প্রবাসী এক বাঙালি মেয়ের অশ্রুত কাহিনি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘আপা আপা প্লিজ আজ ফোনটি ছাড়বেন না, ওরা মারছে, আমাকে মেরে ফেলবে...।’ তারপর ক্রমাগত ভেসে আসে কিছুটা তীব্র আর একই সঙ্গে অস্ফুট স্বরের আর্তনাদ—আপা আপনি বাঁচান আমাকে মারছে, কিছু করুন বলুন।’

এভাবেই বছর তিনেক আগে এক সন্ধ্যায় হ্যালিফ্যাক্সের বাসায় আমার সেলফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসছিল এক তরুণীর আকুল ভয়ার্ত কান্নাভেজা কণ্ঠ আর আর্তনাদ। ফোনটি এসেছিল কানাডার অন্য এক শহর থেকে। তার নাম কণা (প্রকৃত নাম নয়)। সে ছিল আমার পরিচিত। রাতের সব নীরবতা ভেঙে খান খান করে দিচ্ছিল তার আকুল অনুরোধের সেই আর্তি। আমি এ প্রান্ত থেকে সহজেই উপলব্ধি করেছিলাম মেয়েটি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। উপায়ন্তর না দেখে সরাসরি হ্যালিফ্যাক্স পুলিশে ফোন করার জন্য আমার জীবনসঙ্গী এহসানকে অনুরোধ করেছিলাম। আর আমার সেলফোনটি ধরে রেখে কণাকে বললাম ফোনটি যেন সে স্পিকারে রাখে। উদ্দেশ্য একটাই তার শ্বশুর পরিবারের সদস্যরা যেন অবগত হয় সে একা নয়। এতে তার নির্যাতনের মাত্রা হ্রাস পাওয়ার কিছুটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। বাস্তবে অবশ্য টেলিফোনের এই প্রান্তে আমার প্রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা।

সেই দিনটি ছিল বিশ্ব মা দিবস। প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমি বাসায় নৈশ আহারের প্রস্তুত প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত ছিলাম। এ সময় আমার সেলফোন বেজে ওঠে। তখন আমার একপাশে মা দিবস উদ্‌যাপন উপলক্ষে আমাদের ছোট দুটি বাবু যথারীতি নানা কায়দা অনুসরণ করে গভীর মনঃসংযোগ করে তাদের ছোট দুটি হাত দিয়ে কাগজ কাটায় ব্যস্ত ছিল। তাদের পরিকল্পনা মা দিবসে এক ব্যতিক্রমধর্মী কার্ড প্রস্তুত করে আমাকে চমকে দেবে। শিশু মনস্তত্ত্ব অপার সারল্যে আবর্তিত। তাই জীবনের জটিল সমীকরণ সম্পর্কে তারা প্রায় অজ্ঞাত। চমক দেওয়ার সঙ্গে গোপনীয়তার ধারণাটিরও যে এক অভিন্ন সম্পর্ক আছে সেই বোধ তাদের তখন জন্মায়নি। তাই তাদের আগামীর এই চমকে দেওয়ার পরিকল্পনায় আমাকেই মাঝেমধ্যে অভিনব কোনো ধারণা দিতে হচ্ছিল।

যা হোক রান্না প্রক্রিয়ায় কিছুটা থামিয়ে ফোনে কণার সঙ্গে অনেকটা ইচ্ছে করেই কথোপকথন চালিয়ে যেতে লাগলাম। উদ্দেশ্য একটিই যাতে করে তার শ্বশুর পরিবারের সদস্যরা আমাদের দুজনের কথোপকথনের সব বিষয় অবগত হয়। মেয়েটি ইতিমধ্যে কোনোক্রমে অন্য একটি ঘরে প্রায় দৌড়ে চলে গিয়েছিল।

আমার জীবনসঙ্গী এহসান ইতিমধ্যে হালিফ্যাক্সের পুলিশকে ফোন করে। হ্যালিফ্যাক্স পুলিশ কানাডার সেই শহরটির কর্তব্যরত সহযোগীদের কণার নির্যাতনের বিষয়টি দ্রুত অবহিত করেছিল। বলাই বাহুল্য কানাডার পুলিশ বিভাগ এ ক্ষেত্রে বেশ করিতকর্মা। এখানে যে কেউ ৯১১ নম্বরে ফোন করার কয়েক মিনিটর মধ্যে ঘটনাস্থলে পুলিশ সদলবলে উপস্থিত হয়। আমি কণাকে বলেছিলাম তার শ্বশুরকে যেন সেলফোনটি দেয়। কণা ফোন হস্তান্তর করলে আমি তাঁকে বললাম, কণার দেহে যেন কোনো প্রকার আঘাত বা প্রহার না করা হয়। প্রত্যুত্তরে তিনি বেশ রুক্ষ ও রাগত স্বরে আর অবজ্ঞাভরে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি তখন কানাডার মূলধারার একটি রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানালাম। এই সময় উপলব্ধি করলাম, তাঁর গলার স্বর যেন সামান্য কোমল নমনীয়তার রেশ ছড়াল। তিনি বিষয়টিকে একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে চিত্রিত করা করে জানালেন, এটি স্বামী আর শাশুড়ির সঙ্গে বিরোধ আর একান্ত পারিবারিক বিষয়। আমি যেন হস্তক্ষেপ না করি।

আমি তাঁর বক্তব্য উপেক্ষা করেই কিছুটা কঠোরভাবেই জানালাম, কোনো অবস্থাতেই যেন কণার গায়ে হাত তোলার চেষ্টা বা আঘাত করার চেষ্টা না করা হয়। এ সময় শুনতে পাচ্ছিলাম কণার প্রতি শাশুড়ির নানান কর্কশ ভাষার বাক্যবাণ, চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ। ইতিমধ্যে হ্যালিফ্যাক্স পুলিশের তথ্য অনুসারে সেই শহরের তাদের অঞ্চলের কর্তব্যরত পুলিশ কণাদের বাসায় পৌঁছে গিয়েছিল। আমি কণাকে কর্তব্যরত পুলিশের কাছে সমগ্র ঘটনাটি সঠিক ও সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলতে বলি। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল অসহায় কণা কোনো কথা বলতে পারছিল না। আমি ফোনের এ প্রান্ত থেকে বারবার তাকে সত্য প্রকাশের কথা বলছিলাম। পুলিশ বিভাগের সদস্যরাও তাকে অভয় দিচ্ছিল। কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে কণা অনুরোধ করছিল আমি যেন ফোনে থাকি।

পুলিশ কর্মীরা সব কথা শুনে সার্বিক নিরাপত্তার জন্য কণাকে থানায় নিয়ে যায়। এ সময় কণা তার ব্যক্তিগত ব্যবহার্য কয়েকটি মাত্র পোশাক ও বিয়েতে উপহারপ্রাপ্ত গয়নাগুলো নিয়ে সেই গৃহ থেকে বেরিয়ে আসে। তখন কণার বয়স ছিল কুড়ি বছরের মতো। ওই ঘটনার কয়েক মাস আগে সে বিয়ে করে কানাডায় এসেছিল।

কণার সঙ্গে আমার সব যোগাযোগ আর কথাবার্তা আর ফোনালাপ স্কাইপের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ ছিল। কানাডার অন্য একটি প্রদেশে তার অবস্থান হওয়াতে সেখানকার সঙ্গে হ্যালিফ্যাক্সের সময়ের ব্যবধান ছিল কয়েক ঘণ্টার। তবু সময় করে নিয়মিত তার সঙ্গে কথা বলতাম। কণার এক নিকটাত্মীয় ছিলেন এহসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর একান্ত অনুরোধে কণার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। তিনি অনুরোধ করেছিলেন আমি যেন কণাকে মানসিক সাহচর্য দিই।

আমি সেই অনুরোধ ও মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে কণার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতাম। কণা প্রায়ই আমার কাছে স্বামী ও শাশুড়ির পক্ষ থেকে তার প্রতি অকথ্য নিপীড়ন, অসহনীয় মানসিক অত্যাচার, অসহযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে অভিযোগ করত। আশ্চর্য হলেও সত্য তার স্বামীর পরিবারে সদস্যরা বেশ শিক্ষিত আর সচ্ছল ছিল। তার স্বামী কানাডার নামকরা এক সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। কিন্তু একজন নারীর স্বাভাবিক মানবাধিকার প্রশ্নে তাঁদের বোধের দিকটা ছিল শূন্য।

কণা আমাকে জানিয়েছিল, ইংরেজি ভাষাগত দুর্বলতার উন্নতির প্রয়াসে সরকারিভাবে পরিচালিত একটি ইংরেজি কথ্য ভাষা শিক্ষার ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল। এ ব্যাপারে সে তার শাশুড়ি ও স্বামীর কাছ থেকে অনেক অসহযোগিতার সম্মুখীন হতো। তাকে কোনো দিন হাতখরচের টাকা দেওয়া হতো না। অবশ্য কয়েকটি বাস টিকিট তার জন্য বরাদ্দ রাখা ছিল। কিন্তু তার স্বাভাবিক চলাফেরা সবই ছিল নিয়ন্ত্রিত। মা দিবসের সেই দিন ঘটনা চরম আকার নেয় আর তারা কণাকে মানসিকভাবে অত্যাচার শুরু করে।

কণাকে পুলিশের নিরাপদ হেফাজতে স্থানান্তরের পর প্রথম রাতটি আমার উৎকণ্ঠায় ঘুম আসছিল না। হ্যালিফ্যাক্সে বাসায় আমার শিশু দুটি ইতিমধ্যে তাদের মা দিবসের কার্ড প্রস্তুতি পর্ব শেষ করে আমার চারপাশে সৃষ্টির আনন্দে হাসছিল। কিন্তু আমার উদ্বেগ আর দুই চোখ দিয়ে অবিরত বয়ে চলা অশ্রু দেখে, বাচ্চা দুটি আমাকে তাদের সৃষ্টি মা দিবসের উপহার দুটি দেওয়ার পর আমার বেদনাবিধুর মুখ আর প্রত্যাশিত কোনো আনন্দ–উল্লাস না দেখে বিষণ্নভাবে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।

পরে পুলিশ কণার স্বামীকে ডেকে সাময়িক সমাধান হিসেবে কড়া নির্দেশ জারি করে সে যেন কণাকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকে আর তাঁর বাবা-মার বাড়ি থেকে দূরে অবস্থান করে। কণার স্বামী পুলিশের নির্দেশ মতো আলাদা বাসা নেয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কণা তার স্বামীর ভাড়া করা নতুন বাড়িতে ওঠে। পুলিশ আর নিরাপত্তা বিভাগের সদস্যরা কণার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে। কণা জানিয়েছিল তার স্বামী অফিসের কাজ শেষে হলে সরাসরি তাঁর বাবার বাড়িতে চলে যেতেন। পরে নতুন বাড়িতে এসে সামান্য খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। তেমন কোনো কথা তাদের মধ্যে হতো না। কণার স্বামীর বয়স ছিল চল্লিশের বেশি আর তার বয়স ছিল কুড়ি বছর। তাদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল বিস্তর। আমি একদিন জানতে চেয়েছিলাম তারা কোনো দিন একসঙ্গে বেরিয়েছিল কিনা, সিনেমা অথবা পার্কে। কণা জানিয়েছিল তাদের সে রকম কিছুই হয়নি, কোনো স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল না।

স্বামীর সঙ্গে নতুন আবাসেও কণার সমস্যার সমাধান হলো না মোটেই। ফোনের মাধ্যমে চলত নিয়মিত হুমকি আর অত্যাচার। তার স্বামী এবং দেশে থেকে তার পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির পরিবারের সদস্যরা বারবার চাপ দিচ্ছিল সে যেন পুলিশের কাছে করা সব ফাইল প্রত্যাহার করে ফিরে যায়। কণাকে তার স্বামী বারবার বলতে থাকে, কণার উচিত তাঁদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাওয়া। কণা আমাকে বলেছিল, ‘আপা আমি তো কোনো দোষ করিনি, কেন ক্ষমা চাইব। দায়িত্ব তো তাদের, যারা অন্যায় করেছে। শুধু আপনাদের সবার চেষ্টায় নিজেকে বাঁচিয়েছি মাত্র।’

এদিকে সামাজিক চাপে পড়ে অথবা অন্য কোনো কারণে এহসানের বন্ধুস্থানীয় কণার সেই আত্মীয় ভদ্রলোক একসময় আমাকে জানান, কণা যেন তার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যায়। তাঁর এই অনুরোধ আমাকে বিস্মিত করে। আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম কীভাবে সে ভয়ংকর পরিবারটির ত্রাসের পরিবেশে একত্রে বসবাস শুরু করবে? আমি কণাকে তার আত্মীয়ের অনুরোধের ব্যাপারে বলেছিলাম। সে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। নারী বলেই কি তাকে মানবিক অনুভূতি বিসর্জন নিয়ে ক্রমাগত অসহায় একটি পশুর মতো নিপীড়নের শিকার হতে হবে?

পৃথক আবাসনে থেকেও কণার স্বামীর মানসিক নির্যাতন আর শ্বশুরবাড়ির ও শাশুড়ির অযাচিত চাপ অসহনীয় আকার ধারণ করল। সে ওই গৃহে থাকলেও বেশ সংকোচ বোধ করত। এ অবস্থায় ওই গৃহ থেকে কণা একদিন বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলো। পুলিশ প্রহরায় এবার তার ঠিকানা হলো, রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত নির্যাতিতা নারীর আত্মরক্ষার্থে নির্মিত আবাসিক একটি শেল্টার হোমে। ইতিমধ্যে সমগ্র বিষয়টি কানাডার নারী নির্যাতন (গুরুতর দণ্ডনীয় অপরাধ) আইনের আওতায় চলে এসেছিল। একজন নির্যাতিত অসহায় নারী রূপে কণা রাষ্ট্রীয়ভাবে অতি সামান্য ভাতা পেতে শুরু করে এবং শেল্টার হোম থেকেই নিত্য থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা হতো।

সংশ্লিষ্ট বিভাগ কণার স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। তার শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা অবশ্য পুলিশের কাছে মিথ্যা অভিযোগ তোলে। তারা বিষয়টি ধামাচাপা আর ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার প্রচেষ্টা চালায়। সমাজকল্যাণকর্মী, আইনজীবী, শেল্টার হোমের সদস্য এবং আমার কাছে মানসিক সহযোগিতায় পেয়ে কণা ধীরে ধীরে তার প্রায় নির্বাসিত জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করে। কণার সারল্য ধর্মপরায়ণতা ছিল মুগ্ধ করার মতো। কণার শ্বশুরালয় ছিল দোতলা। ল্যান্ড ফোনের দুটি সেট ওপরে নিচে সংযুক্ত ছিল। কণা কোনো দিন বাংলাদেশে তার মায়ের সঙ্গে কথা বললেই নিচের ফোন থেকে তার শাশুড়ি শুনতেন। আরও জানতে পারি তার স্বামীর আগেও বিয়ে হয়েছিল। তবে সেই স্ত্রী অজানা কারণে দেশে চলে যান। সেই অজানা কারণটি অবশ্য কণার ঘটনায় সহজেই অনুমেয়। কণার সৌভাগ্য যে তার একটি সেলফোন ছিল।

কণা আমাকে বারবার জানাত সে কোনোভাবেই আর নিত্য অত্যাচারের বলয়ে ফিরতে রাজি নয়। আমিও তাকে অভয় দিয়ে জীবনে সংগ্রামের পথে উঠে দাঁড়ানোর নিরিখে নানা পরামর্শ দিতাম। নিগৃহীতা নারী হিসেবে সে সরকার থেকে সামান্য ভাতা পেত। একবার ভেবেছিলাম আমার কাছে নিয়ে আসব। কিন্তু ওই শহরটিতে তাকে ঘিরে যে আইনগত প্রক্রিয়া পরিচালিত হচ্ছিল তার ফলে সেটা হয়ে ওঠেনি। কণা বিয়ের আগে বাংলাদেশ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। প্রথম বর্ষে পড়া অবস্থায় তার বিয়ে হয়। কানাডার সরকার পক্ষ থেকে পরিচালিত সমাজকর্মী ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে তার কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যয়ভার বহন আর ছাত্রী হিসেবে কয়েকটি ছাত্রঋণ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়।

সময় কেটে যাতে লাগল। কণার জীবনের বেদনার অন্ধকার কাটিয়ে আলোর পথে হাসি ফুটতে শুরু করেছিল। সে শেল্টার হোমে কিছুটা একাকিত্বে ভুগত। তবে তাকে আগের চেয়ে বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাবলম্বী মনে হতো। সে একজন মানুষ হিসেবে নিজের জীবনের পরিকল্পনা নিয়ে ভাবা শুরু করল। কিন্তু বিধিবাম এরই মাঝে একদিন সংযুক্ত হলো নতুন এক মাত্রা। দেশ থেকে কণার বাবা মায়ের পক্ষ থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে চাপ প্রয়োগ শুরু হলো। সে জানিয়েছিল তার বাবা-মা দেশে তাকে দেখতে চায়। বারবার এ রকম চাপচক্রে কণার মানসিক অবস্থা আবার কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হলো। জানি না তাঁদের কীভাবে প্ররোচিত করা হয়েছিল। ওই বছর ডিসেম্বরের ক্রিসমাসের ছুটির পর একসময় কণা আমাদের সবার অগোচরেই যোগাযোগ অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশে ফিরে গেল।

আমার আজও কানে বাজে তিন বছর আগের মা দিবস ও তার আর্তনাদের কথা। কণা প্রায়ই বলত, ‘আপা তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। প্রতিমুহূর্তে আমার পাশে ছিলে আমার মায়ের মতো।’ কিন্তু আসলেই কি তাই? সে কি হারিয়ে গেল অনিশ্চিত বিভীষিকার কোনো অনিশ্চয়তার অন্ধকারে? সে একদিন আমাকে বলেছিল দেশে চলে গেলেও সে ফিরে আসবে। তার মাঝে নতুন এক শক্তিমতী রমণীর স্বরূপ ফুটে উঠেছিল।

প্রবাসে অবস্থান করেও এই সরল–সুন্দর মেয়েটি তবে কেন সংকীর্ণ কূটমানসিকতার হীন পাশবিকতার শিকার হলো? আমাদের এক বড় ভাই যিনি টরন্টোতে নানা সামাজিক কর্মে সম্পৃক্ত আছেন তিনি জানিয়েছিলেন অনেক অভিবাসী আর নবাগত বাঙালি নারীর জীবনে প্রায়ই এই রকম ঘটনার ঘটছে। কিন্তু কমিউনিটির বিরাজমান সংকীর্ণতা ও কুসংস্কারের নানা অজুহাতে অনেকেই মুখ খুলছে না। এই দূর পরবাসে এসেও বিভিন্ন পরিবারগুলো কেন এত কুসংস্কার আর সংকীর্ণতায় আবর্তিত থাকেন সেই প্রশ্ন সত্যি লজ্জার উদ্রেক করে। ভালোমতো খবর ও পারস্পরিক আলাপচারিতার মাধ্যমেই বিয়ের বিষয়টিতে অগ্রসর হওয়াই কাম্য। শুধু সামাজিক সাময়িক বাহবা পাওয়ার প্রত্যাশায় দুটি মানুষের মধ্যে কোনো সময়েই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই, এর ফল হিসেবে দুটি জীবনে নেমে আসতে পারে নানা অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি।

সামাজিক ভাঙন আর বিচারহীনতার নীরবতার সংস্কৃতির আবহে আমাদের দেশের সমাজে ও বিশ্বের অনেক সমাজেই এখনো নির্যাতিত অসহায় এক নারীকে মানুষরূপে বিবেচনা করে না। নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি মোটামুটি মেনে নিয়ে নির্যাতিতা হলে তাকে পরিত্যক্ত আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলে দিয়ে গা–ঢাকা দেয়। তথাকথিত রীতি, সংস্কারের কথা ভেবে তার দোহাই দিয়ে আমরা এভাবে একটি অসহায় দুর্বল নারী অথবা শিশুকে নিয়মিত অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিই। কণা অপমানের গ্লানিকর অধ্যায় আর নিয়মিত নির্যাতনের কষ্টের বলয়ে থেকে বেরিয়ে একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের প্রত্যাশা করেছিল।

মা দিবসে মা ও মেয়েদের অধিকার, অবস্থান নির্দিষ্ট ও স্মরণ করার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি দিন। সমাজকর্মী জলিয়া ওয়ার্ড হোই ও মার্কিন সমাজকর্মী আনা মেরি জার্ভিস তাঁদের মায়েদের অনন্য আত্মত্যাগ অবদানের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা নিদর্শনস্বরূপ আর জগতের সব মা আর নারীর নিরলস অবদানের বিশেষভাবে স্মরণ করার প্রেক্ষাপটে এই দিনটির সূচনা হয়েছিল। মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই আন্তর্জাতিকভাবে এই দিনটি মহাসমারোহে উদ্‌যাপিত হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, একটি দিনের মাধ্যমে নয় বরং প্রতিদিন নারী বা একজন মা তাঁর অপরিসীম আত্মত্যাগ আর অবদানের জন্য পূর্ণ সম্মানের দাবিদার। প্রবাসে নারীর সামাজিক অবস্থান তুলনামূলকভাবে সন্তোষজনক হলেও, দেশে বিভিন্ন সংকীর্ণ, ভ্রান্ত সংস্কাররীতি পরিচালিত হয়ে আজ আমরা নারীর উন্নয়ের মূল অর্থ থেকে একদম পিছিয়ে আছি।

মানুষ বিবেচিত হন মহান স্রষ্টার সৃষ্টির সেরা জীবরূপে। তবে একজন নারীর প্রতি কেনই বা সমাজের একদল মানুষ মানবিক দৃষ্টিকোণ, সম্মান ও অধিকার দানে ব্যর্থ হচ্ছেন? দেশে প্রবাসে ভোগ্যপণ্য রূপে নয় বরং সর্বত্রই নারীকে অনুভূতি ও মর্যাদাসম্পন্ন মানবিক সৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করে সম্মানজনক একটি সুস্থ ধারার স্বয়ংসম্পূর্ণ এক মানবিক সমাজ গঠনে আমরা প্রকৃত অর্থে কি সফল হয়েছি?