ভিক্টোরিয়ার বালারাতে বৈশাখী উৎসব

অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন বয়সী শিশুরা
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন বয়সী শিশুরা

আরও একটি বৈশাখ চলে এল। সময় বেশি নেই। মার্চের শেষের দিকে বালারাতের বাংলাদেশিদের কাছ থেকে পরামর্শ চাওয়া হলো বৈশাখ উদ্‌যাপনের দিন-তারিখ নিয়ে। যখন দেখা গেল পয়লা বৈশাখ অস্ট্রেলিয়ার ছুটির দিনে, ঠিক করা হলো, ১৪ তারিখেই আমরা একত্র হব। সে অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে গেল।

অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের রাজধানী মেলবোর্নের ১০০ কিলোমিটার দূরে বালারাত শহরে আমরা প্রায় ৩৫টি বাংলাদেশি পরিবার থাকি। যাদের অধিকাংশই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আগ্রহ জানায়। আমাদের এখানকার বৈশাখ উদ্‌যাপন অন্য বৈশাখী মেলা থেকে কিছুটা ভিন্ন। যেখানে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশি পরিবারেরা একটি বা দুটি করে দেশীয় খাবার নিয়ে আসে। এখানকার ছোট ছোট বাচ্চারা আর আগ্রহী বড়রা কিছু নাচ-গান-আবৃত্তি-অভিনয় করে। আর সবাই মিলে অনেক গল্প করে, ছবি তুলে কিছুটা সময় একসঙ্গে অতিবাহিত করে।

বৈশাখী অনুষ্ঠানে উপস্থিতির একাংশ
বৈশাখী অনুষ্ঠানে উপস্থিতির একাংশ

সবাইকে অবহিত করা, অনুষ্ঠানের জায়গা নির্ধারণ, সাউন্ড-সিস্টেম, মঞ্চ সাজানোর কঠিন কাজটি কাঁধে তুলে নেন বাংলাদেশি কমিউনিটি ইন বালারাতের প্রধান সমন্বয়ক এরশাদুল হক নাভেদ ভাই। আর কে কী খাবার আনবেন, তা সমন্বয়ের কাজটি সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করেন তাঁর সহধর্মিণী শারমিন সারোয়ার ভাবি। দু-তিনজনের আরেকটি দল দায়িত্ব নেয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের।

বৈশাখী অনুষ্ঠানে উপস্থিতির একাংশ
বৈশাখী অনুষ্ঠানে উপস্থিতির একাংশ

অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত দিন এল। ১৪ এপ্রিল রোববার। সকালে নাভেদ ভাই তাঁর দলবল নিয়ে চলে গেলেন মঞ্চ আর অনুষ্ঠানস্থল সাজাতে। ১টা থেকে শুরু হলো সবার আসা। নারীরা এসেছিলেন সাদা-লাল অথবা হরেক রঙের শাড়িতে আর পুরুষেরা পরেছিলেন পাঞ্জাবি। দেখার মতো ছিল ছোট বাচ্চাদের পোশাক। প্রায় ২০ রকম দেশীয় ভর্তা, লুচি, খুদের চালের ভাত, কয়েক রকমের মাংস ছিল সেদিনের খাবারের আয়োজনে। এবারের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন বালারাত মাল্টিকালচারাল কমিশনের কমিউনিটি এনগেজমেন্ট লিডার ড. সুন্দারাম সিভামালাই। তিনি ও সঙ্গে আসা তাঁর বন্ধু মিলে উপভোগ করলেন প্রতিটি খাবারের স্বাদ। খাবারের সঙ্গে সঙ্গে সবাই উপভোগ করেন মাল্টিমিডিয়ায় চালানো বিভিন্ন বাংলা গান।

সুন্দারামকে বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে
সুন্দারামকে বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে

খাবারের শেষ দিকে বেজে ওঠে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’, আর এরই সঙ্গে সবাই মঞ্চের সামনে নির্ধারিত স্থানে আসন গ্রহণ করতে শুরু করেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে আর আমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাই তার প্রতি।

জাতীয় সংগীত শেষ হওয়ামাত্রই পিউয়ের হাতে পিয়ানোতে বেজে ওঠে ‘আমি বাংলার গান গাই, আমি বাংলায় গান গাই’, আর গানটি পরিবেশন করেন তানজিমা আফরিন ভাবি। মা-মেয়ের অসাধারণ পরিবেশনায় আমরা যেন ফিরে যাচ্ছিলাম বাংলাদেশে, যেখানে আমরা আমাদের জীবনের অধিকাংশ সময় আর স্মৃতিময় পয়লা বৈশাখগুলো কাটিয়েছি।

মা-মেয়ের পরিবেশনায় ‘আমি বাংলায় গান গাই’
মা-মেয়ের পরিবেশনায় ‘আমি বাংলায় গান গাই’

অনুষ্ঠানের শুরু থেকেই আমাদের ছোট্ট বন্ধুরা অধীর আগ্রহে বসে ছিল তাদের পরিবেশনার জন্য। একে একে বৈশাখের কবিতা আবৃত্তি করে শোনায় নাওয়ার, আরিয়ান ও তীর্থ, আর ছিল ইয়ারার কণ্ঠে এসো গান শিখির সেই বিখ্যাত গান ‘ক-এ কলা, খ-এ খায়’। বাচ্চাদের পরিবেশনার মধ্যে ছিল বড়দের একক পরিবেশনায় নাটিকা, স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি, মাউথ অর্গানের সুর–মূর্ছনা। আরও ছিল রম্য বিতর্ক। যেখানে চারজন প্রতিযোগী বাংলাদেশের চারটি আঞ্চলিক ভাষায় (নোয়াখালী, রাজশাহী, বরিশাল ও বিক্রমপুর) একটি নির্ধারিত বিষয়ের ওপর আলোচনা করেন। আর বিচারক বিচার করছিলেন পুরান ঢাকার ভাষায়। যদিও তিনি কাউকেই একক বিজয়ী ঘোষণা করতে ব্যর্থ হন।

একক পরিবেশনায় (বাঁ থেকে) নাওয়ার, আরিয়ান, তীর্থ ও ইয়ারা
একক পরিবেশনায় (বাঁ থেকে) নাওয়ার, আরিয়ান, তীর্থ ও ইয়ারা

অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব ছিল তানজিমা ভাবির কোরিওগ্রাফিতে ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই’ গানটির সঙ্গে সামারা, তীর্থ, মানহা, আরিশা, মিহিরানের পরিবেশনায় একটি মনোমুগ্ধকর নাচ।

শিশুদের শান্ত রাখতে বাবা-মাদের অবশ্যই ললিপপের মোড়ক খুলতে জানতে হবে আর সেটাই প্রমাণ করে দেখালেন এক সন্তানের বাবা-মা, যাঁরা প্রতিযোগিতার মঞ্চে ৬-১-এ হারিয়ে দিলেন সদ্য বিবাহিত এক জুটিকে। প্রথম পর্বের শেষে ছিল শিশু–কিশোরদের জন্য একটি প্রতিযোগিতা। যেখানে তাদের দেখানো হয় বাংলাদেশের ওপর নির্মিত ১০ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি আর সেখান থেকে করা হয় ১৫টি প্রশ্ন। এর পরপরই শুরু হয় মিষ্টিমুখের পর্ব। রসগোল্লা-গোলাপজাম, দই, হরেক রকম পিঠার সঙ্গে ছিল ঝাল চটপটি। এই প্রথম চারটি স্টল ছিল এই অনুষ্ঠানে। দেশীয় পোশাক, গয়না ও অন্যান্য দেশীয় সামগ্রীর ওপর ছিল তিনটি স্টল, আর একটি স্টলে ছিল দুটি ছোট্ট মেয়ে আদিপ্তা ও নায়রার হাতের তৈরি কাগজের বিভিন্ন রকমের ফুল।

রম্য বিতর্ক
রম্য বিতর্ক

কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয় অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব। সাবলীল ভঙ্গিমায় ‘বালারাত নিউজ’ নিয়ে আবারও উপস্থিত আহসান ভাই। আগের একটি অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো তাঁর পরিবেশনা তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এবারের খবরটি ছিল অনেকটা মানুষের দাবির মতো। ইউটিউবে দেখা যাবে আমাদের এই নাটক। হাতুড়ে ডাক্তার আর আজগুবি অসুখের ওপর নাটক মঞ্চস্থ করে রাশেদ, সামসুল কবির, নিপু, হাদি ও আবরার। সংসার জীবনে স্বামী-স্ত্রীর চমৎকার বোঝাপড়ার প্রমাণ দিতে মঞ্চে উপস্থিত হন দুই জোড়া স্বামী-স্ত্রী। অঙ্গভঙ্গিমায় তাঁরা একে অপরকে বোঝাতে চেয়েছেন কিছু গানের কলি। তবে বোঝানো শেষে খোলা গলার কুমারদা কিছুটা গেয়ে শোনান সদ্য প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চুর সেই বিখ্যাত গান ‘চলো, বদলে যাই’ আর আসিফ ভাই গেয়ে শোনান আরেক সদ্য প্রয়াত লাকী আখান্দ্‌–এর আরেকটি অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ‘এই নীল মণিহার’।

মূকাভিনয়ে গানের কলি বোঝানোর প্রয়াস
মূকাভিনয়ে গানের কলি বোঝানোর প্রয়াস

এরপর ছিল একটি পরিবারভিত্তিক খেলা। যেখানে বাবা-মাকে নিয়ে প্রতিটি শিশু ১০ মিনিটের জন্য ডুবে ছিল সঠিকভাবে ছবি সাজানোর একটি খেলায়। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খেলাটির বিজয়ী হয় জনি ভাই-পলি ভাবি পরিবার। পরিশেষে সব বাচ্চার জন্য ছিল এক প্যাকেট করে চকলেট আর প্রতিটি পরিবারকে উপহার দেওয়া হয় বাংলাদেশ থেকে আনা একটি চমৎকার চটের ব্যাগ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে সবাই মেতে ছিলেন বিভিন্নভাবে ছবি তোলায়। আর এরই সঙ্গে শেষ হয় বালারাতে বৈশাখ উদ্‌যাপন।

এই দূর পরবাসে তারা গুনি আকাশে আকাশে। কাটে নিঃসঙ্গ রাত্রিগুলো। মনে পড়ে যায় বন্ধুদের আড্ডামুখর প্রহর, তুমুল উল্লাসে ভরা প্রিয় শহর। শত নাগরিক সুবিধার মধ্যেও আমরা অনেক সময় নিজেদের একা বোধ করি। আমরা যারা আত্মীয়পরিজন ছাড়া এই বিদেশ–বিভুঁইয়ে থাকি, এই দেশীয় অনুষ্ঠানগুলোই আমাদের সবচেয়ে আনন্দের জায়গা। আর এরই মাধ্যমে আমরা আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে বাঁচিয়ে রাখতে চাই আমাদের সংস্কৃতি।