বর্ণিল উৎসবে প্যারাগুয়েতে বাংলা নববর্ষ বরণ

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য

প্যারাগুয়েপ্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন করেছে ব্রাজিলের বাংলাদেশ দূতাবাস। ১৪২৫ বাংলা বছরে প্রথমবারের মতো এ আয়োজন করা হয়েছিল সিউদাদ ডেল এস্তে শহরে। প্যারাগুয়েপ্রবাসী অনেক বাংলাদেশির আগ্রহে এবারও ব্রাজিলের বাংলাদেশ দূতাবাস বাংলা নববর্ষ বরণের এ আয়োজন করে ব্রাসিলিয়া থেকে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরের এ শহরে।

পৃথিবীর অনেক দেশে বাংলাদেশিরা নিম্নমানের কাজে নিয়োজিত থাকলেও প্যারাগুয়েতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের অধিকাংশই গড়ে তুলেছেন ইলেকট্রনিকস সামগ্রী বা কাপড়চোপড়ের ব্যবসা। অত্যন্ত সচ্ছল এই প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশটির সমাজেও সুপ্রতিষ্ঠিত। স্থানীয় প্রশাসন বা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সামাজিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তাঁরা প্যারাগুয়ের জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন এক অভূতপূর্ব পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানের সম্পর্ক।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য

দেশীয় রাজনীতিমুক্ত ও সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ প্যারাগুয়েপ্রবাসী এই বাংলাদেশিরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আমাদের প্রবাসীদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত হতে পারেন। যাঁরা তাঁদের ব্যবসায়িক ব্যুৎপত্তি ও কর্মদক্ষতার গুণে ক্রমে প্যারাগুয়ের রাজনীতিতেও শক্তিশালী হয়ে উঠছেন। প্যারাগুয়ের সমাজে তাঁদের এ সম্মানজনক অবস্থান আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ-প্যারাগুয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবে নিঃসন্দেহে।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য

গত বছরের মতো এবারও নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল দুই দিনব্যাপী বৈশাখী অনুষ্ঠানমালা। বৈশাখের আগমনের পূর্ব রাতে পরিবেশিত হয় চার ঘণ্টাব্যাপী এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাঙালি ও প্যারাগুয়ের শিল্পীদের পরিবেশনায় আয়োজিত মনমাতানো এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি হয়ে উঠেছিল যেন ঐতিহ্যবাহী দুই শক্তিশালী সংস্কৃতির মিলনমেলা। বাঙালিদের ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি আর দেশাত্মবোধক নাচ-গানের তালে তালে যখন হল উপচেপড়া বাঙালি আর প্যারাগুয়ের দর্শককুল মাতোয়ারা, তখনই আবির্ভাব ঘটে বিশ্বখ্যাত প্যারাগুয়ের লোকনৃত্য দলের। প্যারাগুয়েনদের এই অসাধারণ আর বর্ণিল নাচ পরিবেশনা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে শত শত দর্শককে মধ্যরাত অবধি। অনুষ্ঠানে দেশটির কয়েকজন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত থেকে প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতি তাঁদের সম্মান ও আস্থা প্রকাশ করেন। প্যারাগুয়েতে এমন একটি আয়োজনের মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক জানাশোনা বাড়ানোর আর তার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সার্বিক সম্পর্কোন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য উপস্থিত প্যারাগুয়ের নেতারা বাংলাদেশ দূতাবাসকে অভিনন্দন জানান। অনুষ্ঠানের শেষে প্যারাগুয়ের একটি টিভি চ্যানেল বাংলাদেশের নববর্ষ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বাংলাদেশের লোক-কারুশিল্প ইত্যাদি বিষয়ে এক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য

বৈশাখী এই আয়োজনের দ্বিতীয় দিনে বসে দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা। দিনের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয় প্যারাগুয়েপ্রবাসী কয়েক শ বাংলাদেশি আর দূতাবাস পরিবারের সদস্যদের উচ্ছল অংশগ্রহণে বৈশাখী আনন্দ শোভাযাত্রা আর মঙ্গল শোভাযাত্রা। মাঠভরা খাবার আর ঐতিহ্যবাহী রকমারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসা স্টলগুলোতে ছিল দিনভর আনাগোনা। উপচেপড়া ভিড়ের মধ্যে দেখা যায় প্যারাগুয়ে আর অন্য দেশের বেশ কিছু উৎসাহী দর্শককেও।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য

বৈশাখী মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল বাংলাদেশের নানান ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার প্রতিযোগিতার আয়োজন। মেলায় আগত আবালবৃদ্ধবনিতা দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত নানান প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আনন্দ–উল্লাসে মেতে ওঠেন। ফাঁকে ফাঁকে নয়নাভিরাম ইটাইপু লেকে নৌকাভ্রমণও করেন। দিন শেষে ঘরে ফেরার পালা। তার আগে ব্রাজিলে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জুলফিকার রহমান প্যারাগুয়েপ্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। প্রবাসী বাংলাদেশিরা গত এক বছর থেকে নিয়মিতভাবে প্যারাগুয়েতে দূতাবাসের কনস্যুলার দল পাঠিয়ে তাঁদের সেবা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রদূতকে ধন্যবাদ জানান। এমনকি নববর্ষ উপলক্ষে এত আয়োজনের মধ্যেও প্যারাগুয়েপ্রবাসী বাংলাদেশিদের কনস্যুলার সেবা দেওয়ার জন্য তাঁরা দূতাবাসের বর্তমান কর্মকর্তাদের প্রশংসা করেন। তাঁরা আশা প্রকাশ করেন, দূতাবাসের এই ব্যতিক্রমী প্রবাসীবান্ধব কার্যক্রম আগামী দিনগুলোতেও চালু থাকবে।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য

রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান তাঁর বক্তব্যে ব্রাসিলিয়া থেকে দুই হাজার কিলোমিটার দূরে এই বৈশাখী আয়োজনে দূতাবাসকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য সকল প্যারাগুয়েপ্রবাসী বাংলাদেশিদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শিল্পীবদের তিনি ধন্যবাদ জানান এই দূরদেশে বাংলাদেশকে এত সুন্দর আর সুচারুভাবে বিদেশিদের সামনে তুলে ধরার জন্য। সুন্দর একটি আনন্দ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা, যেটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, আয়োজনের জন্যও তিনি সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানান। আজকের শিশু-কিশোরদের আগামীদিনের আলোকবর্তিকা হিসেবে আখ্যায়িত করে রাষ্ট্রদূত প্যারাগুয়েপ্রবাসী বাংলাদেশিদের সন্তানদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে অব্যাহতভাবে যোগাযোগের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তাদের বাবা–মাদের প্রতি আহ্বান জানান। আজকের শিশুদের যেন শিকড়হীন এক প্রজাতির পরিণতি মেনে নিতে নাহয় এ জন্য তিনি বাবা–মাদের তাঁদের কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এই শিশু-কিশোরেরা যেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য আগামী দিনগুলোতে বিশ্বপ্রাঙ্গণে তুলে ধরতে পারে, বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় অবদান রাখতে পারে, সেভাবে এই প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রদূত সবাইকে আহ্বান জানান।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার একটি দৃশ্য

এ ছাড়া গত তিন দশকে প্যারাগুয়েতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে সুনাম অর্জন করেছেন তাঁদের সততা ও কর্মদক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে, সে ধারাটিও যেন অক্ষুণ্ন থাকে সে ব্যাপারেও রাষ্ট্রদূত জুলফিকার সবার সহযোগিতা কামনা করেন। ব্রাজিলের বাংলাদেশ দূতাবাস প্যারাগুয়েপ্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য তাদের বর্তমান সেবামূলক কার্যক্রম আরও জোরদার করবে বলেও তিনি অঙ্গীকার করেন।

সবশেষে সারা দিনব্যাপী হরেক রকমের বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। বিজ্ঞপ্তি