জাপানের আকাগি পাহাড়ে প্রবাসীদের আনন্দভ্রমণ

আকাগি পাহাড়ে আনন্দভ্রমণে অংশগ্রহণকারীরা
আকাগি পাহাড়ে আনন্দভ্রমণে অংশগ্রহণকারীরা

‘ভ্রমণ মানুষকে বিনয়ী করে তোলে। সে জানতে, পারে দুনিয়ার তুলনায় সে কত ক্ষুদ্র।’—গুস্তাব ফ্লুবেয়ার।

জাপানে টানা ১০ দিনের দীর্ঘ ছুটি শুরু হয়েছিল গত ২৭ এপ্রিল। এই ছুটির দুই দিন আমাদের কাটল পাহাড়বেষ্টিত গুন্মার আকাগি পাহাড়ে। এর অফিশিয়াল নাম মাউন্ট আকাগিয়ামা। অবস্থান মায়েবাশি শহরের ফুজিমি মাচি। জাপানের গুন্মা প্রিফেকচার বিখ্যাত উষ্ণ প্রস্রবণ আর বরফ স্কির জন্য। ছোট্ট শহর কুসাৎসুতেই আছে শতাধিক উষ্ণ প্রস্রবণ। পাশাপাশি তিনটি পাহাড়—আকাগি, মিয়োগি ও হারুনা।

আকাগি প্রিফেকচারাল পার্ক
আকাগি প্রিফেকচারাল পার্ক

তোচিগি প্রদেশের আশিকাগা শহরে বসবাসরত রাজু-লুবনা জুটির আগ্রহে ও অক্লান্ত পরিশ্রমে সম্ভব হয়েছিল প্রবাসী বাংলাদেশি ৪০টি পরিবারের শতাধিক সদস্যের এই পাহাড়ভ্রমণ। সবাই টোকিওর পার্শ্ববর্তী তোচিগি, গুন্মা ও ইবারাকি প্রদেশে স্থায়ী হিসেবে বসবাসরত। বাড়তি আমরা কয়েকজন আমন্ত্রিত অতিথি।

রাজু-লুবনা দম্পতির পীড়াপীড়িতে আমাদের কয়েকজনকে আগের রাতেই তাঁদের বাসায় পৌঁছতে হয়। তাঁদের রাতভর আতিথেয়তার বিড়ম্বনা সহ্য করে শেষ রাতে যখন ঘুমোতে যাই, তখন কথিত নাসিকা গর্জনের অভিযোগে আমাকে ড্রয়িংরুমে পাঠিয়ে পুরো রুমটা দখল করে নেন বন্ধু আসলাম হীরা। ড্রয়িংরুমে আমার বিছানায় এসে ভাগ বসাল জুয়েল। তাঁর স্ত্রী শাম্মি নাকি ওর নাকডাকার কারণে ঘুমাতে পারছেন না তাই। পরে শুনেছি, ওপরতলার ওঁরা নাকি ভূমিকম্প হচ্ছে বলে ভেবেছিলেন।

আনন্দভ্রমণের একটি দৃশ্য
আনন্দভ্রমণের একটি দৃশ্য

২ মে বেলা ১১টার মধ্যে ন্যাশনাল আকাগি ইয়ুথ ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারে সবার পৌঁছানোর কথা থাকলেও অতি আগ্রহী কেউ কেউ সকাল নয়টায় সেখানে পৌঁছে যান। আকাগি স্টেশন থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা দূরত্বে পাহাড়ের মাঝখানে এই সেন্টার। মূলত, স্কুলছাত্ররা, যারা পরিবার ছেড়ে প্রথম যখন একাকী সহপাঠীদের সঙ্গে নিয়ে শিক্ষাসফরে যায়, তাদের জন্য নির্মিত। খেলাধুলায় ব্যস্ত বিভিন্ন গ্রুপের তরুণদের ক্যাম্পিং সেন্টার এটি। প্রায় ৩০০ জনের খাবার, থাকার, খেলাধুলাসহ ফাইভ স্টার হোটেলের সব সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান।

পাহাড়ে ঘুরে এখানেই আমাদের রাতযাপন। আমাদের জন্য প্রায় ৩০টি রুম। একেক রুমে চার বেড। আমি ও হীরা পেলাম বিশেষ সিঙ্গেল রুম। রুম থেকেই দেখা যায় পাহাড়ের অপার সৌন্দর্য। প্রকৃতির লাস্যলীলা।

আনন্দভ্রমণের একটি দৃশ্য
আনন্দভ্রমণের একটি দৃশ্য

শুরুতেই আমরা কনভেনশন সেন্টারে সমবেত হলাম। একজন এই সেন্টারের সব সুবিধার বর্ণনা দিলেন। নিজ হাতে সব কাজ করতে হবে। নিজের বিছানা গোছানো, রুম পরিষ্কার, খাবার সংগ্রহ, খাবার শেষে গ্লাস-থালা-বাটি–চামচ যথাস্থানে রাখা ইত্যাদি। হাঁটার বিকল্প নেই। সবাইকে হাঁটতে হবে। এই ফেসিলেটিজে লিফটের সংখ্যা কম। তাও আবার কখনো এক ফ্লোরের বেশি নয়। লিফটে লেখা আছে ‘হুইলচেয়ার ও বৃদ্ধ না হলে লিফট পরিহার করুন’। আমি দুদিনে কাউকে লিফট ব্যবহার করতে দেখিনি। এমনকি সফট বলের এক বৃদ্ধা শিক্ষিকাকে দেখেছি তাঁর ক্রাচ দিয়ে সিঁড়ি পার হচ্ছেন।

আনন্দভ্রমণের একটি দৃশ্য
আনন্দভ্রমণের একটি দৃশ্য

আমরা সবাই মিলে আমাদের জাতীয় পতাকা নিয়ে সমবেত জাতীয় সংগীত দিয়ে দিনের সূচনা করলাম। যার যার ঘরের চাবি নিয়ে রুমে গিয়ে সামান্য বিরতির পর সবাই মিলে এলাম দুপুরের খাবার খেতে। বিশাল খাবার ঘর। একসঙ্গে ৩০০ জনের খাবার ব্যবস্থা। কী নেই সেখানে! আমাদের জন্য হালাল খাবারের বিশেষ সার্ভিস।

বিকেলে সেন্টারে সবাই মিলে ধন্যবাদ জ্ঞাপন পর্বটি ছিল বিশেষ শিক্ষণীয়। সমবেত সবাই মিলে নিজেদের পরিচয়পর্ব বর্ণনা, জাপানের জাতীয় পতাকা ও সেন্টারের পতাকা দুজন তরুণ ছাত্র করতালির মধ্যে নামালেন। আমাদের দলনেতা নোমান সৈয়দ রাজু বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানালেন। এরপর জন্মমাস অনুযায়ী আমরা বারো পর্বে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের মধ্যে পরিচিত হলাম। আমি আমার গ্রুপে মাত্র একজন প্রবাসী বোনকে পেয়েছিলাম।

বিকেলে আশপাশে পাহাড়ে ঘোরাঘুরি। বারবিকিউ সেন্টার ও তাঁবুতে রাতযাপনের ব্যবস্থা পরিদর্শন ও ছবি তোলার পর্ব শেষ করে বিশাল হলরুমে সমবেত হলাম। সেখানে সবার জমজমাট আড্ডা। সব বাচ্চাকে পুরস্কার দেওয়া হলো।

আনন্দভ্রমণের একটি দৃশ্য
আনন্দভ্রমণের একটি দৃশ্য

আমন্ত্রিত শাম্মী বাবলি সম্প্রতি কলকাতা থেকে তাঁর নতুন রবীন্দ্রসংগীতের সিডি ‘নীরব আশা’ প্রকাশ করার জন্য সংবর্ধিত হলেন। কাজী ইনসানুল হক তাঁর হাতে স্মারক সম্মাননা তুলে দিলেন। আয়োজক দুজন ও উপস্থিত সবার পক্ষ থেকেও শাম্মী পেলেন বিশেষ ফুলেল উপহার। আবেগে আপ্লুত শাম্মী। এত ভালোবাসায় কাঁদো কাঁদো হয়ে গাইলেন তাঁর রেকর্ডকৃত গানের অংশবিশেষ।

পুরুষ ও মেয়েরা গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আড্ডা, ফটো তোলা, ক্যারাম ও তাস নিয়ে মেতে উঠলেন। চলল চা চক্র। সাতটায় রাতের খাবার। তারপর ক্যাম্পফায়ার।

আনন্দভ্রমণের একটি দৃশ্য
আনন্দভ্রমণের একটি দৃশ্য

আমরা কজন বের হলাম রাতের পাহাড় দেখতে। অবসন্ন দেহে রুমে ফিরে ঘুমোতে যাব, সমন এল ঘুম হবে না। পাশাপাশি দুটি চার বেডের রুম সাজানো হলো মুখোমুখি। একদিকে মেয়েরা অন্যদিকে ছেলেরা। আমরা তিন সেট তাসে ১২ জন সঙ্গে সমসংখ্যক সহযোগী।

মেয়েদের রুমে বিচিত্র কণ্ঠে কারাওকে। যত দূর সম্ভব শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী থেকে এম মিউজিক করা শাম্মীর গান গাওয়ার সুযোগ মেলেনি ওই প্রতিভাময়ীদের সিরিয়ালে। তারপর ভোররাতে বিছানায়।

আনন্দভ্রমণের দ্বিতীয় সকাল। মধ্যরাত পর্যন্ত আড্ডার ক্লান্তিতে সবাই রিসোর্টের রুমে ঘুমের অতলে। ছয়টা বাজতেই হালকা মিউজিক বাজিয়ে জানান দিচ্ছে, ওঠো, নাশতা শেষে বেরিয়ে পড়ো। আবার সকালের নাশতা খেয়ে সবাই ছুটলাম দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনে। লেক, মন্দির, কত–কী! দিনের আধবেলা ঘুরে আবারও সেন্টারে এলাম দুপুরের খাবার খেতে। খাওয়া শেষে আবারও আড্ডা।

আকাগি পাহাড়
আকাগি পাহাড়

পড়ন্ত বিকেলে সবার বিদায়। কেউ কেউ যাবেন আশিকাগা ফ্লাওয়ার পার্ক পরিদর্শনে। স্বদেশ ও স্বজন ছেড়ে ভিনদেশে জীবনের ঠিকানা গড়া আমাদের পরিচয়—আমরা প্রবাসী। এই প্রবাসেই স্বল্পকালীন কিংবা দীর্ঘকালীন কারণে অভিবাসী প্রক্রিয়ায় কেউ কেউ সে দেশের নাগরিক, স্থায়ী বা সাময়িক সিটিজেন। মূলত আমরা স্বদেশে ‘প্রবাসী’, ভিনদেশে ‘বিদেশি’। যাপিত জীবনে রক্ত সম্পর্কহীনজনদের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক অটুট হয়ে ওঠে। সুখ-দুঃখ-আনন্দ-হাসিকান্নায় আমরা তাদের সঙ্গেই কাটিয়ে দিই জীবনের মূল্যবান সময়গুলো। এমনকি মৃত্যুর পর সৎকারেও এই অনাত্মীয়রাই পাশে থাকেন।

প্রবাসীর সঙ্গে প্রবাসীর সম্পর্ক যে কতটা অটুট, তা চোখে পড়ল এই বিদায়বেলায়। দুটো দিন এতগুলো মানুষ একসঙ্গে ছিলাম। যেন একই পরিবার। তাই বিদায়বেলাটায় সবাই কিছুটা বিষণ্ন হয়ে গাড়ি স্টার্ট করলেন।

বিদায় আকাগি, বিদায়।