আমার মায়ের উপাখ্যান
পাবনা শহরের অনতিদূরে ছোট্ট একটি শান্ত জনবসতি। নাম সাধু পাড়া। ইছামতী নদীর কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা শুভ্র সাদা কাশবনের এক সহচরী এই সাধু পাড়া।
নদীর দুপাশ দিয়ে যত দূর চোখ যায় দেখা মেলে দিগন্তজোড়া শুধুই সবুজ শস্যখেত। ইছামতীর টলটলে জলরাশির স্রোতে নদীর বুকে ভেসে চলে বড় বড় পালতোলা মালবাহী নৌকা। রংবেরঙের পালের হাতছানিতে সাড়া দেয় উড়ন্ত শঙ্খচিল।
অলস দুপুরে নদীপারে ছুটে বেড়ায় কিশোর–কিশোরীর দল।
নদী মাঠ খেত আর শঙ্খচিলের ছন্দে সাড়া দেয় সেই দলেরই এক কিশোরী। গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে সাধু পাড়ার একটি শান্ত মেয়ে। নাম খুকুরানি। আমার মা।
ছোট্ট খুকু। নানাজানের আদরে কবে কখন যে রানি বনে গেলেন তা তিনি নিজেও জানতে পারেননি। নাম না জানা কোনো এক রাজ্যের রানি। রাজকুমারী না হয়েও সরাসরি একবারেই রানি। রাজ্যহীন রাজমুকুটবিহীন রানি। রানির মতো যথার্থই ছিলেন। চলন–বলন আর কথোপকথনে।
ফরসা ফুটফুটে রানি। নানাজান আর নানিমার গায়ের রঙের সংমিশ্রণ পেয়েছিলেন আমার মা।
সেই হাসিখুশি রানির জীবনে একদিন এল এক বিস্ময়।
একদিন হঠাৎ করে কুষ্টিয়ানিবাসী কোত্থেকে এক কৃষ্ণকাল রাজা এসে উপস্থিত হলেন। সে রাজারও আবার রাজ দরবার নেই। নেই প্রজাকুল। তিনি আমার মাকে দেখতে এসেছেন। বড় দুলাভাইয়ের সঙ্গে। বিয়ে করবেন বলে। ঘটকালিটা সেই কালো রাজার বড় বোন করছিলেন (আমার বড় ফুফু), যিনি সাধু পাড়ার কাছেই আটুয়া নামের গ্রামে বাস করতেন।
অবাক কাণ্ড। নানাজান রাজি হয়ে গেলেন। দেখতে আসা পক্ষকে কথাও দিয়ে দিলেন।
আশ্চর্য! নানাজান বললেন। না, ছেলে তো কালো না। ছেলের গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণ। নানাজান পছন্দ করেছিলেন আমার বাবার লম্বা–চওড়া গড়ন দেখে। আর সরকারি চাকরি করেন বলে।
এভাবেই আমার মা গাঁটছড়া বাঁধলেন আমার বাবার সঙ্গে। চললেন সংসার করতে। সরকারি চাকরির চক্করে পরে বাবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে থাকলেন। নানা জেলা শহরে। এরই মধ্যে একে একে আমাদের আগমন ঘটতে থাকল। একজন–দুজন করে আমরা অনেক কয়জন।
বড় হয়ে আমরা অনেক কজন ভাই আর বোন মিলে মায়ের জীবনকে সুখ আর শান্তিতে ভরে দিয়েছিলাম। মা চেয়েছিলেন আমাদের মানুষের মতো মানুষ করতে। তা পেরেছিলেন বৈকি। অনেক চেষ্টা ও মেহনত করার ফলে।
আমার মা ছিলেন অনেক প্রতিভাদীপ্ত। ছিলেন একজন আদর্শ নারী। পৃথিবীর সব মায়েরাই সন্তান গড়ার কারিগর হন। আমার মা–ও আমাদের সব ভাইবোনদের তাঁরই আদর্শে গড়ে তুলেছিলেন। মায়ের কাছ থেকে আমরা শুধু স্নেহ আর ভালোবাসাই পেয়েছি। শাসন পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। সেই স্নেহ ভালোবাসা ও শাসনের যথাযথ সমন্বয়ের কারণে আমরা এত দূর পর্যন্ত আসতে পেরেছি।
মায়ের সঙ্গে আমাদের ভাইবোনদের ছিল অপূর্ব এক সখ্য। রাগী বাবার সঙ্গে আমাদের বেশি কথাবার্তা হতো না। তাই যত আবদার ছিল মায়ের কাছে।
কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে মা আমাদের আত্মবিশ্বাসী হতে বলতেন। ধৈর্য ধরতে বলতেন।
আমার ইমিডিয়েট অগ্রজ ভাই দেড় বছর বয়সে মেনিনজাইটিস রোগে মারা গিয়েছিল। সেই মৃত্যুর শোক সামাল দিয়েছিলাম আমি আমার মায়ের কোলে এসে।
তাই বলে কি না তা জানি না, তবে আমি মায়ের এক দুষ্টু খ্যাপা ছেলে ছিলাম। খুব ছোটবেলা থেকেই। মায়ের কাছে আমার আবদার ছিল অন্য ভাইবোনদের থেকে এক ডিগ্রি বেশি।
আমি ছিলাম দুরন্ত ডানপিটে রগচটা। আমার জন্য মাকে প্রায় বাবার কথা শুনতে হতো।
আমি একটু বড় হলে মা আমার মতামতকে অনেক গুরুত্ব দিতেন। আমি চাকরি পেয়ে ঢাকায় চলে এলে মা প্রায় সংসারের অনেক সিদ্ধান্তের জন্য আমার সঙ্গে ফোনে আলাপ করতেন।
ছোটবেলাকার সমস্যাই শুধু নয় বিয়ের পরও আমি মায়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত এমনকি চাকরিসংক্রান্ত সমস্যাও শেয়ার করতাম। সবকিছু জানাতাম মাকে।
আমার আজকের বাহ্যিক আচরণ নীতিবোধ সামাজিকতা মায়ের কাছ থেকেই শেখা। কীভাবে সবাইকে আপন করে নিতে হয়, মিলেমিশে থাকতে হয়, তা মাকে করতে দেখেই শিখেছি।
কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠানে কার সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয়, বড়দের সঙ্গে কেমন শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার করতে হয়, তা–ও আমার মায়ের কাছ থেকেই নেওয়া।
মা সেই গুণাগুণগুলো রপ্ত করেছিলেন আমার নানাজানের কাছ থেকে।
আমার নানাজান একজন উদার ও ধর্মভীরু মানুষ ছিলেন। ছিলেন খুব পরিপাটি আর ছিমছাম গোছের। সেই আমলে পাবনা জজকোর্টের একজন যশস্বী আইনজীবী ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন পাবনা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যানও। ছিলেন একাধারে সুলেখক ও ইসলামি চিন্তাবিদ।
আমার মা ছিলেন নানাজানের বড় মেয়ে। মাকে দেখেছি নানাজানের সঙ্গে খুবই সমীহ করে কথা বলতে। নিজের ছোট ভাইবোনদেরও মা অনেক অনেক আদর করতেন। তাঁদের সবার কাছেই বড় বুবু অতি আপন একজন মানুষ ছিলেন।
আমার বড় মামা যিনি পুলিশের দারোগার চাকরি করতেন। দারোগা মামা আমাদের বাড়ি এলে আমরা সব ভাইবোনেরা বড্ড ভয় পেতাম, কারণ গমগম করে কথা বলতেন। বড় মামা-মামি অনেক দিন পর হলেও আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন।
বড় মামা আমার মাকে খুকুরানি খুকুরানি বলে ডাকনামে ডাকতেন। তা শুনে আমরা অবাক হতাম।
আমার মা ছিলেন খুবই সাদামাটা। ছিলেন একজন অতি সাধারণ গৃহিণী। মাকে গরিব দুস্থদের খুব সাহায্য করতে দেখতাম। আমরা অনেক সময় রাগ করে বলতাম, ফকির–মিসকিনরা কি তোমার বান্ধবী?
মায়ের দেখেই কি না জানি না তবে আমিও এখন খুব চেষ্টা করি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। সাধ্যমতো চেষ্টা করি গরিব–দুঃখীদের সাহায্য দিতে। আজ বুঝতে পারি যে মা ছিলেন একজন পরোপকারী, সহানুভূতিশীল ও সহমর্মিতায় ভরা একজন আদর্শ মানুষ।
পাড়াপড়শিরাও মায়ের গুণগান করতেন। আমার মা আসলেই ছিলেন সবার প্রিয় একটা মানুষ। এমনকি আমার মায়ের ছয়–ছয়টা পুত্রবধূ, তাঁরাও মায়ের ফ্যান ছিল। বউ–শাশুড়ির মধ্যেও কোনো দিন কোনো ব্যাপার বা কথা নিয়ে কিছু হয়েছে বলে আমরা দেখিনি।
দেশে থাকা অবস্থায় সার্বক্ষণিক মায়ের খোঁজখবর রাখতাম।
আর এ রকমই একজন মানুষকে ফেলে আমি একদিন পরিবার নিয়ে এই পরবাসে চলে এলাম।
আমি যদিও বড় সন্তান ছিলাম না, তবুও মা কেন যেন আমার ওপর অনেক ভরসা করতেন। আমার বিদেশে আসাতে মা মনে হয় একটু কষ্টই পেয়েছিলেন। তবে বুঝতে দেননি। আমিও বুঝিনি।
আমি কানাডায় আসার কয়েক মাস পরেই আমাকে চমকে দিতে মা একদিন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে চেপে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে টরন্টোতে এসে হাজির হলেন। আমার ছোট ভাই ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে। আমাকেই দেখতে। ফজর নামাজের পরে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের লিভিং রুমে বসে মা কোরআন তিলাওয়াত করতেন। বলতেন, কানাডা খুব সুন্দর একটা দেশ।
মা যেন কেমন অসুস্থ আর কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করতে পারতেন না। খেতে রুচি হতো না। আমি বললাম, মা, তুমি ঠিকমতো খাচ্ছ না কেন?
বলতেন, আমার খেতে ইচ্ছা করে না রে বাবা।
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতাম। আমার দুই বছরের মেয়ে তা দেখে আমার কাছে ছুটে আসত। আমার পিঠের কাছে গায়ে গা লাগিয়ে সে–ও শুয়ে পড়ত।
এক মাস থেকে মা দেশে ফিরে গেলেন।
বিদায়ের সেই দিনটা খুবই মনে পড়ে। প্রাণের ভেতর খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। কান্নায় বুকটা ফেটে যাচ্ছিল।
এয়ারপোর্ট পর্যন্তও যেতে পারলাম না। অ্যাপার্টমেন্টের নিচ থেকে ট্যাক্সিক্যাবে মাকে বিদায় দিলাম। সেটাই আমার সঙ্গে মায়ের শেষ দেখা।
আমার ছেলেমেয়ে ও তাদের মাকে ক্যাব থেকে হাত নাড়িয়ে আমার মা বিদায় সম্ভাষণ জানালেন।
ছেলেটা আমার কেঁদে কেঁদে জিজ্ঞাসা করে উঠল, দাদি চলে যাচ্ছে কেন?
দূরপাল্লার ফ্লাইটে ট্রাভেল করে দেশে পৌঁছেই মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তার টেস্ট করে এক দুরারোগ্য ব্যাধি ডায়াগনোসিস করলেন।
ভাইবোনেরা সবাই মিলে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও মাকে আর ভালো করতে পারলেন না।
অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই আমার সেই ‘খুকুরানি মা’ তাঁর সুখের রাজ্যের সব ধনদৌলত ফেলে কোনো এক অচিন গহিন অন্ধকারের রাজ্যে চিরতরে চলে গেলেন।
এখনো প্রতিদিন প্রতিনিয়ত একটা প্রশ্ন মনের ভেতর প্রতিক্ষণই জেগে ওঠে।
এভাবে চলে যাবেন বলেই কি আমাকে দেখতে মা আমার সুদূর কানাডায় এসেছিলেন?
...
রানা টাইগেরিনা, ই–মেইল: <[email protected]>