বন্ধন

বয়স তখন সবে সাত। ছয় ভাইবোনের সবচেয়ে ছোট এই আমার তখন বই–খাতা, খেলাধুলা, রংতুলি ছাড়া আর তেমন কোনো কাজ নেই। আর ওহ ভুলেই গেছি, গান। সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে গানই জীবন, গানই আমার প্রাণ। সে সময় সহপাঠীদের কণ্ঠে বা ব্ল্যাক শিপ আর আমি স্কুলে গেলে তো বাধ্য হয়ে বা বা করেছি বটে, তবে আমার মনেপ্রাণে তখনই ‘আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি’ অথবা ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি...’।

ভাইবোনদের সবার আদরের বোন আমি (অতি আদরে বাঁদর হইনি কোনো দিন, আদরের সঙ্গে শাসনের সুন্দর সমন্বয় ছিল)। তবে একজনের পেছন ছাড়তে চাইতাম না কখনোই, সে লেলু। আম্মুর আদরের ছোট ছেলে, আমার বড় ভাই। ভাইবোনদের ভেতর এই একজনের সঙ্গেই আমার বয়সের পার্থক্য সব থেকে কম, দশ বছর। ফলে সে আমার ভাই কম, বন্ধু বেশি ছিল। অসম্ভব দরদী কণ্ঠ, আর দুর্দান্ত লেখার হাত। নামাজের প্রথম কিছু সুরা শিখেছিলাম লেলুর নামাজ পড়া শুনে। তবে লেলুর সবচেয়ে প্রিয় শখ ছিল দাবা খেলা। পড়ালেখাতেও তুখোড়। আমি যার কানাকড়িও নই।

জন্মের সময় আল্লাহ আমায় ছোট্ট একটুখানি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা উপহার দিয়েছেন। মাত্র সাত বছর বয়সে বোঝার উপায় ছিল না। এ কি অভিশাপ না আশীর্বাদ। (এখন বুঝি, অবশ্যই আশীর্বাদ, অভিযোগ নেই কোনো)। সমবয়সীদের ছোটাছুটি, হুটোপুটি দেখে লেলুকে প্রশ্ন করতাম ‘ভাইয়া, (লেলিন কেটে কখনো লেলু, কখনো ভাইয়া, আর রেগে গেলে ‘কালু!’ তামাটে বর্ণ ছিল যে!) আমি কেন পারি না? এরা কেমন দৌড়ায়, কেন আমি বাঁ পা মেঝেতে ফেলতে গেলেই যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাই? ওরা সাইকেল চালায়, কেন পারি না আমি? ওরা কত রকম জুতা পরে, কেন মেয়ে হয়েও ছেলেদের জুতা আমার?

আজও কানে বাজে সেই কণ্ঠস্বর: ‘বাবুরে, কাঁদে না। মানুষের একটা পা তো থাকে না রে বোন, তোমার আছে দুটোই। হাতে আঁকো, গলায় সুর তোলো, বুদ্ধিতে শাণ দাও আর মানুষকে ভালোবাসো। তোমার মনে যদি সত্যিকারের ভালোবাসা থাকে, তা তিন গুণ বেড়ে তোমার কাছেই ফেরত আসবে। আল্লাহ তাদের পরীক্ষা নেন, যাদের তিনি ভালোবাসেন। খুশি হও, আল্লাহ তোমায় ভালোবাসেন।’

আমাদের একটা খুব পছন্দের গান ছিল, যা গাইতাম দ্বৈত কণ্ঠে, ওর হাত ধরে যখন হাঁটতাম, বলত, ইশু, গান ধরো, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন...আমি বাইব না মোর খেয়াতরি এই ঘাটে...’।

লেলুর পরীক্ষার ফল বেরোল। যথারীতি তুখোড়। শুধু তুখোড় নয়, সঙ্গে বিদেশি বৃত্তি। কলেজ পেরিয়ে এবার লেলুর গন্তব্য বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

আম্মুর বায়না, ‘এত দিনের জন্য যাবি, একবার দেশের বাড়ি ঘুরে আসি সবাই মিলে।’ এমনিতে গ্রাম ভীষণ ভালোবাসত লেলু। তবে ঠাট্টার ছলেই সেদিন লেলুর আচমকা প্রশ্ন: ‘যদি মারা যাই, মা?’

আম্মু ধমকে ওঠেন: ‘ধুত্তরি বোকা ছেলে কী বলে না বলে।’

ফরিদপুরে পদ্মার শাখা নদী কুমারের পাড়ে আমাদের গ্রামটি ছবির মতো সুন্দর। তবে তখন নদী পারাপারের জন্য বাঁশের সাঁকো ছিল, আধুনিক কিছু নয়।

বেশ কাটল কদিন। ঢাকা ফেরার দিন আমার ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। এমনিতে ভোরের পাখি আমি। উঠেই যেন হোঁচট খেলাম, ‘আব্বু, লেলু? কই লেলু? আজ আমায় তোলেনি, আমাকে হাঁটা বে না? লেলু কই? লেলুউউউউউউউউউ...।’

আমায় দেখে বাবা হাসেন, হায়রে, ভাই নেওটা বোন রে...। লেলু চা–পাতা কিনতে গেছে, এই এল বলে।

আমি বলি, দোকান খুলেছে?

আব্বু হাসেন, আরে ভাইয়া আসবে ভাবিস না...।

দূর থেকে পরিচিত একজনকে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসতে দেখলাম। ছোট্ট আমাকে কোলে তুলে নিয়েছে কেউ ততক্ষণে।

বলি, অ ধলা কাকা (গ্রামের তরুণেরা আব্বুকে ধলা কাকা ডাকে, আর উনি বয়স্কদের ধলা ভাই) লেলিন ভাই বাড়ি আছে না?

না তো, সে গেছে চা আনতে।

কাকা গো, ওই চারের (সাঁকো) (ও)পর তে (থেকে) পইড়ে গ্যাসে কেউ...।

মুহূর্তে পাল্টে গেল আব্বুর হাসিমুখ। চিৎকার দিয়ে উঠলেন উনি। ‘আমার ছেলেটা যে সাঁতার জানে না রে...।’

আব্বুর গায়ে জামা ছিল না। খালি গায়েই ছুটলেন নদীর দিকে। আম্মুর শাড়ি অগোছাল, পেছন পেছন তিনিও ছুটেছেন। আর আমার তখনো প্রশ্ন: লেলু কই?

আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো প্রতিবেশীর বাড়িতে। যত প্রশ্ন করি: ভাইয়া কই? এক উত্তর। আসবে।

একদিন কোন দিক দিয়ে পার হলো জানি না। পরদিন আমাকে কোলে তুলে নিলেন কোনো এক প্রতিবেশিনী। ‘চল’। ‘কাকি, আমরা কই যাই?’ উত্তর এল: ‘শেষ দেখা দেখতি হবি তুমার।’

মানে কী? উত্তর নেই।

যা দেখলাম, দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না মোটেও। কাফনের কাপড়ে জড়ানো, পানিতে কুঁচকে যাওয়া মুখ, আর কানের কাছে শামুক ভরা। ‘লেলু ঘুমায় ক্যান কাকি?’ ডুকরে ওঠেন তিনি: ‘ও যে আর নাই রে মা!’

এরপর অনেক বছর কেটেছে। সাতের পর আরও অনেক বসন্ত পেরিয়ে এসেছি। এত বয়সের পার্থক্য ভাইবোনদের সঙ্গে বলেই চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ। এ বয়সের পরিচিত মানেই ভাইয়া/আপু, দাদা/দিদি। সব ভাইবোনেরা এ বয়সেরই যে। আজও বছর ঘুরে ৫ ফাল্গুন/ ১৭ ফেব্রুয়ারি আসে। তবে বহু বছর হয়ে গেল, লেলুকে বলা হয়নি, ‘শুভ জন্মদিন’। এ কারণেই বসন্ত উৎসবে অংশ নিলেও তা আমার মনে খুব একটা দাগ কাটে না। আত্মীয়রা অবাক হন, তোমার মনে আছে ওকে? এতটুকু ছিলে তুমি। কী করে বলি, বহু বছর যখন পড়বে না মোর, মনে পড়লেও গাই না, পারি না। হয় গলা ধরে আসবে, নয়তো গানের মাঝেই চোখের জলের বাঁধ ভাঙবে। আজ কাঁদতে হয় ওড়নার আড়ালে পালিয়ে। লেলুকে খুঁজতে হয় দাবায় পাওয়া পুরস্কার, নয়তো ওর হাতে লেখা কবিতার মাঝে। আজ নিজের চোখ নিজেকেই মুছতে হয়। অমনভাবে কেউ বলে না: ‘বাবুরে, কাঁদে না।’ সবাই আছে, শুধু আমার বন্ধুটি হারিয়ে গেছে। শুভ জন্মদিন লেলু।
...

কাজী ফাল্গুনী ঈশিতা: ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।