বর্ষবরণে শাস্ত্রীয় নৃত্য

মঙ্গল শোভাযাত্রা
মঙ্গল শোভাযাত্রা

আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। ভেতরে একই সুর। মনপ্রাণ ছেড়ে দিয়ে তাঁরা মিশে গেছেন মায়ার অধরা এক স্তরে। দু-পা একদিকে ছড়িয়ে অন্যদিকে হাতের অঙ্গুলির সঞ্চালনায় কুশীলবেরা খুঁজছেন দ্যুতি। তাঁরা অন্ধকার পেছনে ঠেলে চান আলোঝলমল দিন।

‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। এ জীবন পুণ্য করো দহন দানে।’ অনন্য এক আকুলতা।

বাংলাদেশ স্কুলের বিশাল অডিটোরিয়াম। মানুষ গিজগিজ করছে। তারই মধ্যে মঞ্চ চলমান। সৃষ্টির কর্মীরা নৃত্যে জীবনপ্রাণ সঁপে দিয়েছেন। সৃষ্টি কালচারাল সেন্টার। কর্মীরা শাস্ত্রীয় নৃত্য চর্চা করেন। নৃত্য তাঁদের জীবন, নৃত্যই তাঁদের মাধ্যম। তাঁরা আশা করছেন, দুঃখের আগুনে জীবন দীপ্তিময় হয়ে উঠুক। নতুন চেতনায় জেগে উঠুক। মঞ্চ জ্বল জ্বল করে ওঠে।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ দূতাবাস ও ইসলামিয়া স্কুলের আয়োজন। গত ১৯ এপ্রিল এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আকর্ষণীয় একটি পর্বের মধ্য দিয়ে এর সূচনা। মঙ্গল শোভাযাত্রা এগোয়।

দ্বিতীয় পর্বে মঞ্চে কথা বলেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। বাংলা বর্ষবরণ একটি অসাম্প্রদায়িক উপস্থাপনা। ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষনির্বিশেষে বিদেশের মাটিতেও আজ এই চেতনায় সমাবেশ ঘটে। তিনি আহ্বান জানান, ‘আসুন, বৃহত্তর পরিবেশে এই প্রয়াস ছড়িয়ে দিই আমরা।’

স্বাগত জানান অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান। একটি কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতির ধারক বাঙালি সমাজ। বলেন, ‘বিনোদন মানুষকে স্বস্তি দেয়। এখান থেকেই সাংস্কৃতিক চেতনা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে পারে। মূল চেতনাকে ধরার জন্য এ এক সিঁড়িপথ।’

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

ইফতেখার হোসেন বাবুল বলেন, গ্রামের আয়োজনগুলো অর্থনীতির সঙ্গে শক্তিশালী একটি সম্পর্ক রেখে চলে। তাই এ সংস্কৃতিকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে প্রাণবন্ত রাখতে হবে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা দারুণ দারুণ ঝড় তোলে। সকালে স্কুল মাঠে এর শুরু, সফল সমাপ্তিও এখানে। স্কুলের ছাত্র ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, দূতাবাস কর্মকর্তা, সমাজের প্রতিনিধিরা বিপুল উৎসাহ দেখান এ সময়। তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ে চলে আসেন স্কুলে। যোগদান করেন কাফেলায়। দেখতে দেখতে বিশাল রূপ নেয় এ আয়োজন।

সবাই আনন্দ আর বিশুদ্ধতায় নতুন বর্ষকে বরণ করে নেন।

বর্ষবরণ এখন বাঙালি সংস্কৃতির বাহন। এটা প্রাথমিকভাবে গ্রামের মানুষের উদযাপন ছিল। শহরের বুদ্ধিজীবী অংশটি বাংলা এই অনুষ্ঠানকে নবায়ন করেছে। মূলত তাঁরা ঘরে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফসল। আলাদা বৈশিষ্ট্য এবং মাত্রা নিয়ে এখন তা চলমান।

উপস্থিতির একাংশ
উপস্থিতির একাংশ

আর মঙ্গল শোভাযাত্রা হচ্ছে শহুরে সংস্করণ। কী সুন্দর করেই না উৎকর্ষময় দিনের আকাঙ্ক্ষায় সেজে ওঠে! আশির দশকের শেষভাগে এর শুরু। লোক-ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারু ও কারুকলার ছাত্র-শিক্ষকেরা বেরিয়ে আসেন সড়কে। এটা এক প্রতীকী উপস্থাপনা। লোকগাথা ও সংস্কৃতি এখানে অপশক্তিকে পরাভূত করে সত্য এবং ন্যায়ের পথে অগ্রসর হতে উৎসাহিত করে। প্রাণীর বর্ণাঢ্য মুখোশ, পাখি-প্রজাপতি-পুতুল—এ সবই বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে।

ড. হাবিব উল হক খন্দকার মঞ্চে আসেন। প্রাণঢালা ভালোবাসা জানান প্রিয় সুধীজনকে। এই-ই তাঁর বক্তব্য। প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন আরও সংক্ষিপ্ত কথা বলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোটগল্পটির চেয়েও ছোট! আর্নেস্ট হেমিংওয়ে লিখেছিলেন। শিশুর জুতা বিক্রি হবে। অব্যবহৃত। বাংলায় মাত্র পাঁচ শব্দ। এই-ই গল্পকারের গল্প। এখানেও শ্রোতারা পেলেন গোলাপের সুবাস। চমৎকার, চমৎকার ধ্বনি উঠল।

মূল পর্বের সঞ্চালনা করেন দূতাবাসের প্রথম সচিব রিয়াজুল হক।

ধর্ম যার যার উৎসব সবার

এ আয়োজন সর্বজনীন। সেই মূল্যবোধে বর্ষবরণ বৃহৎ মানুষের মিলনের অনুষ্ঠান। মঙ্গল হোক সবার। নতুন বছরে এই কামনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পর্বের। অনাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত হোক শুভবোধ। ছায়ানটের এবারের প্রতিপাদ্য। সঞ্চালক বলেন, ‘সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিফলন আমাদের এই বর্ষবরণ।’

মঞ্চে আসে অসমান্তরাল নৃত্য। মৃত্যুর মুখেও জীবনের জয়গান। চল চল চল...। এরপর আটজন নাচেন মঞ্চে ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’। লোকগাথার জীবনে নিয়ে যায় দর্শককে।

জাকিয়া হাসনাত ইমরান খোঁজ নিলেন আমার সহধর্মিণীর। বললাম, তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। পেছন থেকে আসতে একটু সময় নিচ্ছে। কী ভিড়। শুভেচ্ছা বিনিময় হয়।

দূর্বা, অঙ্গনা, নিধি, আয়শা। চার কিশোরী মেলে এক জায়গায়।

আমি ছবি তুলি। ভালোবাসা ছড়িয়ে দিই তাদের জন্য।

দেশের জন্য ত্রিশ লাখ জীবন উৎসর্গ করেছে জাতি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ধর্মভিত্তিক দেশ থেকে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলা উপহার দিয়েছেন। অর্জিত এই দেশের উন্নতি এবং সমৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। হাজার বছরের চর্চিত সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যও একইভাবে লালিত হবে বাঙালির অন্তরে।

নদীর বহমানতা নিয়ে নৃত্য। ‘মাঝি নাও ছাড়িয়া দে! পাল উড়াইয়া দে!’

সাঁওতালদের প্রেম আনন্দ বেদনা নিয়ে ‘পালাব পালাব মন...' উপস্থাপন করেন তারা।

অনুষ্ঠানে আগত কয়েকজন
অনুষ্ঠানে আগত কয়েকজন

বৃষ্টির আবহ সৃষ্টি করল সৃষ্টি। ‘যাও গিয়ে বলো তারে...মেঘের ওপরে। ধিন তা-না, ধিন তা-না।’ চলল, বৃষ্টির শব্দে নৃত্যের সঞ্চালন।

‘চিরদিন তুমি আমার’ গানটি আসছিল মঞ্চ থেকে। তরুণী মন দুলে ওঠে। শিহরণ ছড়ায়।

অনুভবের চরম মুহূর্তটিকে হাতছাড়া করতে চান না।

চলে আসেন তরুণের সঙ্গে। নিমতলাই হতে পারে এ জন্য যোগ্য স্থান।

ক্লিক! ক্লিক! ক্যামেরা জ্বলে ওঠে।

মা তাঁর সন্তানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। গ্রিনরুম বেশি দূরে নয়। এরপরই তাঁর এ কন্যা নাচবে অন্যদের সঙ্গে। দ্রুততার সঙ্গে শাড়ি, চুল ঠিক করে দিচ্ছেন। আগেই মুখে প্রসাধনী মেখে তিলোত্তমা করে তুলেছেন আত্মজাকে।

ডা. মোস্তাফিজুর রহমান গান গাইলেন। কন্যা সিয়ারা ফারজিনের সঙ্গে। ‘আয় খুকু আয়...’। শ্রোতারা বিমুগ্ধ হলেন। স্কুলের ‘আহার বিহার’ স্টলে বসা শিক্ষক জাকিয়া সুলতানা। তাঁর ছেলে এবার মন্ট্রিয়েলে ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে। আমি অভিনন্দন জানাই। ওখানকার পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। নিজের মেয়ের জন্য গর্ববোধ করি। দলীয় নৃত্য চলছে মঞ্চে। ‘তাক ধুমধুম বাজে ঢোল...’ অন্য রকম আমেজ। পাহাড়ি গান। ও দক্ষিণার সঙ্গে নাচে প্রকৃতির কন্যারা। আলাদা পরিবর্তন আনে মঞ্চে।

অনুষ্ঠানে আগত কয়েকজন
অনুষ্ঠানে আগত কয়েকজন

পপি রহমান বসা সামনের সারিতে। পাশে ওয়াহিদা সুলতানা রোজি। সৌহার্দ্যের একটি বাতাবরণ। বুঝি, নতুন বছর হয়ে উঠবে উজ্জ্বল। ‘দুরন্ত বৈশাখ’। ভিড় ঠেলে এগোলাম। দেখি সাইফুল নাহার জলি ভীষণ ব্যস্ত অতিথি আপ্যায়নে। ঊর্মি হাওলাদার আল আইন থেকে এসেছেন। তরুণী মায়ের হাতে পিঠার নৈবেদ্য। ফোনের যোগাযোগ ধরে লাকি হালদার উল্কা মেলেন তাঁর সঙ্গে। আনন্দের সময় বয়ে যায়। ‘বৈশালী’ থেকে আনজুমান আরা শিল্পী শুভেচ্ছা জানালেন। ফারজানা করিম আহ্বান জানালেন নিজ হাতে তৈরি মিষ্টি গ্রহণে।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের দুই সহসভাপতি শওকত আকবর ও ইমরাদ হোসেন। কুশল বিনিময় হলো। মিজানুর রহমান সোহেল প্রাণভরা কথা বললেন। উত্তম কুমার হাওলাদার আই প্যাড ধরে প্রিয় মুহূর্তগুলো ধরে রাখছেন।

সৃষ্টির কর্ণধার আনিসুল ইসলাম হিরোর সঙ্গে কথা হলো। আগুনের পরশমণি জ্বালাও প্রাণে। এরই ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। হ্যাঁ এ গানের মর্মকথা মঞ্চে সঞ্চালকও ব্যাখ্যা করেন। নৃত্য সংগঠককে দেখিয়ে বলেন, অন্ধকার দূরে ঠেলে আলোর প্রতিস্থাপনই তাঁদের ব্রত। আমি ব্রতচারীকে অভিনন্দন জানাই।

কাজের তাড়া। আর থাকা সম্ভব হয় না। স্ত্রী-কন্যাসহ অগত্যা ছুটি ছায়ানীড়ের দিকে।