আবুধাবিতে ভিনদেশিদের নিয়ে বৈশাখ উদ্যাপন

শোভাযাত্রা
শোভাযাত্রা

ভিনদেশিদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাখা, প্রাণী, ফুলপাখির কাজগুলো। ছবিগুলো কাগজে এঁকে দণ্ডাকৃতির সাপোর্টে ঠিক ঠিক করে লাগানো। হরিণ, বাঘ, কুমির, প্যাঁচার চেহারা সংযোজিত হয়েছে ছোট ছোট ক্যানভাসে। নারী-পুরুষ শোভাযাত্রায় শামিল হলেন। একটি পাঁচতারা হোটেলের প্রশস্ত চত্বরে দেখানো হলো বাংলা আর বাঙালির ঐতিহ্যকে। আমন্ত্রিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা বিস্মিত হলেন।

এ দৃশ্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। জাকিয়া হাসনাত ইমরানের পরিকল্পনার ফসল ছিল সেদিনের বর্ষবরণ পর্ব। তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

প্যাঁচার মুখোশ পরে চলেছেন যে নারী, তাঁর ধিক্কার কূপমণ্ডূকতায়। এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ...নতুন বছরকে আহ্বান জানানো হচ্ছিল। প্রকাশ পাচ্ছিল ‘বৎসরের আবর্জনা যাক যাক’ বলে জঞ্জাল ঝেঁটিয়ে বিদায় করার দৃঢ়তা।

ভিনদেশিদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া পাখা, প্রাণী, ফুলপাখির কাজগুলো
ভিনদেশিদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া পাখা, প্রাণী, ফুলপাখির কাজগুলো

অনুষ্ঠানের শুরুটা ছিল দুই দেশের জাতীয় সংগীত দিয়ে। হলের সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানালেন। মনে করলেন বাংলাদেশকে। একই সঙ্গে বন্ধুদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা ঢেলে দিলেন। ঘটনাটি ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যাবেলার।

একক বক্তব্য রাখলেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। তিনি জানালেন, বাঙালিরা দেশে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে বর্ষবরণের বিভিন্ন অনুষ্ঠান করছে। এমন আয়োজনে দেশের সঙ্গে বিদেশি কূটনৈতিক, একইভাবে ভিন দেশি বন্ধুদের সম্পৃক্ত করা যায়। এই দেশে এই সালকে সহিষ্ণুতার বছর ঘোষণা করা হয়েছে। সেই আলোকে একসঙ্গে বসবাস এবং ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দূতাবাসের এমন অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত।

অন্যদের বর্ষপঞ্জি ধর্মাশ্রয়ী তবে বাংলার বেলায় তা নয়। বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ও ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ধর্মীয় চর্চা করে যার যার মতো। তবে উৎসব সবার। বিপুল উৎসাহে তারা নাচ, গান, শোভাযাত্রায় শামিল হয়।

একজন অতিথিকে স্বাগত জানাচ্ছেন রাষ্ট্রদূত
একজন অতিথিকে স্বাগত জানাচ্ছেন রাষ্ট্রদূত

ঐতিহ্যকে ধারণ করে বাঙালি নারী তার ঘর ধোয়ামোছা করে। বাড়ির অঙ্গনে আলপনা এঁকে স্বাগত জানায় প্রিয়জনদের। মানুষ নতুন ও পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে স্বজন বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে এক হয়। শহর নয় শুধু, গ্রামেও মেলা জমে। কৃষিজাত দ্রব্য, হাতে গড়া খেলনার সম্ভার সেখানে। নানা ধরনের বাঙালিয়ানা খাবার আর মিষ্টির পসরা কাকে না আকর্ষণ করে! এই মেলা উপভোগ্য। এখানে কণ্ঠশিল্পী, নৃত্যশিল্পীরা মঞ্চায়ন করেন গ্রামীণ সংস্কৃতি।

বর্ষবরণ এখন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাহন। এটা প্রাথমিকভাবে গ্রামের মানুষের উদ্‌যাপন ছিল। শহরের বুদ্ধিজীবী অংশটি বাংলা এই অনুষ্ঠানকে নবায়ন করেছে। হিরণ্ময় এ সময়টি এসেছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর। আলাদা বৈশিষ্ট্য ও মাত্রা নিয়ে কালের প্রবাহে তা চলমান।

সামনের দিনগুলো সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয় বক্তব্যে। পর্বটি সঞ্চালনা করেন দূতাবাসের প্রথম সচিব মোহাম্মদ জোবায়েদ হোসেন। বর্ষবরণে রাষ্ট্রদূত অতিথিদের মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তাঁরা আসেন।

অতিথিদের একাংশ
অতিথিদের একাংশ

পর্দায় সৌন্দর্যের বাংলাদেশকে আনা হয়। এক বিদেশি তরুণী। ভ্রমণ করেন বাংলাদেশ। উপভোগ করেন এর রূপরস–সৌন্দর্য। ছবির ধারা বিবরণী ইংরেজিতে। তরুণী যান সুন্দরবনে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল এটাই। এরপরই শিশুদের সঙ্গে আসেন। ধরেন ঘুড্ডির লাটিম। ছড় ছড় করে সুতা ছাড়েন। নেপথ্যে বাজে সারেগামা-গামাপা-পাধানি...।

লালনের আখড়ায় সুফি সাধককে নমস্কার জানান। প্রতি নমস্কার শেষে কথা বলেন তাঁদের সঙ্গে। দেখছি, লালনগীতি উপহার দিচ্ছেন আখড়ার শিষ্যরা। বিমুগ্ধতার চিহ্ন তাঁর মুখে। তিনি নৌকায় চড়েন।

টুঙ্গিপাড়ায় যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান। এখানেই চিরনিদ্রায় আছেন জাতির পিতা। দেখছেন, মানুষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। তরুণী তীর্থস্থান ভ্রমণ করছেন। এক বিস্ময় তাঁর চোখে। মুজিব নগরের কথা আসে।

জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এক শিশু এসে হাতে দেয় তাজা গোলাপ। শহীদ মিনার। ধীর পায়ে এগোয় মানুষ। সামনে যান তরুণী। আলপনা আঁকছেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এ দেশের দামাল ছেলেরা জীবন দিয়েছেন ভাষার জন্য। দিনটিকে ইউনেসকো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে। অনেক বড় বিষয়! ভাবায় তরুণীকেও। পদ্মপাতার বিল। পল্লির রূপ। এরপর ঐতিহ্যের সার্কাস। রঙিন কাপড়। ঘোড়া, হরিণ ইত্যাদির পসরা। তরুণী ফুচকার স্বাদ নেন। ঠোঁটে পালিশ মাখেন।

লুই কানের পরিকল্পনায় গড়ে ওঠা সংসদ ভবন চত্বর ঘোরেন। সরষের খেত পেরিয়ে যান পল্লির কোলে। পিঠা তৈরির মূল জায়গায়। ঢেঁকির পাড় মোহিত করে তাঁকে। এরপর দেখা যায়, কোনো এক জায়গায় ঢোক ঢোক ডাবের জলে গলা ভেজান। গাড়িতে ওঠেন।

জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন

শ্রীমঙ্গলে চা–বাগান পরিদর্শন। ধূমায়িত পেয়ালায় মুখ দেন। এরপর মণিপুরী মেয়েদের নৃত্য দেখেন। নিজেও নাচেন। কী এক অনুভূতি ব্যক্ত তাঁর মুখে! গ্রামে গাছির সঙ্গে দেখা। পান করেন খেজুরের রস। আহা সে কী তৃপ্তি! পেছনে উচ্চাঙ্গসংগীতের কণ্ঠ। ওঠেন পাহাড়ের ওপরে। বেড়ান কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। আনন্দ তাঁর ধরে না। বিদেশিদের আমন্ত্রণ জানানো হয় প্রকৃতির এই লীলাভূমিতে।

ড. হাবিবউল হক খোন্দকার। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদেশিরা শোভাযাত্রায় শামিল হয়েছেন। আনন্দের খবর। বলেন তিনি।

অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান কথা বলছেন যায়েদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপকের সঙ্গে। দুজন একই বিষয়ের ছাত্র। জমে ওঠে ভাষা–বিষয়ক আলাপ। উপভোগ করলাম আমি সে কথোপকথন।

ড. মেহরাজ জাহান বলেন, অন্য দেশের কূটনীতিকেরা শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়াতে নতুন এক মাত্রা যুক্ত হলো। প্রতিবছর এমন আয়োজন হওয়া প্রয়োজন, তৃপ্তির চিহ্ন তাঁর মুখে।

শহীদুজ্জামান ফারুকী কথা বলছেন নেপালের রাষ্ট্রদূত কৃষ্ণ প্রসাদ দাখালের সঙ্গে। সঙ্গে জানুকা দাখাল। শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। খুব ভালো লাগল। আলাপের মাঝেই বিদেশি অতিথির মন্তব্য।

দূতাবাস পরিবার
দূতাবাস পরিবার

তিন বোনের কীর্তি। শাবনূর কোরিওগ্রাফি করেছেন। কোহিনূর, রাবেয়া নুর মঞ্চে নেচেছে মিশ্র গানে। ‘আইলো আইলো আইলোরে রঙে ভরা বৈশাখ...’ ছিল সে গানে। ছিল, ‘মেঘের গায়ে নূপুর পায়ে নাচে বরষায়...।’ আরও মিশ্রণ তাতে, ‘কৃষ্ণ আইলো রাধার কুঞ্জে...’ অপূর্ব সংযোজন। ওদের বড় বোন শাহিনুর। কথা বলার সময় অগ্রজা দলের প্রতিনিধিত্ব করেন।

নূপুর সরকার। কথা হলো। টাঙ্গাইলে জন্ম। বললেন, তাঁর গ্রামের কথা। স্বামী দূতাবাস কর্মকর্তা। নূপুরের মতোই ঝনঝন করে উঠল সে কণ্ঠ। অনন্য এক সন্ধ্যা, মন্তব্য করলেন।

প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন ও ইফতেখার হোসেন বাবুল একই টেবিলে বসা। শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। কথা হয় মহিলা সমিতির সভাপতি পপি রহমানের সঙ্গে।

অন্য এক টেবিল। দূতাবাসের পাসপোর্ট ও ভিসাবিষয়ক কাউন্সেলর রিয়াজুল হক। আনন্দের প্রহর কাটাচ্ছেন। লেবার কাউন্সেলর আবদুল আলিম মিয়ার সঙ্গে আলাপ হয়। দূতাবাস–সম্পর্কিত কিছু তথ্য ঝালাই করে নিচ্ছিলাম আমি।

জাকিয়া হাসনাত ইমরান কুশল জিজ্ঞেস করেন। প্রিয় জ্যেষ্ঠ কন্যার লেখাপড়ার খবর নেন। জানাই তাঁকে। তাঁর বড় মেয়ে অর্থনীতির ওপর পড়াশোনা করেছেন। এখন সিঙ্গাপুরে একটি কনসালটেন্সি কোম্পানিতে চাকরি করেন। বিবাহিত। ভালোই আছেন। জেনে আমার ভালো লাগা প্রকাশ করি। অন্যদিকে কনিষ্ঠ কন্যা সামিয়া ইমরান। একসময় তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। জানি, অস্ট্রেলিয়া মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছেন। চতুর্দিক চক চক করে ওঠে। কৃতি এ মেয়ের জন্য শুভকামনা করি। ভিনদেশিদের নিয়ে বর্ষবরণ হয়ে ওঠে আরও বর্ণাঢ্য।