টরন্টোতে বৃষ্টিভেজা এই বৈশাখে

বৈশাখের প্রথম সকালে লেখকের গ্রাম
বৈশাখের প্রথম সকালে লেখকের গ্রাম

বৈশাখের প্রথম সূর্যটা সকালে পূর্বাকাশের লালিমায় উঁকি দিচ্ছে। সবুজের সমারোহ চারপাশের জমিনটাতে। পাড়াগাঁয়েও উন্নয়নের ছোঁয়ার প্রমাণ হিসেবে ফোন টাওয়ারটা আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। এ আমার গ্রামের চিত্র। জন্মেছি যেখানে। গ্রীষ্মে কাঠফাটা রোদের ঝলকা হাওয়া কিংবা শীতের কনকনে ঠান্ডার মাঝেও ছোটাছুটি করেছি এ গাঁয়ে। তখন আশির দশক। প্রকৃতির এই মুক্ত বাতাসে বেড়ে উঠেছি। ছিল না বিদ্যুৎ, ছিল না ফোন। আর যোগাযোগের সে কী বেহাল দশা তখন। আজ প্রায় সব আছে। সেখানে আমি নেই।

এখন থাকি টরন্টোতে। হাজার হাজার মাইল দূরের এই দেশ কানাডাতে। হাড়কাঁপানো বরফের দেশ এটা। এপ্রিল মাসেও সে কী ঠান্ডা এখানে! ভাগ্যিস তুষারপাতটা আর নেই। মার্চে শেষ হয়েছে। বৈশাখের দিনটায় টরন্টোয় সারা দিন তুমুল বৃষ্টিপাত হলো।

টরন্টোতে বৈশাখ বরণ
টরন্টোতে বৈশাখ বরণ

রিমঝিম বৃষ্টিপাতের মাঝেই সেদিন বাংলা টাউন নামে পরিচিত স্কারবোরোর ডেনফোর্থে গাড়ি করে বাচ্চাদের নিলাম। আর্টওয়ার্কে ভীষণ আগ্রহী নাবিহা আর নাশিতা অন্যদের মাঝে প্রতিযোগিতায় নিজেদের মজাটা খুঁজে পেতে চায়। পয়লা বৈশাখের দিন দুপুরে বাচ্চাদের চিত্রাঙ্কন মেলা হওয়ার কথা ছিল। ঘরোয়া রেস্টুরেন্টের পাশে গাড়ি পার্ক করে ছাতা ধরে হাঁটাহাঁটি করলাম। অন্য কাউকে পেলাম না। তবে রেস্টুরেন্ট আর আশপাশের দোকানগুলোয় দেশের মানুষের উপচে পড়া ভিড়। উদ্দেশ্য একই—বৈশাখকে বরণ। অপেক্ষা। বেরসিক ঝরঝর বৃষ্টিটা কখন দূর হয়। চিত্রাঙ্কনটা আর হলো না। বাচ্চারা নিরাশ হলো।

পছন্দের চিত্রাঙ্কন অনুষ্ঠানটা না হওয়ায় বাচ্চাদের মন খারাপ ছিল। তাতে কী? টরন্টোতে বৈশাখীর আয়োজন শুরু হয় আগেই। ঠিক আগের পুরো দিনটায় বাচ্চাদের কাছে তুমুল উত্তেজনা আর আনন্দে ভরা ছিল। বৈশাখীর আনন্দ।

কাছের দুই বন্ধু হাওয়া আর সাইমার পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে সহধর্মিণী ইভা আমাদের বাংলা টাউন ডেনফোর্থ হয়ে মেইনের হকি স্টেডিয়ামে নিয়ে গেল। বাংলাদেশি এই তিন পরিবারের আত্মার বন্ধন প্রায় ১০ বছর ধরে। শুরুটা অবশ্য জাপানে। ইনডোর স্টেডিয়ামে চলছে বৈশাখী মেলা। সেখানে গেলাম আমরা। ইনডোর স্টেডিয়াম জনাকীর্ণ। টরন্টোতে একখণ্ড বাংলাদেশ যেন। জনপ্রিয় দেশীয় গান আর সংগীতে সরগম। কয়েক দিনের জন্য গড়ে ওঠা এই মেলায় শাড়ি, সালোয়ার, কামিজ, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, গয়না, খেলনা, হরেক পদের দেশি খাবার, আরও কত–কী আছে সেখানে। একসঙ্গে কেনাকাটা, ঘোরাঘুরি আর জমিয়ে আড্ডাটা। স্বচক্ষে দেখে বাচ্চারা জানল বাবা-মায়ের দেশীয় সংস্কৃতি।

তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া নাবিহার বাংলা শেখা
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া নাবিহার বাংলা শেখা

আমরা চাই আমাদের সন্তানেরা বাংলাদেশকে আরও জানুক, বাঙালি সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করুক। তিন দশক আগে চরবাগডাঙা গ্রামের ধুলোবালু আর কাদামাখা পরিবেশে কাটানো আমার ছেলেবেলার গল্প শোনাই তাদের। সেই সময়কে আজও খুঁজে ফিরি আমি নিজেও। রক্তে বাঙালি সংস্কৃতি। এক দিনের বাঙালি নই। সকালে পান্তা ভাতই খেতাম। প্রতিবছরের বন্যায় ভাইদের সঙ্গে কলার ভেলায় উঠে বড়শিতে মাছ ধরেছি। বন্যা শেষে পানি সেচে কাদার মাঝে লুকিয়ে থাকা মাছ বের করেছি।

পরিশ্রম করে ধরা সে মাছ ধুয়ে মাকে দিয়েছি রান্না করতে। সেগুলো ইলিশ মাছ না হলেও পান্তা ভাতের সঙ্গে সেসব মাছের সে কী স্বাদ। আহ! কাঁচা মরিচ তো ঘরের জানালার পাশেই, বাগান থেকে টাটকা ছিঁড়ে নেওয়া। ছাতু খুব প্রিয় খাবার ছিল। গমের ছাতুর চেয়ে চালেরটায় বেশ মজা। জমিতে ফলানো ফসলের বিভিন্ন আটায় তৈরি রুটির যে কী মজা। ধনেপাতার চাটনি দিয়ে কলাইয়ের রুটি খাবার আসল মজাটা সেখানে। মাসের পর মাস শীতল করে রাখা কেনা খাবারে সেই স্বাদটা আজ আর পাই না। ফিরে তাকাই সেই সব বৈশাখে।

ড. মো. সাদেকুল ইসলাম পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, টরন্টো, কানাডা।
ই–মেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <sadequl>