অভিনয় করে প্রশংসিত হন সুমনা ও ফাতেমা লুৎফর চম্পা।
মধ্যাহ্নভোজনে প্রায় ২২০ জন অতিথির জন্য বিবাহিত নারীদের রান্না করা মজাদার সব মেন্যুর মধ্যে ছিল সাদা ভাত, ইলিশ মাছ, হরেক রকম ভর্তা, কাবাব, মুরগির মাংস, গরু ও খাসির মাংস।
এক ঘণ্টা মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর শুরু হয় দ্বিতীয়ার্ধ। এ পর্বে সংগীত পরিবেশন করেন কারাওকে মাস্টার হিসেবে পরিচিত সোহেল জায়েদি, বাপ্পী, মিন্টু বড়ুয়া, সাবরিনা, রাবিতে সুলতানা নওশি, রাজু, নাঈম। দ্বৈত সংগীত পরিবেশন করেন সুমনা ও সোহাগ দম্পতি। অনুষ্ঠানের সাউন্ড সিস্টেম ও কারাওকে ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সোহেল জায়েদি। আবৃত্তি পরিবেশনায় ছিলেন আয়েশা সিদ্দিকা মিতু।
এ ছাড়া সবার অংশগ্রহণে ছিল আকর্ষণীয় কুইজ। চারটি ধাপ অতিক্রম করে প্রায় ১৬০ জনের মধ্যে তিনজনকে পুরস্কৃত করা হয়। প্রথম স্থান অধিকার করেন আয়েশা সিদ্দিকা মিতু। বরাবরের মতোই পর্বটি ছিল শিক্ষামূলক ও আনন্দদায়ক।
বয়সভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শিশুদের ইভেন্টে ছিল শিশুদের সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা ও খেলা। পরিচালনায় ছিলেন রওশন আফরোজ রুম্পা। বিজয়ী ছাড়াও প্রায় ৬০ জন শিশু-কিশোরকে পুরস্কৃত করা হয়।
বিবাহিত নারীদের জন্য ছিল টাই বাঁধা প্রতিযোগিতা। এতে প্রতিযোগিনীরা যাঁর যাঁর স্বামীর গলায় টাই বেঁধে দেন। এ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারী শিলা ভাবি। অন্যদিকে, পুরুষদের জন্যও ছিল মজার ইভেন্ট। দড়ি টানাটানি ও মোরগলড়াই। সবাই যেন কৈশোরে ফিরে গিয়েছিলেন এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে। প্রথম স্থান অধিকারী মোহাম্মদ আলম।
নিয়মিত সদস্যদের মধ্যে যাঁরা কখনোই মঞ্চে আসেন না, তাঁদের নিয়ে বিশেষ পর্ব পরিচালনা করেন আয়েশা সিদ্দিকা মিতু। প্রত্যেকের জন্যই ছিল পুরস্কারের ব্যবস্থা।
যাঁরা কষ্ট করে খাবার ও নাশতা তৈরি করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের জন্য এবং যাঁরা নতুন অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেককেই পুরস্কৃত করা হয়। এ ছাড়া পুরস্কৃত করা হয় অনুষ্ঠানের সবচেয়ে মনোযোগী দর্শক ও সবার আগে উপস্থিত পরিবারকেও।
দুপুর ১২টায় শুরু হওয়া ও অনেক ইভেন্টে সাজানো এই অনুষ্ঠান শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়।
জাপানের কর্মব্যস্ত জীবনধারায় বাঙালির অন্যতম জাতীয় এই উৎসব বাংলাদেশের সঙ্গে একই দিনে নতুন পরিবেশে এত ধুমধামের সঙ্গে উদ্যাপন করা ছিল সত্যি সবার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। অংশগ্রহণকারী সবার জন্যই এ অনুষ্ঠান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ ছাড়া এবারের আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতিবছরই টোকিওর বাইরে এই অঞ্চলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বর্ষবরণ উদ্যাপন করার সম্ভাবনা দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।