কাননে কুসুম কলি

প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

প্রথম দিন অফিস জয়েন করতে গিয়ে বুক দুরুদুরু একটা ব্যাপার ছিল। স্কুল বলে কথা। তাও এই বিদেশ–বিভুঁইয়ে। যে আমি জীবনে এক লাইন ইংরেজিও গুছিয়ে লিখতে পারিনি, সেই আমাকেই করতে হবে মাস্টারির চাকরি। এটা নির্ঘাত ভয়েরই কথা। কীভাবে কীভাবে যেন চাকরিটা হয়েও গেল, সেটা ভেবেও খুব মজা পাচ্ছিলাম। কোনো দিন ভাবিনি, আমি স্কুলে জব করতে পারি। আমার বিদ্যাবুদ্ধির যা দৌড়, তায় আবার মেজাজমর্জি; একেবারে অগ্নিশর্মা। আর যা-ই হোক শিশুদের পড়ানো আমার কাজ নয়, সে আমি জোর দিয়েই নিশ্চিত ছিলাম। সে কারণেই, এখানে আসা অবধি অনেকে স্কুলে জবের পরামর্শ দিলেও কানে তুলিনি। অবশেষে আমারই এক সহকর্মীর উদ্যোগে খুব দায়সারা গোছের একটা রিজ্যুমি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ভাবিনি যে, তাঁরা আমায় ডাকবেন এবং আমি নির্বাচিত হব। যা হোক, চাকরিটা আমি পেয়ে গেলাম সত্যি।

ভয়ে ভয়ে থর থর বুকে গিয়ে হাজির হলাম প্রথম দিনের চাকরিতে। স্কুলটি বাসা থেকে মাত্র ছয় মিনিটের ড্রাইভ। তা ছাড়া বছর দুই আগে ওই স্কুলেই আমার কন্যা তার এলিমেন্টারি স্কুল সমাপ্ত করেছে। সেই হিসেবে স্কুলের প্রিন্সিপালসহ অনেক টিচারের সঙ্গে আমার বেশ ভালোই সখ্য ছিল। অন্য প্যারেন্টসদের থেকে আমি একটু বেশিই নিয়মিত ছিলাম মিটিং-সিটিংয়ে। স্কুল কাউন্সিলের মিটিংয়ে ছাত্রছাত্রীদের সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে আমার উচ্চকণ্ঠও কারও নজর এড়ানোর উপায় ছিল না। স্পেশাল নিড শিশুদের আইইপি তৈরির কাজেও সম্পৃক্ত ছিলাম বরাবরই। সুতরাং, বিগত দিনে স্কুলের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথা ভেবে মনকে একটু সান্ত্বনা দিলাম। একটু স্বস্তিও পাচ্ছিলাম এই ভেবে, প্রথম দিনেই আমার কাছে তারা শতভাগ আউটপুট আশা করবে না, আমায় শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়া তাদেরও দায়িত্ব বটে।

বিদেশ জীবন এমনই, আমরা যা ভাবি না কিংবা যা ভেবে রেখেছি মনে মনে, তার সবকিছুই উল্টে যায় কখনো কখনো। শিক্ষা, যোগ্যতা-দক্ষতা পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও জীবনযাপনের অনেক কিছুতেই আমাদের প্রতিমুহূর্তে অভিযোজন করতে হয়। নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হয়। নতুন করে অনেক কিছুই শুরু করতে হয়, টিকে থাকার তাগিদেই। এরই নাম পরবাস।

খুব সকালে উঠে দ্রুতই কন্যাকে তৈরি করে দিয়ে নিজেও গোছগাছ করে নিলাম। জানি যদিও যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না, তথাপিও একধরনের আনন্দ উত্তেজনা অনুভব করছিলাম ভেতরে। আজ প্রায় দুই বছর পরে যাব। কেউ কেউ হঠাৎ দেখে ভাববেন, লগ্নর আম্মু কেন এখানে? হবে হয়তো পুরোনো কোনো রেকর্ডের জন্য অফিসে এসেছেন। কেউ হয়তো এগিয়ে এসে হার্ট টু হার্ট টাচ করার জন্য জোরেশোরে হাগ করবেন। সেই আনন্দটুকু উপভোগ করার লক্ষ্যেই স্কুল শুরু হওয়ার খানিক আগেই পৌঁছে গেলাম স্কুলে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

যেমনটি ভেবেছিলাম ঠিক তেমনই উষ্ণ অভ্যর্থনা আর অভিনন্দন পেলাম স্বয়ং প্রিন্সিপালের কাছ থেকেই। তিনি নিজে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন আমার নির্ধারিত ক্লাসরুমে। শ্রেণিশিক্ষক আমাকে দেখেই গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন। মনে হলো কত দিনের চেনা আমি। আদতে আমার জন্যই বেচারীর ছিল সুদীর্ঘ অপেক্ষা। তাই অত্যানন্দে তিনি খানিকটা দিশেহারা।

ক্লাসরুমে ঢুকেই এক অন্য রকম আবহ চোখে পড়ল। যা আমাকে শুধু মুগ্ধই করল না আমি রীতিমতো অভিভূত হলাম। প্যারেন্ট হিসেবে ইতিপূর্বে দুই-একবার ক্লাসরুমে গিয়েছি বটে, তবে সেই দেখা আর শিক্ষকের চোখ দিয়ে দেখায় ঢের পার্থক্য। এখানকার শিশু শ্রেণির ক্লাসরুমের পরিবেশ যে বিশেষ কাঠামোতে তৈরি তা এক লহমায় বুঝে ফেললাম। ক্লাসের ভৌত অবয়ব আর সাজসজ্জা দেখে আমি যেন বইয়ের পাতায় পড়া ফ্রয়েবেলের কিন্ডারগার্টেনের বাস্তব প্রতিমূর্তিই দেখতে পেলাম।

জার্মান দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ ফ্রয়বেল শিশু শিক্ষায় প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা বলেছেন। যাকে তিনি কিন্ডারগার্টেন নামে অভিহিত করছেন। যার পারিভাষিক অর্থ শিশুবাগান। শিশুবাগানে শিশুরা ফুল-কলি আর শিক্ষকেরা সেই বাগানের মালি। মালির পরিচর্যা, যত্ন-আত্তি, সেবায় আজকের কলিরা কাল ফুল হয়ে ফুটবে। এমন কথাই ছিল ফ্রয়বেলের শিশুশিক্ষার তত্ত্বে। এই ক্লাসটি দেখে আমার প্রকৃত অর্থেই শিশুবাগানই মনে হলো। যেখানে প্রতিটি শিশুই এক একটি ফুল; ফুটন্ত গোলাপ, বেল, জুই-চামেলি। আর শিক্ষকেরা ঠিকই সেই বাগানের মালিকা। জল-তেল, ছায়া–মায়া দিয়ে প্রতিদিন হাঁটি হাঁটি পা পা করে এই বাগানের পরিচর্যা করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। সবগুলো কুঁড়িকে হৃদয়ের সবটুকু মমতা দিয়ে প্রস্ফুটিত করাই যেন শিক্ষকের কাজ। শিক্ষক মায়ের স্নেহের আঁচলে বেঁধে রেখেছেন কুসুমিত কিংবা অফুটন্ত সব কটি ফুলকে।

বিশাল আয়তনের এই বাগানে কী নেই শিশুদের জন্য। মাত্র ২০ জন ছাত্রছাত্রী। ওদের বসার জন্য চেয়ার (শিশুর সাইজের), ডেস্কের পাশাপাশি বিশাল বড় কার্পেট রয়েছে। আছে রংতুলি, ইজেল বোর্ড, ওয়াটার অ্যান্ড স্যান্ড টেবিল, নানা রকম খেলনাসামগ্রী, ড্রামা সেন্টার, বুদ্ধি পরীক্ষার পাজেল ও শিক্ষামূলক গেম। এ ছাড়া রয়েছে আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগের মতো বিশালদেহী এক প্রোমিথিয়ান স্মার্ট বোর্ড। চাহিবামাত্রই শিশুদের জন্য নানা রকম গেম, ছড়াগান, মুভি, ড্রামা, ছবি আঁকার সরঞ্জাম, লেখার সুবিধা সব এক নিমেষে হাজির করে দেয় যে বোর্ড। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসবই বয়স অনুযায়ী শিশু শিক্ষাকেন্দ্রিক! ফ্রোয়বেল বলেছেন, ‘শিশুরা খেলতে খেলতে শিখবে, খেলা, ছবি আঁকা, গান-বাজনার মাধ্যমে শিশুমনের আনন্দেই শিখবে, যা তাদের মনে শিক্ষাভীতি তৈরি করবে না, স্কুল ভালোবেসেই শিশুমনের আনন্দে স্কুলে আসবে।’

জীবনের অনেক বড় দায়িত্ব কাঁধে নেবে বলে, একদিন বিশ্বকে জয় করবে বলে ছোট্ট এই হৃদয়ে ধারণের উপযোগী অনেক কিছুই ওরা শিখছে প্রতিনিয়ত। অথচ কী আশ্চর্য, ওরা জানেও না, খেলা খেলা সারাবেলা করেই শিখে ফেলছে সব। এর মাঝেই ওদের জন্য রয়েছে সকাল–বিকেল দুইবেলা স্ন্যাক্সের ব্যবস্থা। খাবার জন্য থালা–বাসনসহ হাত ধোয়ার সাবান, টিস্যু পেপার, টয়লেট সাপ্লাই, প্রাথমিক চিকিৎসা বাক্স, গার্বেজ বিন এবং পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ঝাড়ু। শিশুদের জন্য ক্লাসরুমসংলগ্ন টয়লেটের ব্যবস্থাও রয়েছে (ছেলে ও মেয়ের জন্য আলাদা)।

ফুলের বাগানে যেমন নানা বর্ণ, গন্ধ ও জাতের কিংবা বর্ণহীন ও গন্ধহীন ফুলও থাকে, তেমনই একই ক্লাসে ধনী, গরিব, মধ্যবিত্তসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক শ্রেণির শিশুরা আছে। আছে নানা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের এবং নানা জাতেরও। একই সঙ্গে আছে আবার কিছু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুও। যাদের বুদ্ধি বিবেচনা বয়স অনুযায়ী অন্য দশজনের থেকে একটু আলাদা। অন্যদের তুলনায় তারা একাডেমিক বিষয়ে একটু পিছিয়েই থাকে। অথচ এই অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা বুদ্ধিগত ভিন্নতা সত্ত্বেও সব শিশু একই মর্যাদায় একই ক্লাসে একই রকম আদর–যত্নে শিক্ষকের কাছ থেকে জীবন পথের পাথেয় পাচ্ছে প্রতিদিন।

লেখিকা
লেখিকা

প্রথম দিনের কর্মসূচি হিসেবে আমার প্রথম কাজ ছিল নিবিড় পর্যবেক্ষণ। সেই কাজ করতে গিয়ে শ্রেণিকক্ষের ভৌত পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে আরও যে বিষয়টি আমার নজর এড়ায়নি সেটি হলো, শিশু ও শিক্ষকের সম্পর্ক। শিশুরা যখন ওদের বয়স ও উচ্চতার চেয়েও ওজনে ভারী এক বিশাল স্কুলব্যাগ ঘাড়ে চেপে স্কুলে আসে প্রতিদিন, তখন দরজা খুলে মায়ের মতো পরম মমতায় দাঁড়িয়ে থাকেন শ্রেণিশিক্ষক। ঘণ্টা পড়ার আগ পর্যন্ত শিশুরা মাঠে খেলাধুলা করে। খেলা শেষে সুন্দর সারিবদ্ধ লাইনে দাঁড়িয়ে একে একে ভেতরে প্রবেশ করে নিজ নিজ ব্যাগ, জুতো, শীতের জ্যাকেট খুলে ভদ্রস্থ হয়ে নিজ নিজ আসনে চলে যায়। এই জুতো ব্যাগ খুলে গুছিয়ে রাখতে অনেক শিশুরই সমস্যা হয়। সেই সময়টাতে শিক্ষকেরা নিবিড় তদারকি ও সহযোগিতা দিয়েই সবার জুতোর ফিতে, জ্যাকেটের বাটন, কিংবা জিপ খুলে-লাগিয়ে দেন। শিশুদের টয়লেটে যাওয়ার দরকার হলেও শিক্ষকের সাহায্যেই যেতে হয়। শিক্ষকের কাজ শুধু সাহায্য করাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষণও দেওয়া যাতে শিশুরা নিজেই নিজের কাজ করতে পারে। যাকে আমরা বলি লাইফ স্কিল। বছর শেষে সব শিশুই এই লাইফ স্কিলের সমান দক্ষতা অর্জন করে ফেলে।

শিক্ষাক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষের ভৌত পরিবেশের সঙ্গে শিক্ষক-শিশু সম্পর্ক যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি পাঠদানপদ্ধতি এবং প্রক্রিয়াও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। পাঠদানকে অংশগ্রহণমূলক, শিশুদের উপযোগী, আকর্ষণীয় ও আনন্দঘন করার জন্য দলীয় কাজ, ব্রেন স্টর্মিং, প্রশ্নোত্তর, কম্প্রিহেনশন, আবার কখনো কখনো অডিও ভিজ্যুয়াল এবং প্রদর্শনপদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বক্তৃতা বা লেকচার মেথডের কোনোই প্রয়োগ শিশু শ্রেণিতে নেই। অথচ আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় সারা জীবন বক্তৃতাপদ্ধতিরই প্রয়োগ দেখেছি। এখানে বহুমুখী কর্মকেন্দ্রিক পদ্ধতির সমন্বয়ে শিশুরা মনের আনন্দ ও ভয়হীন পরিবেশে কখনো মেঝেতে বসে, কখনো চেয়ার–টেবিলে বসে, কখনো মিউজিক চালিয়ে, কখনো ড্যান্স করতে করতে শিক্ষকের নির্দেশনা মেনে ক্লাস রুমের কার্যক্রম সম্পন্ন করে।

শিক্ষক-শিশুর এই ভয়হীন, মধুর তথা বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্কের ফলে শিশুরা স্কুলে নিরাপদ বোধ করে। ওদের মাঝে আস্থা তৈরি হয়। ভরসা করতে শেখে। বিশ্বাস রাখে। সম্মান-শ্রদ্ধা, ভালোবাসার পারস্পরিক সম্পর্কের যে ভিত তৈরি হয়, তা ভবিষ্যৎ জীবনে শিশুদের মননে উদারতা, বিশ্বস্ততা, ও ভালোবাসার উপলব্ধি তৈরি করে। আর এই আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসাই ওদের স্ব–স্ব ক্ষেত্রে আরও বেশি দৃঢ়, আরও প্রত্যয়ী করে তোলে। ওরা আত্মমর্যাদাশীল, সচেতন ও সুনাগরিক হয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। এসব শিশুই একদিন জাতি গঠনে তথা দেশ গঠনে ভূমিকা রাখে।

উল্লেখ্য, শিশু শ্রেণির ক্লাস রুটিনের একটি বড় অংশই হলো উন্মুক্ত খেলা। এই খেলা দলীয়, নির্বাচিত সঙ্গীর সঙ্গে কিংবা একাকীও হয় কখনো সখনো। এই খেলার মধ্য দিয়েই শিশুরা পরস্পরের প্রতি সহনশীল, সদাচরণ, সহযোগিতা, শ্রদ্ধাশীল ও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। এর মধ্য দিয়ে ওদের নেতৃত্বের বিকাশও ঘটে। শিশু শ্রেণির শিখন-শিক্ষণের প্রধানতম শর্তই হলো এই সব মানবীয় গুণাবলির সুষ্ঠু, সুস্থ ও পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়তা প্রদান।

প্রথম দিনের অভিজ্ঞতায় আমি আমার ভেতরে এক নতুন মানুষকে আবিষ্কার করলাম। খেলাচ্ছলে কোমল কচি-কাঁচাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে আমিও ফিরে গিয়েছিলাম আমার দুরন্ত, দুর্বার, ভয়ার্ত-ভয়াল শৈশবের দিনগুলোতে। আমাদের শৈশবে মূলত স্কুলকেন্দ্রিক ভয় ছিল শরীরের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। বিদ্যাশিক্ষা থেকে শাসনের নামে শিক্ষকদের অহেতুক তর্জন-গর্জনই ছিল বেশি। অকারণ হুংকার দিয়ে শিশুমনে ভীতির সঞ্চার যত সহজ ছিল শিশুদের ভালোবাসার বিনিময়েও যে সম্মান অর্জন করা যায় সেই ধারণাও ছিল একেবারেই অযৌক্তিক। যদিও এখনকার শিশুরা ভাগ্যবান যে, ওদের বেত্রাঘাত সইতে হয় না কারণে অকারণে আর।

এ কথা সত্য যে পাশ্চাত্যের সঙ্গে আমাদের তুলনা চলে না। আমাদের সম্পদের অপ্রতুলতা, দক্ষ জনশক্তির অভাব, তথা পর্যাপ্ত রিসোর্সের অভাবে আমরা অনেক কিছুতেই বিশ্ব মানে পৌঁছাতে পারব না। তবুও, আমাদের সমস্যাগুলো তো সমস্যাই। আজ না পারি কাল হয়তো পারব। দেশ তো নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষাক্ষেত্রে নয় কেন? বহুকাল থেকেই আমরা একটা কথা বিভিন্ন সময়ে শুনে অভ্যস্ত, আমাদের শিক্ষা কর্মকেন্দ্রিক নয়, বাস্তবসম্মত নয়, যুগোপযোগী নয়, জীবনঘনিষ্ঠ নয়। কিন্তু এত এত ‘নয়’ জানা সত্ত্বেও আমাদের কী করণীয় ছিল, হয় আমরা বুঝে উঠতে পারিনি নয়তো আমরা গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, যখন আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে, তখন আমাদের সেই শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক নিয়েই নানাভাবে আমরা ঝুঁকির মুখে পড়ছি। সেই ঝুঁকি আমাদের সামনে এক ভয়ংকর চিত্র উপস্থাপিত করছে। যা দেখে আদতেই শিক্ষাব্যবস্থার কোথাও নৈতিকতা, উদারতা, শ্রদ্ধা-সম্মান, সহমর্মিতা, ভালোবাসার বিন্দুমাত্র লেশ আছে বলেই মনে হয় না।

আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে কারিকুলাম প্রণয়ন থেকে শুরু করে, শিক্ষাদানপদ্ধতি ও কৌশল, মূল্যায়নপদ্ধতি, শিক্ষকদের যোগ্যতা, দক্ষতাসহ শ্রেণিকক্ষের ভৌত সুবিধাদি নিয়ে কাজ করার জন্য অনেক কথাই বলতে পারি। বস্তুত, এসব বিষয়ে আমাদের অনেক পর্যবেক্ষণও রয়েছে। কিন্তু শিশুদের মৌলিক মানবিক গুণাবলির চর্চা করার জন্য বিদ্যালয়ের যে সুস্থ, সুন্দর, উদারনৈতিক পরিবেশ আর শিক্ষকের পরম স্নেহ-ভালোবাসার দরকার তা আমরা কোথায় পাব? কীভাবে এর আমদানি করব? এর জন্য আদতেই আমাদের রিসোর্সের উৎস কী হতে পারে? এমন প্রশ্নের উদ্রেক বর্তমান সময় এবং আমাদের চারপাশ অবলোকন করেই যে কারও মনে হতেই পারে। আর তা অসংগতও নয়।

এ কথা সত্য, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম নিয়ে কথা বলার মতো যথেষ্ট বোদ্ধা আমি হয়তো নই। তবে দীর্ঘদিন উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করার ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার বলে এর ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো সহজেই নজরে এসে যায়। আমাদের প্রাথমিক স্তরের শিশুদের প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জনের যেসব সূচক ও সূচক নির্ণয়ের বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়েছে, একইভাবে সেই যোগ্যতা অর্জনের জন্য যেসব কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অনেকাংশেই বাস্তব বোধ বিবর্জিত, বিতর্কিত, দৃশ্যমান ও পরিমাপযোগ্য নয়। এককথায় সূচকের অনেকগুলোই স্মার্ট (SMART) নয়। সুতরাং, এমন যোগ্যতা আমাদের শিশুদের জীবনঘনিষ্ঠ হবে না সেটাই স্বাভাবিক।

শিশুর সার্বিক বিকাশে আমাদের যখন টেকসই, জীবনঘনিষ্ঠ, কর্মকেন্দ্রিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা জরুরি দরকার, ঠিক তখনই ধর্মান্ধতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পাঠ্যপুস্তক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, শিশুর জন্য আবশ্যিক বিষয়সমূহকে কেবল ধর্মের মোড়কেই আবদ্ধ করে বাতিল করে দেওয়া হয়। যখন শিক্ষকই হবেন নৈতিকতা-উদারতার মডেল তখনই আমার সোনার বাংলায় শুরু হয় শিশুহত্যা, শিশু ধর্ষণের মহোৎসব! আমাদের রক্ষকেরাই চিরকাল ভক্ষক যখন-তখন মসীর চেয়ে অসীরাই শক্তিশালী হবে, ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় তারাই টিকে থাকবে। আর আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র থাকবে হিমশীতল নীরবতা নিয়ে হাইবারনেশনে! আমাদের ধন নেই ঠিকই, আমাদের মনও যে নেই সে কথাও প্রমাণিত সত্য।

খুবই আনন্দের কথা দেশ এগিয়ে চলছে, উন্নয়নের জয়যাত্রায় আমরাও শামিল হতে চাই। আমাদের জিডিপি, জিএনআই বছর বছর বেড়ে গিয়ে বাড়ুক স্বনির্ভরতা। পরিকাঠামোয় ঝাঁ–চকচকে সোনার মোড়ক দিয়ে মনন আর মস্তিষ্কের কোটরে কোটরে গোবর-ছাই মাটি পুরে দিলে একদিন উন্নয়নের এই উপরিকাঠামো ধসে পড়বে বলেই মনে হয়। উন্নয়নের এই যে বহুতল ভবন, এর ভিত্তি অতীব দুর্বল। একদিন ঘুণপোকারা সদলবলে আক্রমণ করে সব বিনাশ করে ফেলবে, সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়। প্রদীপের পাদদেশ যেমন অন্ধকারে ঢেকে থাকে, তেমনি আমাদের উন্নয়নের মহাসড়কের সড়কবাতির নিচেই আমরা লাখো জনতা; বড় দুর্বিষহ, বিষময় জীবন যাপন করছি পচা নর্দমার গন্ধের মতো ছড়িয়ে থাকা অশিক্ষার দম্ভের বলি হয়ে!

তবু, দিন শেষে একটি আশার প্রদীপ জ্বালতে চাই, স্বপ্ন দেখতে চাই প্রিয় স্বদেশকে নিয়ে। বিশ্বাস করি এ আঁধার একদিন ঘুচবে। বাবা-মা হিসেবে সন্তানের জিপিএ প্রাপ্তির চেয়ে মানুষ হয়ে ওঠাকেই অধিক গুরুত্ব দেব আমরা। নইলে আমাদের চারপাশে যে ঘৃণা, যে হিংসা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, একদিন মহিরুহ হয়ে বিশ্বকেই জানান দেবে যে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা যে হিংসার বীজ বপন করেছি তার ফল আমাদের ভোগ করতেই হবে। আমাদের সন্তানেরাই খুনি হবে, ধর্ষক হবে।

আসুন, সমস্বরে বলি, মনোবৈকল্য দূর করে সত্যিকারের মননশীল, প্রাণময় মানুষ চাই। যাদের দেশপ্রেম থাকবে, আত্মমর্যাদা বোধে গরীয়ান হবে, যাদের হাতেই গড়ে উঠবে আগামীর স্বপ্নের সোনার বাংলা। ভালো থাকবে লাল–সবুজের বুকের জমিন। সঠিক পরিচর্যা পেলে আমাদের প্রিয় ফুলকলিরাই একদিন লাল–সবুজের ঝান্ডা উঁচিয়ে ধরবে বিশ্বের দরবারে। সে জন্য চাই সরকারি সময়োপযোগী সঠিক পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন! (চলবে)