জাপানের আরাশিয়ামার বাঁশবন ও জিনরিকিশা

নোনোমিয়া মন্দিরে তরুণীদের প্রার্থনা
নোনোমিয়া মন্দিরে তরুণীদের প্রার্থনা

অনেক দিন ধরেই মনে মনে ইচ্ছে ছিল এই জায়গাটিতে যাওয়ার। এই জায়গাটি মানে জাপানের সাবেক রাজধানী এক হাজার দুই শ বছরের প্রাচীন নগর কিয়োতোর আরাশিয়ামা। দুটি কানজি অক্ষর যথাক্রমে ‘আরাশি’ (ঝড়, তুফান) ও ‘ইয়ামা’ (পাহাড়, পর্বত) দ্বারা সৃষ্ট আরাশিইয়ামা বা আরাশিয়ামা শব্দটি। এটা কিয়োতো তথা জাপানের জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানীয় কতিপয় পর্যটন কেন্দ্রের অন্যতম। জীবনে একবার হলেও কিয়োতো গিয়ে এই আরাশিয়ামা দেখেননি এমন জাপানি নাগরিক যদি থেকে থাকেন তাহলে বিরলই বলতে হবে। কপাল ভালো যে একটি জাপানি সংগঠনের অন্যতম পরিচালক হিসেবে দাপ্তরিক কাজ ও সেমিনার উপলক্ষে কিয়োতো শহরে এ বছরের ২১, ২২ ও ২৩ মার্চ আমার অবস্থান করার সুযোগ হয়েছে। যদিও এটা আমার তৃতীয়বার কিয়োতো যাওয়া। এর আগে অন্য স্থানে গেলেও আরাশিয়ামা যাওয়া হয়নি। এবার কাজের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি প্রসিদ্ধ স্থান পরিভ্রমণ করা গেল তার মধ্যে আরাশিয়ামা অন্যতম।

কিয়োতো প্রদেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্রের অন্যতম হচ্ছে আরাশিয়ামা অঞ্চল। শহরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত আরাশিয়ামা সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিখ্যাত তার ঋতুভিত্তিক সৌন্দর্য মূর্ত পাহাড়; পাহাড়সংলগ্ন ‘ওওই’ নদীর ওপর কংক্রিট ও কাঠের তৈরি তোগেৎসুকিয়োও (তোগেৎসু সেতু, নবম খ্রি.), ১২-১৩টি বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দির ও একাধিক শিন্তাও ধর্মীয় মন্দির বা জিনজা; আরাশিয়ামা তাকেবায়াশি বা সাগানো তাকেবায়াশি ইত্যাদির জন্য।

বাঁশবনের ভেতরে জিনরিকিশায় কিমানো পরা তরুণী
বাঁশবনের ভেতরে জিনরিকিশায় কিমানো পরা তরুণী

বিশেষ করে আরাশিয়ামা দুটি ঋতুতে তার অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বসন্তকাল আর হেমন্তকালে। বসন্তকালে দুধে-আলতায় মেশানো সাকুরা ফুলে ছেয়ে যায় সব পাহাড় ও চতুর্দিক। একেবারে গোলাপি অমরাবতী যাকে বলে! আর হেমন্তকালে মোমোজি বা ম্যাপল বৃক্ষের লাল-কমলা-হলদে রঙের পাঁচটি খাঁজকাটা পাতার সৌন্দর্যে আলোকিত হয়ে যায় সব অঞ্চল। সেই সঙ্গে মেশে সাকুরা, হিনোকি, কোইদে প্রভৃতি বৃক্ষ ও বুনো গাছ, লতাপাতা গোটার সবুজ-নীল রং। ফলে হেমন্তকালেও আরাশিয়ামা হয়ে ওঠে অনন্য এক স্বর্গলোক। প্রকৃতির এই সৌন্দর্যকে আরও এক ধাপ অতুলনীয় করে তোলে সন্ধ্যা রাতের আলোকসজ্জা। বৈদ্যুতিক স্পট-লাইটের আলোয় যখন ঝিরঝিরে মৃদু বাতাসে ফুলের বল্লরী, পত্রগুচ্ছ ও শাখা প্রশাখা দুলতে থাকে তখন আলো ঝলমল বিচিত্র জ্যোতির্ময়তায় উদাসী ভাবুক হয়ে যান বাক্যহারা। সাধারণ মানুষ হয়ে পড়েন বিহ্বল। আর তখন নড়েচড়ে ওঠে ‘হাইজিন’ তথা হাইকু-কবিদের কলম, পেনসিল। ক্রমাগত ঝলসে উঠতে থাকে অগণন ক্যামেরার ফ্লাশ! এই অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রকৃতিপাগল সাধারণ জাপানি ও সৃজনশীল মানুষ পরিভ্রমণে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন।

এ ছাড়া সারা বছরই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় থাকে এখানে নানা কারণে, যেমন: এক. মূল্যবান রাষ্ট্রীয় ও বিশ্ব সাংস্কৃতিক সম্পদ ‘তেন্রিউজি’ (১৩৪৫ খ্রি.) বৌদ্ধ মন্দির পরিদর্শন। দুই. জাপানের নিজস্ব আদি ধর্ম শিন্তাও ধর্মীয় মন্দির নোনোমিয়া জিনজায় উপাসনা। তিন. আরাশিয়ামা তাকেবায়াশি বা সাগানো তাকেবায়াশি দর্শন। চার. আরাশিয়ামা বা সাগানো রোমান্টিক লোকোমোটিভ রেলভ্রমণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বাঁশবনের ভেতরে জিনরিকিশায় নবদম্পতি
বাঁশবনের ভেতরে জিনরিকিশায় নবদম্পতি

এসবের মধ্যে নোনোমিয়া জিনজা ও আরাশিয়ামা তাকেবায়াশি বা সাগানো তাকেবায়াশি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। নোনোমিয়া জিনজা তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় প্রেম-ভালোবাসা ও শিক্ষাদীক্ষার জন্য। এই মন্দিরটি কখন স্থাপিত হয়েছে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না। তবে জাপানের ৫২তম শাসক সাগা তেননোও বা সাগা সম্রাটের (৭৮৬-৮৪২ খ্রি.) শাসনকালের (৮০৯-৮২৩ খ্রি.) সঙ্গে মন্দিরটির ইতিহাস গভীরভাবে জড়িত। তিনি শুধু শাসকই ছিলেন না, একজন খ্যাতিমান লিপিকলাবিদ (ক্যালিগ্রাফার) ও কবিতাপ্রিয় মানুষও ছিলেন। তিনিই রাজকীয় স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতা যাকে বলে ‘নাইএন’-এর প্রবর্তক এবং জাপানের ইতিহাসে প্রথম ‘চা পানকারী’ বলে পরিচিত। তাঁর একাধিক স্ত্রী ও সন্তান ছিল।

বাঁশবনের ভেতরে জিনরিকিশার বিশেষ পথ
বাঁশবনের ভেতরে জিনরিকিশার বিশেষ পথ

কথিত আছে, নোনোমিয়া জিনজা মন্দিরটি নির্মিত হয় সম্রাট সাগানো তেননোওর দশমতম কন্যা তথা রাজকুমারী জিনশি-নাইশিননোও যখন মিয়ে প্রদেশে অবস্থিত শিন্তাও ধর্মীয় সম্রাটের রাজকীয় মহামন্দির ইসে জিনগুউতে রাজকীয় প্রতিনিধি তথা সাইগুউ হওয়ার জন্য এক বছর বা ততোধিক সময়ব্যাপী যথার্থভাবে কুমারীত্ব বজায় রেখে নিজেকে সচ্চরিত্র, উপযুক্ত করে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রয়োজন হয় তখন। এটা ছিল ‘সাইওও’ নামক একটি রাজকীয় রীতি। পরবর্তীকালে ৯৬তম সম্রাট গো দাইগোর (১২৮৮-১৩৩৯ খ্রি.) সময়ে এই রীতির বিলুপ্তি ঘটে ‘নামবোকুচোও ছেনসোও’ বা দক্ষিণ-উত্তরাঞ্চলীয় রাজবংশগত যুদ্ধের পর। কিন্তু ‘নোনোমিয়া জিনজা’ হিসেবে এটা তখনই প্রতিষ্ঠা লাভ করে, একসময় শিক্ষা ও ধনসম্পদের দেবী ‘বেনজাইতেন’ তথা ভারতীয় সরস্বতী দেবীর উপাসনা মন্দিরও প্রযুক্ত হয়। বহু বছরের ব্যবধানে আজও এর জনপ্রিয়তা আদৌ ম্লান হয়নি। কালক্রমে আরাশিয়ামা বা সাগানো তাকেবায়াশি নামক পথও নির্মিত হয় আরাশিয়ামা শহরের মূল সড়ক থেকে নোনোমিয়া জিনজা পর্যন্ত। প্রাচীনকালে জাপানে রাজ বংশধরদের জন্য প্রধান বাহন ছিল কাঁধে বাহিত কারুকার্যময় ‘কাগো’ বা পালকি, কাজেই রাজকুমারীরা শিন্তাও-পুরোহিত ও খানসামা পরিবেষ্টিত হয়ে এখানে আসা–যাওয়া করতেন পালকিতে করে। সেটাই কবে, কখন অনুষ্ঠান বা উৎসব ‘সাইগুউ গিয়োওরেৎসু’ বা সাইগুউ সমাবেশ হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের ২১ তারিখে গবেষণার বিষয়। শুধু সাইগুউই নয়, এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নানা ধরনের অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হচ্ছে আরাশিয়ামাজুড়ে। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে সাইগুউ সমাবেশ, যা অনুষ্ঠিত হয় আরাশিয়ামা বা সাগানো তাকেবায়াশির বর্তমান পাকা রাস্তা পরিভ্রমণ করার মধ্য দিয়ে। উৎসবের সময় নানা রঙের আলোসজ্জায় তাকেবায়াশি হয়ে ওঠে অন্য রকম রহস্যময় এক গ্রহ! উল্লেখ্য, সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত ৬৬০ বছরের মধ্যে ৬৪ জন ‘হিমেগিমি’ বা ‘রাজকন্যা’ নোনোমিয়া নামক রাজকীয় ভবনাদি ও উদ্যানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন বলে কথিত আছে।

জিনরিকিশায় দুজন তরুণী
জিনরিকিশায় দুজন তরুণী

জাপানি ভাষায় ‘তাকে’ শব্দের অর্থ বাঁশ আর ‘হায়াশি’ (উচ্চারণগত কারণে বায়াশি) অর্থ বন, জঙ্গল বা বাগান ইত্যাদি। কাজেই বাংলায় সম্পূর্ণ নাম হচ্ছে আরাশিয়ামা বাঁশবন বা সাগানোর বাঁশবন’। এটা বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর বাঁশবন বলেও খ্যাতি অর্জন করেছে। শহরের মধ্যে এমন বাঁশবন অন্য কোনো দেশে কল্পনাই করা যাবে না! বাঁশ জাপানের দৈনন্দিন জীবনযাপন, খাদ্য ও শিল্পকলার সঙ্গে অকাট্য অনুষঙ্গ। এই বাঁশবনটির দৈর্ঘ্য ৫০০ মিটার। কিন্তু প্রবেশপথের থেকে আলাদা একটি পথ নির্মাণ করা হয়েছে শুধু হাতে টানা জিনরিকিশার জন্য মন্দির-ফটকের কাছাকাছি পর্যন্ত স্থানীয় পর্যটন উন্নয়নকেন্দ্র সাম্প্রতিককালে। হাতে টানা জিনরিকিশা চালু হয়েছে মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২ খ্রি.) রাজধানী টোকিওতে এবং ক্রমেই সেটা অন্যান্য প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়ে, কিয়োতো তার অন্যতম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৪১-৪৫) পর্যন্ত টোকিওসহ অনেক শহরেই চলাচল ছিল এই জিনরিকিশার। মেইজি যুগেই চীনের বেইজিং (পিকিং), সাংহাই, হংকং; ভারতের শিমলা, কলকাতাসহ এশিয়াব্যাপী রপ্তানি হয়েছে বলে জানা যায়।

নব্বই দশক থেকে জাপানের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নগর সরকার অভ্যন্তরীণ পর্যটনকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান তথা ওয়া-ফুউ রেস্টুরেন্ট, চা-অনুষ্ঠান, ফুলসজ্জা তথা ইকেবানা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ঐতিহাসিক স্থানসমূহ পরিভ্রমণের লক্ষ্যে জিনরিকিশা, স্টিম ইঞ্জিনচালিত ট্রেন, নৌবিহার তথা ফুনাতাবি ইত্যাদি নতুন করে প্রচলন শুরু করেছে। ফলে দেশি-বিদেশি পর্যটকের কাছে এসব জনপ্রিয় হতে বিলম্ব হয়নি। পুরোনো-প্রাচীন জাপানকে নতুন করে আবিষ্কারের জন্য ‘য়োওকোসো জাপান!’, ‘ডিসকভার জাপান’ ইত্যাদি মহাপরিকল্পনাও গৃহীত হয়েছে, যাতে ২০২০ সালের গ্রীষ্মকালীন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া উৎসব টোকিও অলিম্পিককে সার্বিকভাবে সফল করা যায়।

আরাশিয়ামার বাঁশবনের পথ
আরাশিয়ামার বাঁশবনের পথ

হাতে টানা জিনরিকিশার আরাশিয়ামা ভ্রমণ তরুণ-তরুণী ও নবদম্পতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এতে রয়েছে স্থানভেদে নানা ধরনের সময়গত পরিকল্পনা বা কোর্স এবং মূল্যমানও বিভিন্ন। যেমন ১২ মিনিট থেকে তিন ঘণ্টাব্যাপী যথাক্রমে ৩ হাজার ইয়েন সূচনা মূল্য থেকে ৪৭ হাজার ৫০০ ইয়েন পর্যন্ত। অবশ্য একজন যাত্রী আর জোড়া যাত্রীর মধ্যে ভাড়ার বেশ ব্যবধান বিদ্যমান। রিকশাচালক তথা জিনরিকিশাফু হিসেবে অবশ্যই তরুণ বয়সীকে নিযুক্ত করা হয় এবং তাকে স্থানীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান না রাখলে নয়। বিদেশি পর্যটককে ইংরেজিতে ব্যাখ্যা করার জন্য ইংরেজি জানা চালকও আছেন। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে রিকশা থামিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেন ও স্মারক আলোকচিত্র তুলে দেন।

তরুণেরা হাকামা ও তরুণীরা বাহারি কিমানো পরে যখন জিনরিকিশা চড়ে বাঁশবনের ভেতর দিয়ে মন্দির পর্যন্ত যান সেই দৃশ্য থেকে দৃষ্টি ফেরানো সত্যিই কঠিন। এখানেই জাপান ইউনিক বা স্বতন্ত্র।