উড়ন্ত বিমানে

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

প্লেন এখন এতটা উঁচুতে যে অনেকখানি নিচে পড়ে আছে স্তরীভূত মেঘের সীমানা। সূর্যস্নাত নরম আকাশের নীল সমুদ্র পেরিয়ে দুর্নিবার গতিতে ছুটে চলেছে আমেরিকান এয়ারলাইনসের ৪৩৮১ নম্বর ফ্লাইট। জানালার পাশে আসন হওয়ায় একঢল তরল আলো সোনা ছড়িয়েছে বহ্নির কোলের ওপর। ওভাল শেপ জানালার কাচ দিয়ে এখন আর নীলাভ সুতোর মতো সর্পিল ভঙ্গিতে এঁকেবেঁকে চলা দুরন্ত ওহাইও নদীটাকে চোখে পড়ছে না। চোখে পড়ছে স্তরে স্তরে আপন খেয়ালখুশিমতো মহাশূন্যের নিঃসীম প্রান্তরজুড়ে ফুটে থাকা চারু মেঘের কারুকাজ। কোথাও সেই মেঘ ঝুলে রয়েছে এবড়োখেবড়ো অমসৃণ চেহারায় পাহাড়ের মতো উত্তুঙ্গ হয়ে। কোথাও রাশি রাশি পেঁজা তুলোয় ছড়িয়ে পড়েছে বন্ধনহীন উল্লাসে। কোথাও সে সাদা ফুলের পাপড়ি মেলে অনবদ্য সজ্জায় সজ্জিত। আবার কোথাও বা সেই মেঘ টুকরো টুকরো অংশ হয়ে ছেঁড়াখোঁড়া চেহারায় খেয়ালখুশিতে উড়ছে। যেন দলগোত্রহীন লাখো চিলের ডানা। হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে তার সঙ্গী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। রানওয়ে থেকে উড়ে যাওয়ার মুহূর্তে নদীর বুকে যেসব যাত্রীবাহী ক্রুজগুলো চোখে পড়েছিল, তারাও সবাই হারিয়ে গিয়েছে দৃশ্যমানের বাইরে। এবার মহাশূন্যের ভারহীন স্পেসে শুধুই ভেসে বেড়ানো দীর্ঘ সময় ধরে।

নিজের আসনে বসার আগেই বহ্নির চোখে পড়েছিল, মাঝখানের আসনে একজন ষাটোর্ধ্ব ককেসাস নারী চায়নিজ অরিজিনের তিন শিশুকে সিটবেল্ট পরিয়ে দিচ্ছেন পরম মমতায়। তাঁদের দুটি ছেলে। একটি মেয়ে। বয়স সম্ভবত ছয় থেকে চারের বেশি নয়। মেয়েটাই সব থেকে বড়। সিল্টবেল্ট পরে নিতে নিতেই তাঁর কানে এসেছিল, ‘ড্যানা, না!’ আমি বলছি সিটবেল্ট একদমই খুলে রাখার চেষ্টা করবে না এখন! ফাসেন ইট। ফাসেন ইট। এক্ষুনি। হ্যাঁ, এক্ষুনি বাঁধো। একটুক্ষণের নীরবতা না কাটতেই কচি স্বরের মিঠে বুলি শোনা গিয়েছিল পরক্ষণে, ‘মামি, আমি এখন রেস্ট রুমে যেতে চাইছি।’ এখন নয় হানি। তোমার মাথার ওপরে সাইনটার দিকে তাকাও। দেখো, ওখানে সিটবেল্ট খুলতে বারণ করা হচ্ছে। ওই চিহ্নটা যখন মুছে যাবে তখন তোমায় নিয়ে যাব। কিন্তু কেন বারণ করা হচ্ছে মামি? কারণ প্লেনটা এখন তার পজিশন বদল করছে রানওয়ে ছেড়ে আকাশে ওড়ার জন্য। সিটবেল্ট না পরলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এখানকার সব নির্দেশ তোমায় অনুসরণ করতে হবে সুইটি।

বহ্নির কান সচেতন হয়েছে কচি কণ্ঠে ‘মামি’ সম্বোধন শুনে। তাঁর ধারণা হয়েছিল, শিশুগুলো সহযাত্রীনির নাতি-নাতনি হবে। সাদাদের চীনা স্ত্রী কিংবা স্বামী সংগ্রহের বাস্তবতা এখন আমেরিকায় অহরহই ঘটছে। শারীরিকভাবে তাদের বংশধরেরা প্রধানত বাবা-মার চেহারার জাতীয় বৈশিষ্ট্যের ডোমিন্যান্ট ফিচারগুলোই প্রাপ্ত হয়। যেমন সাদাদের সঙ্গে ইয়েলোদের মিলনে যে শিশু জন্মায়, তারা চায়নিজ ডোমিন্যান্ট ফিচারে নাক ও চোখের প্রভাব এড়াতে পারে না। সাদাদের থেকে শিশুরা পায় চুল ও গায়ের রং। সব মিলিয়ে চেহারা যা দাঁড়ায় সেটা একটা নতুন রেশ তৈরি করে বটে। নৃবিজ্ঞানীরা বলছেন, সুদূর অতীতে জনসমুদ্রের মহামিলনে এভাবেই জন্ম নিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠী। ভবিষ্যতেও এভাবেই তৈরি হবে মানবজাতির নতুন প্রজাতি। যা বিজ্ঞানীদের কাছে হয়ে উঠবে মননশীল গবেষণার অফুরন্ত বিষয়।

ড্যানার মুখে মাতৃ সম্বোধন শুনে বহ্নির অনুমান করতে বিলম্ব হয়নি এই ষাটোর্ধ্ব নারী শিশুদের চীন, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম কিংবা লাওসের কোনো এতিমখানা থেকে দত্তক এনেছেন হয়তো অপত্যস্নেহের দাবি মেটাতে। কিংবা বিশ্বপ্রেমিক মানবহিতৈষীরা যেমন বিশ্বের অসহায় মানুষের কল্যাণে সদা সহানুভূতিপূর্ণ, ইনিও তাঁদেরই একজন। সাদা কথায় যাঁদের বলা হয় মানবহিতৈষী। উনিশ শতকের গোড়ায় ইউরোপ-আমেরিকায় শিল্পবিপ্লবের ফলে নিষ্পেষিত শিল্পশ্রমিকদের সাহায্য–সহযোগিতার উদ্দেশ্য নিয়ে এঁদের কর্মধারা গড়ে উঠেছিল। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তাঁর মনে হলো, যিনি পিতৃমাতৃহীন শিশুদের মাতৃস্নেহে লালন করার দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন, শিশুরা তাঁকে ‘মামি’ সম্বোধন করবে না তো কাকে করবে আর?

প্রতিটি আসনের সঙ্গে ছোট ছোট অ্যাটাচড টিভি। কোনো কোনো যাত্রী রুচি অনুযায়ী অনুষ্ঠান দেখছেন সেখানে। পেছনের আসনে দক্ষিণ ভারতের এক তরুণ দম্পতি বসেছেন, একটু পরেই জানা গেল এয়ার হোস্টেসের কথায়। তিনি অপ্রস্তুতভাবে বললেন, ‘মিস্টার সুব্রামনিয়াম, দুঃখিত। আপনার ছেলের জন্য গরম দুধ দিতে পারছি না। চাইলে ক্র্যাকারের সঙ্গে আপেল জুস দিতে পারি।’ সুব্রামনিয়াম সবিনয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ। সেটাই দিন তাহলে।’ বোঝা গেল সুব্রামনিয়াম তাঁর শিশুপুত্রের জন্য দুধের অনুসন্ধান করেছিলেন। এয়ার হোস্টেসের নামটা চোখে পড়ল বুকে আঁটা ট্যাগের দিকে তাকাতে। আরিয়ানা গোভাস্কি। দীর্ঘ চেহারার তন্বী তরুণী। কাঁকড়াবিছের মতো অসম্ভব এক্সপ্রেসিভ এক জোড়া চোখ। চলে যাওয়ার সময় তাঁর দিকে নজর পড়তেই একঝলক হাসলেন সাঁঝবেলাকার শুকতারাটির মতো। সুব্রামনিয়াম কিছুটা ক্ষোভের সুরে পুত্রের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আয়ুশ, এয়ারপোর্টে যখন বারবার খেতে বলা হয়েছিল তখন খেলে না কেন? তোমায় বলেছিলাম, শিকাগো না পৌঁছালে খাবার পাবে না। এখন তাহলে খাওয়ার জন্য কেন বায়না ধরেছ এভাবে?’ উত্তরে আয়ুশের মায়ের জবাব শোনা গেল, ‘কী করে খাবে? ওর চোখের ঘুমই তো কাটেনি তখনো।’ ‘তাহলে বাড়ি থেকে শুকনো খাবার কেন আনোনি সঙ্গে? জানোই তো, এত কম সময়ের জার্নিতে ক্র্যাকার ছাড়া আর কিছু দেয় না আজকাল?’ মিসেস তারপরও বললেন, ‘এটাই বা কী রকম? এত বড় ফ্লাইটে ছোট বাচ্চাদের জন্য একটু দুধও রাখতে পারে না?’

সুচরিতদের আসনের সামনের দুটো সারি পরেই একজন চীনা ভদ্রলোক ওভারহেড কম্পার্টমেন্ট থেকে নিজের লাগেজ নামাতে গিয়ে হ্যাঁচকা টানে পাশেরটা ফেলে দিলেন অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ তুলে। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুব্ধ মেজাজের অস্ফুট প্রতিক্রিয়া শোনা গেল পেছন থেকে, ‘ইস! চিনুগুলোর এ দেশে এসে বড্ড বাড় হয়েছে দেখছি। কুড়ি মিনিট সময় পার হয়নি প্লেন ছেড়েছে, দেখো এরই মধ্যে লাগেজ ধরে বিরক্তিকর টানাটানি।’ স্পষ্ট মন্তব্য সুস্পষ্ট বাংলা ভাষায়। সুচরিত মজা পেয়ে বহ্নির কানের কাছে ফিসফিস করল, বাংলায় কথা বলছে! গালাগাল দিয়ে ভাবছে এখানে কোনো বাঙালি নেই। কেউ বুঝতেই পারছে না। বলেই হাসল সামান্য। চীনা ভদ্রলোক নিজের ছোট্ট ভুলটাকে অপরাধ মনে করে অপ্রতিভ চেহারা নিয়ে রীতিমতো কসরত করতে করতে লাগেজটাকে রাখতে গেলেন যথাস্থানে। তারপর নিজের দেহের উচ্চতার কারণে পৌঁছাতে না পারায় অপ্রস্তুত দৃষ্টি ছড়িয়ে তাকালেন আশপাশে, ‘স্যরি। আই ক্যান্ট রিচ দেয়ার।’ কার উদ্দেশে বললেন কে জানে। কেবিন ক্রু কিংবা এয়ার হোস্টেসরা কাছাকাছি কেউ ছিলেন না। কিন্তু তাঁর নিবেদন ব্যর্থ হলো না। গম্ভীর চেহারা নিয়ে একজন সুদর্শন সাদা তরুণকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। একটিও কথা না বলে ভদ্রলোকের হাত থেকে ভারী লাগেজটা তুলে অনায়াসেই বসিয়ে দিলেন সঠিক জায়গায়। তারপর কম্পার্টমেন্ট বন্ধ করে ফিরে গেলেন নিজের আসনে। চীনা ভদ্রলোক কৃতজ্ঞতায় কয়েকবার তরল গলায় উচ্চারণ করলেন, ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।। এরপর যতক্ষণ না আমেরিকান এয়ারলাইনস ৪৩৮১ ফ্লাইট, শিকাগোর বিমানবন্দরে অবতরণ করল, চীনা ভদ্রলোক নিজের আসন ছেড়ে নড়ার নামটিও করলেন না আর।

ধাপে ধাপে বিমান নামছে নিচের দিকে। ঘন মেঘের শামিয়ানা কেটে আঁধারঘেরা পরিবেশে এখন সেটা দুস্তর মেঘের আড়ালে অদৃশ্য। ফ্লাইট ইন্টার ফোনের মাধ্যমে যাত্রীদের কিছুক্ষণ আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বিমান ৩০ মিনিটের মধ্যে অবতরণ করতে চলেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে তার সামনের চাকা প্রথম স্পর্শ করল কংক্রিটের বুক। জোর ধাক্কায় ৪৩৮১ নম্বরের বিশাল দেহটা একবার কেঁপে উঠল শিহরণ তুলে। তারপরেই ব্যালান্সড হতে হতে শান্ত হয়ে গেল। মাত্র দুই ঘণ্টায় ওহাইওর সিনসিনাটি থেকে ইলিনয় রাজ্যের কসমোপলিটন শিকাগোর বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলেন যাত্রীরা। জানালার ফাঁকে বাইরে তাকাতেই যাত্রীরা বুঝলেন, সম্ভবত ঘণ্টাখানেক আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। (চলবে)