আমার মেয়ে-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এত দিন যুদ্ধটা ছিল আমার জীবনের সঙ্গে। এখন শুরু হলো নিজের সঙ্গে যুদ্ধ। কারও কারও দুর্ঘটনা হয় শুনেছি। এ রকম দুর্ঘটনা যে আমাদেরও হবে, কখনো ভাবিনি। প্রথম মাতৃত্বের সুসংবাদে যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম, এবারের ঘটনাটা টের পেয়ে ঠিক ততখানি মুষড়ে পড়লাম। একটা অটিস্টিক বাচ্চার পরে অন্য আরেকটা বাচ্চা কেমন হবে, সে আশঙ্কা কিছুতেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। জাহিদ খুব চাইছে আমরা বাচ্চাটা রেখে দিই। কিন্তু জানি সে আমাকে কোনো কিছুতেই খুব জোর করবে না। কাজ নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকতে হয় তাঁকে। তাই বাচ্চা পালার দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হয়। আমার মানসিক অবস্থাটা সে জানে। কিন্তু আরেকজন জোর করছেন আকারে ইঙ্গিতে। তিনি আমার শাশুড়ি মা। একদিন আড়াল থেকে ছেলেকে বলতে শুনলাম, ‘এটা আল্লাহর তরফ থেকে তোদের জন্য নেয়ামত। আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন, এত দিনে। ছেলে না হোক, অন্তত একটা সুস্থ মেয়ে বাচ্চা হলেও হোক তোদের, না হলে আর কেউ থাকবে না। তা ছাড়া তিতলিকেই বা দেখবে কে?’

এই শেষের কথাটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। দুই দিন পর হাসপাতালে যাব ভাবছিলাম। সারা রাত ভাবলাম। দুই চোখের পাতা এক করতে পারিনি। একবার তিতলির মুখটা ভাসে চোখে, আর তারপরই এক অনাগত শিশুর কচি মুখ। না, শেষ পর্যন্ত আর পারলাম না। মা হয়ে এত কঠিন হতে। বাচ্চাটাকে রেখে দিলাম। এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোনো আনন্দ নেই, আছে শুধু দুরুদুরু বুকে প্রতীক্ষা। আল্লাহকে যে কত ডেকেছি। আরেক ভয় ছিল তিতলিকে নিয়ে। ও এমনিতে বেশ শান্ত। কিন্তু মাঝেমধ্যে খেপলে অস্থির হয়ে যায়। এলোপাতাড়ি হাত–পা ছোড়ে। আমি ছাড়া কেউ ওকে তখন শান্ত করতে পারে না। যদি কখনো কোনো কারণে আমি আঘাত পাই, পেটের বাবুটাকে সেই ভয়ে অনেক সাবধানে রাখি। রাতে আমার আর তিতলির মাঝে বালিশ দিয়ে ঘুমাই। মাঝেমধ্যে ভয়ে ঘুমও হয় না।

প্রতীক্ষার পালা একসময় ফুরাল। এবারও মেয়ে হলো আমার। মেয়ের মুখ দেখে এত মায়া টলমল করে বুকে। কিন্তু ভয়ে খুশি হতে পারি না। তিতলি ছোট বোনকে দেখে কিছু বুঝল কিনা জানি না। প্রথমে কোনো ভাবান্তর নেই। বাড়িতে যাওয়ার পর কিছু একটা বুঝতে পেরেছে মনে হয়। কখনো খুব আদর করতে চায়, টিপে, চেপে অস্থির। তখন আবার বুঝিয়ে–সুজিয়ে থামিয়ে রাখাও কঠিন। একদিন আরেকটু হলে শ্বাসনালির ওপরে চাপ পড়ে গিয়েছিল। কী প্রচণ্ড ভয়ই না পেয়েছিলাম। আবার মাঝেমধ্যে ফিরেও তাকায় না। নতুন বাচ্চার চেয়ে তিতলিকেই আমার বেশি সময় দিতে হয়। ও তো আসলে এখনো আরেকটা শিশুই। সবচেয়ে কষ্ট হয় বাথরুম নিয়ে, অনেক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ওকে ট্রেনিং দিতে।

এত দিন বাসায় নিয়মিত কোনো সহকারী পাইনি। তিতলির কারণেই কিছুদিন পর পর লোক পালায়। এবার ভাবলাম, আর পারছি না। এ ব্যাপারে আরও সিরিয়াস হতে হবে। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে, বেশ কিছু সংস্থার সঙ্গে কথা বলে, অনেকগুলো ইন্টারভিউ নিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা মেয়েকে মনে ধরল। শিক্ষিত মেয়েরা অচেনা বাসায় আসতে ভয় পায়। ছেলে শিক্ষক বা সাহায্যকারী পাওয়া যায়। কিন্তু মেয়ের জন্য ছেলে রাখতে সাহস হয় না। যা শুনি আজকাল চারদিকে। আমার আর জাহিদের মেয়েটাকে বেশ ভালো লেগেছে। সবচেয়ে বড় কথা, তিতলি সুমনাকে বেশ পছন্দ করেছে মনে হলো। অন্তত ট্রায়ালের প্রথম এক সপ্তাহ তেমন কোনো ঝামেলা করেনি। আমি এত দিন পর আমাদের ছোট মেয়ে আশার দিকে একটু মনোযোগ দিতে পারলাম।

আশা হয়েছে তিতলির উল্টো। খেতে চায় না একদম। ঘুমও খুব অল্প। আমি সুযোগ পেলেই ওর মুখের দিকে, চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। বুঝতে চেষ্টা করি ওর চাহনি। প্রথম কয়েক মাস আমি তিতলিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় জাহিদ আর আমার শাশুড়ি মা ওর অনেক দেখাশোনা করেছে তাদের মতো করে। এ কারণে নিজেকে একটু অপরাধীও লাগে। সেটা পুষিয়ে দেওয়ার জন্যই আরও যেন বেশি চেষ্টা করতাম আমি।

একদিন রাত দুটোয় আশাকে কোলে নিয়ে বোতলে করে দুধ খাওয়াচ্ছি আমি আর ঘুমে ঢুলছি। হঠাৎ আশা মিষ্টি করে ভুবন ভোলানো এক হাসি দিল। তিতলি আর জাহিদ তখন গভীর ঘুমে। ঘুমন্ত জাহিদকে ঘুম থেকে টেনে তুললাম আমি। আশা তখনো হেসেই চলছে। মনে হচ্ছিল স্বর্গ থেকে এক ছোট্ট পরি নেমে এসেছে আমাদের ঘরে। আমি জাহিদের বুকে মাথা রেখে খুশিতে কেঁদে ফেলি। ধীরে ধীরে দেখা গেল, তিতলিকেও সে চিনতে শুরু করেছে। বড় বোনকে দেখলেও হাসি দেয়। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ আমি কমিয়ে দিলেও তারা আমাকে ছাড়ে না। প্রতিবেশীরাও। আশাকে দেখতে এসেও অনেকে অনেক কথা শুনিয়ে গেল উপদেশ দেওয়ার ছলে। তিতলিকে দেখলে তারা এমনভাবে তাকায় যে, আমার গা জ্বলে যায়। যেন পাগল দেখছে। সবার সব কথা সহ্য করে আমি আমার দুই মানিককে বুকে চেপে খালি আল্লাহর কাছে কাঁদি।

সহকারী সুমনা আসার পর তিতলির বেশ কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বাথরুমটা এখন নিজেই করতে পারে। আগে মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনা হতো। খেতেও পারে নিজের হাতে। বেশ কিছু নতুন শব্দ শিখেছে। ছবি আঁকার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পরপর এসে আশাকে দেখে যায়। একটা জিনিস আজকাল বেশ বোঝা যায় সেটা হলো, আশার জন্য ওর মনে ভীষণ মায়া। আশা কোনো কারণে কাঁদতে থাকলে মাঝেমধ্যে ছুটে আসে।

আশা যেদিন প্রথম ‘বাবাহ’ বলল, আমি আমার নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ওকে কোলে নিয়ে আমি তিতলিকে ছবি আঁকতে সাহায্য করছিলাম। হঠাৎ বাবাহ শুনে আমি চমকে তাকাই। জাহিদ অফিসের কাজ করছিল। ছুটে গিয়ে ওকে খবরটা দিলাম। ও মনে হলো বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু তারপর থেকেই আশা বাকবাকুম করে বাবাহ ডাকতে থাকে। এরপর আরও কত শব্দ। আমাদের বাসাটা কচি মুখের বুলিতে মুখর হয়ে ওঠে।

সুমনা পড়ালেখা শুরু করবে আবার। শুরু হলো তিতলির জন্য স্কুল খোঁজা। অনেক খুঁজে খুঁজে বাসা থেকে বেশ দূরে একটা স্কুল পাওয়া গেল। দিনে চার ঘণ্টা। ভীষণ টেনশনে ছিলাম। বাড়ির বাইরে অচেনা পরিবেশে কেমন থাকে। ওর যদি কিছু খারাপ লাগে, সে তো বলতে পারবে না। খিদে পেলে, বাথরুম লাগলে, এগুলো তো আমি আর সুমনা বুঝতাম। এখন কী হবে? যদি খুব বেশি অস্থির করে, আঁচড়ে টাচড়ে দেয়, কেউ থামাতে না পারে? এই প্রথম মনে হলো, আমার মেয়েটা কত অসহায়। আবার ওকে তো অন্তত কিছুটা হলেও নিজের কাজ করা, চলা শিখতে হবে। দিনের পর দিন বুঝিয়েছি। প্রথম দিন রেখে আসার সময় বেশ চিৎকার করছিল। আমি একরকম পালিয়ে এসেছি। পুরো চার ঘণ্টা স্কুলের সামনে বসে ছিলাম। ওদিকে বাড়িতে আশাকে রেখে এসেছি বুয়ার কাছে। শাশুড়ি মা যদিও আছেন, তবুও ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। সময়মতো ডায়াপার বদলাবে তো। যদি বেশি কান্নাকাটি করে। এভাবে টানা এক সপ্তাহ যাওয়ার পর পরিস্থিতির একটু উন্নতি হয়েছে। একজন টিচারকে ওর কিছুটা পছন্দ হয়েছে, শিখা মিস। তাঁর সঙ্গেই আঠার মতো লেগে থাকছে।

স্কুলে কতটুকু কী শিখছে জানি না। তবে ছবি আঁকতে বেশ পছন্দ করছে এটা বুঝি। কম্পিউটারেও কী যেন সব করে। খেলার মাঠে খেলতে নিয়ে যায়। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব না হোক, মারামারি তো করছে না। এটুকুতেই আমি ভীষণ খুশি। আশার বয়স তিন হওয়া পর্যন্ত আমি বাসাতেই ছিলাম। এই মেয়ে দুরন্ত। বোন স্কুল থেকে এলে ছুটে চলে যাবে দরজার কাছে। ওর ঘাড়ে পিঠে উঠে বসে থাকবে। ওর নিজের খাওয়া জোর করে তিতলির মুখে ঢুকিয়ে দিতে চায়। তিতলি যেন ওর একটা খেলনা।

ঘরে থেকে আমি প্রচণ্ড হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। সামাজিক কোনো জীবন নেই। জাহিদ অনেক দিন ধরেই বলছে কাজে ফিরতে। আমার সাহস হচ্ছিল না। অবশেষে আশা যখন স্কুল শুরু করল, আমিও একটা পার্টটাইম কাজে ঢুকে গেলাম। তিতলির স্কুলের পাশেই আরেকটা বাচ্চাদের স্কুলে। যেন ওকে আনা–নেওয়া আমিই করতে পারি।

প্রথম দিন বাসা থেকে বেরিয়ে খুব নার্ভাস লাগছিল। পারব তো? কাজটা কি ঠিক করলাম? বাচ্চা দুটোর কোনো অসুবিধা হবে না তো? তবে এ কথা ঠিক, অনেক অনেক দিন পরে মনে হচ্ছিল, আমারও একটা স্বাভাবিক জীবন আছে। পাশে বসে আছে তিতলি, যার দৃষ্টিটা ঠিক স্বাভাবিক নয়, আমারই আত্মজা। কিন্তু, তবুও, জীবন থেমে থাকবে না। আমিও তো একটা মানুষ। (চলবে)

তামান্না ইসলাম: ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।