নেদারল্যান্ডসে বৈশাখ উদযাপনে বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি

সংগীত পরিবেশন করছেন মমতাজ বেগম
সংগীত পরিবেশন করছেন মমতাজ বেগম

নেদারল্যান্ডসে পয়লা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠানে বিগত বছরের মতো এ বছরও তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশ হাউসের সবুজ প্রাঙ্গণ প্রায় এক হাজার অতিথির উপস্থিতিতে গত রোববার (২১ এপ্রিল) বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে বর্ণিল আয়োজনে বরণ করা হয়েছে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ। দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের পাশাপাশি বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও নরওয়ে থেকেও বাংলাদেশিরা এই উদযাপনে অংশগ্রহণ করেন।

নববর্ষকে স্বাগত জানাতে এবং বাংলা সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে ঐতিহ্যবাহী সাজসজ্জা, আলপনা, রংবেরঙের বেলুন, ফেস্টুন, পোস্টার ও বিভিন্ন ফুল দিয়ে সুসজ্জিত করায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসভবন বাংলাদেশ হাউস পরিণত হয় এক টুকরো বাংলাদেশে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশীয় নানা রঙের বর্ণিল পোশাকে বৈশাখী উদযাপনে সকাল থেকেই আসতে শুরু করেন। দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মুহম্মদ বেলাল ও তাঁর সহধর্মিণী ড. দিলরুবা নাসরিন অতিথিদের স্বাগত ও নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানের শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে। যেখানে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি বিদেশি অতিথিরাও অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে অংশগ্রহণ ও যুদ্ধবিগ্রহমুক্ত একটি পৃথিবীর প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে শান্তির বাণী শান্তি সুনিবিড় ওয়াসেনার মিউনিসিপ্যালিটি এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশাপাশি ডাচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, ওয়াসেনার মিউনিসিপ্যালিটির ডেপুটি মেয়র মিস ক্যারোলিন ক্লাভার বোমান, দ্য হেগ মিউনিসিপ্যালিটির সাবেক ডেপুটি মেয়র রবিন বলদেব সিং, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত, বিভিন্ন দূতাবাসের প্রতিনিধি, স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিসহ আওয়ামী লীগের নেদারল্যান্ডস শাখার নেতা ও সদস্যরা এ উদযাপনে যোগ দেন।

নেদারল্যান্ডসে বৈশাখ উদযাপনের কিছু দৃশ্য
নেদারল্যান্ডসে বৈশাখ উদযাপনের কিছু দৃশ্য

রাষ্ট্রদূত শেখ মুহম্মদ বেলাল তাঁর স্বাগত বক্তব্যে বলেন, বাংলা নববর্ষ উদযাপন এখন কেবল বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরার মাধ্যমে এ উদযাপন এখন পৃথিবীর সবার। ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদহীন এই উদযাপন আমাদের আশাবাদী করে তোলে। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিদেশিদের মধ্যে তুলে ধরার পাশাপাশি তাঁদের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে মাতৃভূমির উন্নয়নে কাজে লাগানোর আহ্বান জানান। তিনি ইউরোপে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও লালনের আদর্শ তুলে ধরার এবং বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখার আহ্বান জানান। তিনি শ্রীলঙ্কায় উপর্যুপরি বোমা হামলার নিন্দা জ্ঞাপন করে পয়লা বৈশাখ পালনের মাধ্যমে ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদহীন আদর্শ তুলে ধরার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

ওয়াসেনার মিউনিসিপ্যালিটির ডেপুটি মেয়র ক্যারোলিন ক্লাভার বোমান তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে উপস্থিত বাংলাদেশিদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন এবং ডাচ অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে তাদের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

রবিন বলদেব সিং তাঁর বক্তব্যে সব বাঙালিকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে এ ধরনের আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশিদের উপস্থিতি তাদের যে একাত্মবোধ প্রকাশ করছে তা দেখে তিনি মুগ্ধ। বাঙালির এই সংস্কৃতি তিনি স্বচক্ষে দেখে এসেছেন গত সপ্তাহে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকালে বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে তিনি শান্তি ও সম্প্রীতির মেলবন্ধনের এক অসাধারণ প্রতীক বলে অভিহিত করেন। রবিন বলদেব সিং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার প্রশংসা এবং বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যতম একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক বিস্ময় বলে অভিহিত করেন। ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদহীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নেদারল্যান্ডসে তুলে ধরার জন্য তিনি দ্য হেগের বাংলাদেশ দূতাবাসকে একটি মডেল দূতাবাস হিসেবে অভিহিত করেন।

বক্তব্য দিচ্ছেন শেখ মুহম্মদ বেলাল
বক্তব্য দিচ্ছেন শেখ মুহম্মদ বেলাল

অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও গণ্যমান্য অতিথিরা মঞ্চে এসে তাঁদের নিজ নিজ ভাষায় ও বাংলায় ‘শুভ নববর্ষ’ বলে সমবেতদের উদ্দেশে সম্ভাষণ জানান। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলায় মর্মান্তিকভাবে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে অনুষ্ঠানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। দেশটিতে নিযুক্ত শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূত এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সাংস্কৃতিক পর্বে ছোট ছোট বাচ্চাদের বিভিন্ন পরিবেশনা ছিল আকর্ষণীয়। বিদেশে জন্ম ও বেড়া ওঠা সত্ত্বেও এসব শিশুদের বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের যোগসূত্র সবাইকে মুগ্ধ করে। প্রবাসী বিভিন্ন শিল্পীদের পরিবেশনা ও স্থানীয় ব্যান্ড দল ত্রিমাত্রিক-এর সংগীত পরিবেশনা দর্শকদের আবিষ্ট করে রাখে। তবে এ পর্বের মূল আকর্ষণ ছিল বাংলাদেশের ফোক সংগীতের জনপ্রিয় শিল্পী মমতাজ বেগম এমপির পরিবেশনা। মমতাজ বেগম ও তাঁর দলের মাটি ও মানুষের জীবনঘেঁষা সাধারণ কথামালায় রচিত সংগীত পরিবেশনা উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মাতিয়ে তোলে। বিশেষ করে মমতাজ বেগমের সংগীত পরিবেশনের সময় বিভিন্ন বয়সী শিশুসহ দর্শকদের স্বতঃস্ফূর্ত নৃত্য সবাই উপভোগ করেন।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশি খাবারের পাশাপাশি বেশ কিছু উৎসাহী প্রবাসী বিভিন্ন সামগ্রীর স্টল নিয়ে বসেন। যেখানে রকমারি মুখরোচক খাবারের পরিবেশনা এবং নারী ও শিশুদের হাতে মেহেদি দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। অতিথিদের জন্য দূতাবাসের খাবারের আয়োজনে অন্য খাবারের পাশাপাশি ছিল পান্তাভাত, বিভিন্ন রকমের ভর্তা ও ইলিশ মাছ। নানা পিঠা, মিষ্টি, কেক ইত্যাদিও অতিথিদের পরিবেশন করা হয়। নানা স্টলের সমাহার এবং অতিথিদের আগ্রহ যেন বাংলাদেশের গ্রামবাংলার মেলার আবহই তৈরি করেছিল বাংলাদেশ হাউস প্রাঙ্গণে। বিজ্ঞপ্তি