আলোর সাজে রাতের প্যারিসে

ব্যাসিলিক দু সাক্রে কর-এর চত্বর থেকে প্যারিসের স্কাই লাইন
ব্যাসিলিক দু সাক্রে কর-এর চত্বর থেকে প্যারিসের স্কাই লাইন

কিচেন থেকে ইরাদকে ডাক দিয়ে বাবাই জানতে চাইল, তুই কি এখন খাবি? খাবার মাইক্রোওভেনে দেব?

ইরাদের চটপট উত্তর, দে। আমি আসছি।

এই কথোপকথনের সময় ছিল ৬টা বাজার মাত্র ৫ মিনিট আগে। কেন সময়টা বললাম? কারণ আমাদের ট্রেন ছাড়ার সময় সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে। আমাদের বাসা থেকে বানহফে (ট্রেনস্টেশন) পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগে ৭-৮ মিনিটের মতো। আর ইরাদ কনকনে শীতের সকালে গোসল সেরে রেডি হতে গেল! আবার দুই বন্ধু খাবারসংক্রান্ত আলোচনাও করছে। কেয়া বাত। অন্য কেউ হলে আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যেতাম। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কেন হলাম না? কারণ এই বালকসুলভ ভদ্রলোকটি আমার আর আমার বরের শিশুকাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রিয় বন্ধু। বিশেষ করে আমার বর আর তার বন্ধুত্ব অন্য লেভেলের। সদ্য বিয়ে করে মিষ্টিমতো বউসমেত উনি ইউরোপ ট্যুরে বের হয়েছেন। সবাই রেডি, শুধু ইরাদ বাদে! এই হলো আমাদের ইরাদ। আমি পুত্রকে নিয়ে আগেই দৌড়ে বের হয়ে গেলাম। বাবাই বলল, ওদের নিয়ে সে আসছে। বিশ্বাস করুন, আমার চোখের সামনে দিয়েই ট্রেনটি নির্দিষ্ট সময়ে ছেড়ে গেল! তখনো তারা স্টেশনে পৌঁছাতে পারেনি। আমরা তড়িৎ গতিতে বের হয়ে গেলাম ট্যাক্সির খোঁজে। বের হয়ে দেখি বৎস হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলছে, যাহ্ আমাদের রাইখ্যাই গেল গা!

স্কাই লাইন
স্কাই লাইন

এখন ট্রেনের কানেকশনের ব্যাপারটা বলি। আমাদের ওই ট্রেনে করে ফ্রাঙ্কফুর্টের হফটবানহপে (মেইন স্টেশনে) যাওয়ার কথা ছিল। যেখান থেকে আমার প্যারিসগামী ট্রেনটি ছাড়বে এবং যথাসময়েই ছাড়বে। ওটা আইসিই মানে জার্মানি থেকে অন্য দেশে যাওয়ার জন্য। ওটাও যদি মিস হয় তাহলে সব প্ল্যানের ওখানেই সমাপ্তি। কোথায় যাচ্ছি? আমরা রাতের প্যারিস দেখতে যাচ্ছি। যাক শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই যাত্রা শুরু করলাম। আইসিই ট্রেনের গতি থাকে ঘণ্টায় প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার। জার্মানি থেকে প্যারিসে যেতে প্রায় সাড়ে ৩-৪ ঘণ্টার মতো সময় লাগে।

প্যারিসে পৌঁছে বাসস্টপেজ খুঁজতে লাগলাম। কোন বাসটা আমাদের হোটেলের দিকে নিয়ে যাবে মোবাইলের অ্যাপসে খুঁজতে খুঁজতেই কিছু সময় পেরিয়ে গেল। অবশেষে হোটেলে পৌঁছালাম। ঠিক করলাম ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করতে বের হব। খুঁজে খুঁজে একটা দোকান পছন্দ হলো। প্রচণ্ড ভিড়! খাবার অর্ডার করলাম। কিন্তু হায় রে, সময় পেরিয়ে যায়, খাবার দেওয়ার আর সময়ই হয় না। এমন ক্ষুধা লেগেছে যে মনে হচ্ছে দিই কারও মাথা ফাটিয়ে। এদিকে আমাদের পুত্রও অস্থির হয়ে গিয়েছে। আমি ভাবছিলাম, দেশে হলে মনে হয় এতক্ষণ মারামারিই বাধিয়ে দিতাম! প্রায় এক ঘণ্টা পরে খাবার সার্ভ করল এবং দেরি করার জন্য ক্ষমা চাইল। আমরা মোটেও ক্ষমা না করে খেতে শুরু করলাম। ইয়া খোদা, কী বাজে রান্না! সবাই ভারাক্রান্ত মনে সেটাই খেলাম। আমি একটু চুপ মেরে গেলাম ভয়ে। কারণ বাবাই বলেছিল যে সবার জন্য ডোনার বা বার্গার কিনে খেতে খেতে দেখা শুরু করা উচিত। আমিই বাগড়া দিয়ে বলেছিলাম, না, চলো কোথাও বসি, কতক্ষণ আর লাগবে। দল ভারী করার জন্য আবার নতুন বউ রিমিকেও বলেছিলাম, তাই না বলো? অগত্যা চুপ থাকাই নিরাপদ, তাই না বলেন?

আইফেল টাওয়ার Jardins du Trocadéro থেকে
আইফেল টাওয়ার Jardins du Trocadéro থেকে

প্যারিসে দেখার এত কিছু আছে যে চার-পাঁচ দিনেও মনে হয় দেখে শেষ করা যাবে না। তবে আমাদের যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল শুধু রাতের প্যারিস দেখা, দ্য সিটি অব লাইট! রাতের শহরকে দেখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো একদম উঁচু থেকে পুরো শহরটাকে উপভোগ করা। এর অন্য রকম রোমাঞ্চ আছে বৈকি। তাই রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে দেখব বলে আমরা ঠিক করলাম। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উঠলাম অনেকখানি ওপরে। প্রথমেই আমরা ঠিক করলাম ব্যাসিলিক দু সাক্রে করে (Basilique du Sacré-Cœur) যাব। বিকেল আর গোধূলির শহরের গায়ে কীভাবে খেলা করে সেটাই দেখব। ভাবছেন, চার্চে গিয়ে আবার এসব কীভাবে দেখা যায়? চার্চের ঠিক সামনেই বিশাল চত্বর। সেখানে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার ট্যুরিস্ট কর্মব্যস্ত শহরকে দেখছেন। ব্যস্ত শহরকে সবার অগোচরে উপভোগ করতে পারায়ও বোধ হয় একটা মাদকতা রয়েছে, নইলে এত এত মানুষ শুধু সামনেই চেয়ে রয়েছিল কেন? কেনই বা আমারও সেখান থেকে ফিরে আসার সময় মন কেমন করছিল! নামার সময় আমরা কেবল কারের টিকিট কেটে নিচে নামলাম।

সেইন নদীর ওপর
সেইন নদীর ওপর

এবার গন্তব্য রাতের আইফেল টাওয়ার। আমরা আইফেল টাওয়ার দুটো জায়গা থেকে দেখব বলে ঠিক করলাম। একটা নিচে থেকে, আরেকটা Jardins du Trocadéro (Gardens of the Trocadero)-এর ওপর থেকে। প্যারিস সিটিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য সবচেয়ে সহজ যোগাযোগমাধ্যম হচ্ছে মেট্রো। টিকিট কেটে রওনা হলাম। পৌঁছে দেখি বেশ ভিড়। টাওয়ারের চূড়ায় ওঠার জন্য রয়েছে এলিভেটর ও সিঁড়ি। হাজার হাজার দর্শনার্থী আইফেল টাওয়ারের আশপাশে জটলা করে রেখেছেন। কেউ ছবি তুলছেন আবার কেউ টাওয়ারের পাশ দিয়ে বহমান সেইন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে টাওয়ারের সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। নদীতে আবার ক্রুজ লাইনও দেখতে পেলাম। হঠাৎ সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল একসঙ্গে। তাকিয়ে দেখি পুরো আইফেল টাওয়ারে আলোর খেলা শুরু হয়েছে। জানতে পারলাম প্রতি এক ঘণ্টা পরপর এভাবে আলোর খেলা চলে। ঠিক করলাম পরের আলোর খেলাটা না হয় Jardins du Trocadéro থেকেই দেখব। সেখান থেকে আইফেল টাওয়ারের রাতের সৌন্দর্য দেখে মনে হলো যেন চোখ আটকে গিয়েছে আমার। একটা বদখত দেখতে লোহার টাওয়ারও যে রাতের বেলায় এমন সুন্দর দেখাতে পারে, না দেখলে সত্যিই ফটোশপের কারসাজি বলেই ধরে নিতাম।

এবার খানিকটা ট্র্যাজেডি! কী হলো কী হলো? প্রতিবার মেট্রোর টিকিট পাঞ্চ করে আমাদের টিম লিডারের কাছে জমা দিতাম। টিম লিডারটা আবার কে? আমার বর! আমাদের সব প্ল্যান, হোটেল ঠিক করা সবই তারই করা। এবার যখন আইফেল টাওয়ার থেকে লুভর মিউজিয়ামের দিকে যাব বলে ঠিক করেছি, তখনই বিপত্তি ঘটল! সে আর কী বলব! তখন রাত প্রায় ৮টা ৩০, সবাই টিম লিডারের কাছে টিকিট জমা দিয়ে এগোচ্ছি তখনই দেখতে পেলাম সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বাইরে যাওয়ার। হলোটা কী? এদিকে ফ্রেঞ্চে কী যেন বলেই যাচ্ছে, আমরা কী আর থোড়াই বুঝতে পারছি। সামনেই দেখলাম সবার টিকিট চেকিং করছে রেলওয়ে পুলিশ। আমাদেরগুলো দেখতে চাইল। তখনই ঘটল ঘটনা। একজনেরটা বাদে আর কারও ব্যবহৃত টিকিটগুলো খুঁজেই পাওয়া গেল না। আমাদের তখন আত্মা শুকিয়ে ভয়াবহ অবস্থা! রিমির টিকিট পাওয়া গিয়েছে, তাকে আর আমার পুত্রকে অন্য সাইডে দাঁড়া করিয়ে বাহাস শুরু হলো। মনে হচ্ছিল হার্টের ধুকপুক যেন এক মাইল দূরে থেকেও শোনা যাবে। আমাদের ফাইন করা হলো এবং কোনোভাবেই আমরা বিশ্বাস করাতে পারলাম না যে আমাদের সত্যিই টিকিট ছিল! ১২০ ইউরো ফাইন হলো। মনে হলো আমরা কেঁদেই ফেলব। আমার বরের চোখ–মুখ লাল হয়ে গেল দুঃখে আর রাগে। আমাদের দেশে কিন্তু এ ধরনের কেস বা সিচুয়েশন খুব সহজেই ডিল করা সম্ভব, আপনারা সবাই নিশ্চয়ই সেটা জানেন। কারণ, সবাই কারণে বা অকারণে ভুক্তভোগী। কিন্তু এখানে আইন খুবই কড়া। তার চেয়েও বড় কথা সবাই সেটা ফলো করছে। এমনকি নিরাপত্তার খাতিরে ও অবাঞ্ছিত ঘটনা এড়াতে রাত ১০টার ভেতরেই মেট্রো বন্ধ করে দেওয়া হয়ে থাকে।

লুভর মিউজিয়াম
লুভর মিউজিয়াম

নিজেদের অসতর্কতায় গচ্চা দিয়ে তখন আমরা সবাই বিমর্ষ। লুভর মিউজিয়ামও তখন বন্ধ করে দিয়েছে। তবে মিউজিয়ামের সামনের চত্বরে তখনো অনেক ট্যুরিস্ট। তখন আমাদের কারোরই আর কিছুই ভালো লাগছে না। কেমন যেন একটা চোর চোর ফিলিং হচ্ছে। টিকিট কাটলামও টাকা দিয়ে, আবার হারিয়েও টাকা গচ্চা দিতে হলো। আমরা হোটেলে ফিরব; কিন্তু কেউই আর মেট্রোতে ফিরতে চাইলাম না। খুঁজে খুঁজে বাস স্টপেজে গেলাম আর বাসের অপেক্ষায় থাকলাম।

ভেবেছিলাম রাতে ফরাসি রেস্তোরাঁয় বসে ডিনার সেরে নেব। আর ভালো লাগল না, তাই হোটেলে ফিরেই খাওয়া শেষ করলাম। পরের দিন হাঙ্গেরিতে যাত্রা করব। তাই মনের দুঃখ আপাতত বাক্সবন্দী করে রেখে পরের দিনগুলোতে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমাতে গেলাম। আর বাইরে তখনো আলো ঝকমক করছে, তখনো জেগে আছে রাতের প্যারিস!