নারী তুমি মহীয়ান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ক্যাথরিন (ছদ্মনাম) একজন আইটি ইঞ্জিনিয়ার। চাকরির প্রজেক্ট নিয়ে সিডনি এসেছে। সঙ্গে এক বছরের বাচ্চা। ক্যাথরিনের স্বামী রিকের (ছদ্মনাম) দেশে গ্রোসারি শপ ছিল। বিক্রি করে দিয়ে ওর সঙ্গে সিডনি চলে এসেছে। বেশি পড়াশোনা নেই, তাই এখানে কিছু করতে পারছে না। ঘরে বাচ্চা দেখেশুনে সময় কাটছে।

সিডনিতে একজনের আয়ে সংসার চালানো অনেক কষ্টের। আর কোম্পানি স্পনসর করেছে ঠিকই কিন্তু সব তো দিচ্ছে না। তাই অনেক কষ্ট হয় ক্যাথরিনের একা সংসার চালাতে। এক বন্ধুর মাধ্যমে স্বামী রিককে কাজ জুটিয়ে দিল একটা ফিলিপাইন গ্রোসারিতে। কিন্তু বাচ্চাকে কী করবে। একটা ফ্যামিলি ডে কেয়ারে দিল ঘণ্টাপ্রতি পাঁচ ডলার হিসাবে বাচ্চাকে দেখাশোনা করার জন্য।

এদিকে রিক তাঁর কাজের ওখানে আরেকটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে, সেটা ক্যাথরিন খবর পেল তখন, যখন দেখল একটা টাকাও সে সংসারে দিচ্ছে না। সব টাকা রিক ওই মেয়ের পেছনে ওড়াচ্ছিল। এর মধ্যে ক্যাথরিন আবার কনসিভ করেছে এবং চেষ্টা করছে পারমানেন্ট রেসিডেন্সি নিতে এ দেশের। ইংলিশ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নয়টা–পাঁচটা অফিস। বাসায় এসে বাচ্চা সামলিয়ে রান্না আবার ইংলিশের প্রস্তুতি, সব মিলিয়ে অনেক চাপের ওপর দিয়ে যাচ্ছে।

রিক ক্যাথরিনকে বলছে অ্যাবরশন করিয়ে নিতে, যেহেতু এখানে অনেক খরচ। ক্যাথরিন একা একাই সব করছিল। কিন্তু যখন রিক এই কথা বলল, ক্যাথরিন আর সহ্য করতে পারল না। রিককে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। রিক সেই সুযোগ খুঁজছিল। সে চলে গেল সেই মেয়ের সঙ্গে। ক্যাথরিন একা কী করবে বুঝতে পারছিল না। অফিসের কলিগের সঙ্গে কথা বলে এক রুমের বাসায় উঠল এবং সে আইইএলটিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে লাগল। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, একাই দুটো বাচ্চা মানুষ করবে। কারণ, সে যে মা।

কাহিনি–২
মোনা (ছদ্মনাম) বাংলাদেশের একটা নামকরা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স পাস করে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করত। চাকরিসূত্রে ওর কলিগের সঙ্গে পরিচয় ও পরিণয়। বাসা থেকেও আপত্তি ছিল না। সুমনের ফ্যামিলি ভালো, শিক্ষিত ও স্মার্ট। সর্বোপরি দুজনে ভালো চাকরি করে। মোনার বাবা ধুমধাম করে মেয়ের পছন্দের ছেলের সঙ্গে মোনার বিয়ে দিলেন। অনেক খরচ করলেন বিয়েতে। দুজনের দারুণ সুখের সংসার। এভাবে প্রায় দুই বছর চলে গেল। মোনা যা আয় করত, সব স্বামীর হাতে তুলে দিত সংসার খরচের জন্য। নিজের জন্য কিছুই রাখত না। তাঁর স্বামী টাকা কী করে, তা জানার চেষ্টাও করত না। সে বিশ্বাস করত তার প্রিয় মানুষটিকে।

মোনা যখন মা হতে চলল, তখন ওর শাশুড়ি ও সুমন ওকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলল। মোনা চাকরি ছাড়তে রাজি হলো না। সুমনের সেটা পছন্দ হলো না। দুজনের মধ্যে একটু দূরত্ব তৈরি হলো। শেষ পর্যন্ত সংসার ও নিজের সন্তানের কথা চিন্তা করে মোনা চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিল। যখন ডেলিভারির সময় এল, ডাক্তার জানালেন, সিজার করতে হতে পারে। তখন সুমন ওকে বাবার কাছে থেকে টাকা এনে দিতে বলল। মোনা তো অবাক। শিক্ষিত ও স্মার্ট সুমনের মুখে সে এ কী শুনছে।

মোনা বলল, আমরা দুজনে চাকরি করতাম। আমাদের তো সিজার করার জন্য টাকার অভাব হওয়ার কথা নয়। তুমি না দাও আমি যে এত দিন চাকরি করেছি, সেগুলো কোথায়? সেখান থেকে দাও। সুমন বলল, সব টাকা সংসারের পেছনে খরচ হয়েছে। মোনা বিশ্বাস করল না এবং করার কথাও না। ওদের দুজনের সংসারে এত খরচ হওয়ার কথাও না। নিজেদের ফ্ল্যাটে আছে। শ্বশুর–শাশুড়ি গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মাঝেমধ্যে এসে ওদের সঙ্গে থাকেন। তা ছাড়া শ্বশুরের সহায়–সম্পত্তি আছে গ্রামে। কোনো খরচও দিতে হয় না তাঁদের। তাহলে টাকা কোথায় গেল।

সুমনও কিছুতেই বলতে রাজি না। দুজনের প্রচুর ঝগড়া হলো। মোনার বাবা যে দিতে পারবেন না, তা নয়। কিন্তু মোনার এটা বিশ্বাস করতে হচ্ছে কষ্ট হচ্ছিল, সুমন কীভাবে এত বদলে গেল। যাকে বিশ্বাস করে সে এত দিন সংসার করল, আজ তাকেই এত অচেনা লাগছে। কথা বলল শাশুড়ি আর শ্বশুরের সঙ্গে। আশ্চর্য, তাঁরাও সুমনের পক্ষ নিয়ে কথা বললেন। সামান্য কটা টাকার জন্য সুমন মোনার গায়ে হাত তুলল। আর থাকতে পারল না মোনা, চলে এল বাবার বাড়ি। আর সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, এখন থেকে একাই লড়বে। আবার চাকরি খুঁজবে, একাই বাচ্চাটাকে মানুষ করবে। কারণ, সে যে মা।

কাহিনি-৩
নেহা (ছদ্মনাম) স্বামীর সঙ্গে নেপাল থেকে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছে বিয়ের চার মাস পর। পারিবারিক পরিচয়ে বিয়ে। তাই বিয়ের আগে তেমন কথাই হয়নি বরের সঙ্গে। কুনাল এখানে ভালো ব্যাংকে চাকরি করে। সে পারমানেন্ট রেসিডেন্ট এখানকার। কুনাল আগেই সব কাগজপত্র রেডি করে গিয়েছিল। নেহাকে আনতে ওর বেশি সময় লাগেনি। এখানে আসার পর নেহার খুব সময় লাগছিল মানিয়ে নিতে। নতুন পরিবেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, আবহাওয়া। খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু বলতে পারছিল না কুনালকে। কারণ, কুনালের সঙ্গেও সে সহজ নয়।

নেহা শিক্ষিত, কিন্তু লাজুক স্বভাবের জন্য কারও সঙ্গে মিশতে অনেক সময় লাগে। আর ইংরেজিটা ওভাবে চর্চা করা হয় না। তাই যেচে কথা বলতে লজ্জা লাগে। যেখানে থাকে প্রতিবেশী সব সাদা। রাত সাতটার পর শব্দ করা যাবে না। সাতটার আগে ডিনার করতে হবে। সবকিছু কেমন যেন রোবটিক। কুনালের সঙ্গেও তেমন কোথাও বের হয় না। কুনাল সকালে কাজে যায় আর রাতে ফেরে। সারা দিন কথা বলার কেউ নেই। নেহার একা একা দম বন্ধ হয়ে যায়। বাইরে যাওয়ার সাহস করে না।

কুনাল নেহাকে কোনো কোর্সে ভর্তি করে দিতে চাইল, কিন্তু নেহা ভয় পায়। সে রাজি না। এর মধ্যে নেহা বুঝল, সে মা হতে চলেছে। কুনাল বাবা হবে জানতে পেরে খুবই খুশি। ভাবছে, যা–ই হোক, এখন নেহা ব্যস্ত থাকবে। কিন্তু হলো উলটা। নেহা গভীর ডিপ্রেশনে ভুগছিল। কুনাল নেপালি এক ডাক্তারের কাছে নেহাকে দেখাত। তিনি বললেন, নেহাকে সময় দিতে হবে, ওকে হাসিখুশি রাখিতে হবে, পারলে দেশ থেকে কাউকে আনিয়ে নিতে। কিন্তু সে অবস্থা ছিল না তাদের। এই সময় দেশ থেকে কেউ আসারও নেই। আর ওরা থাকে এক বেডরুমের স্টুডিও ফ্ল্যাট। সেখানে আরেকজন এসে থাকতে পারবে না। এ ছাড়া এই মুহূর্তে বাসা বদল করাও সম্ভব না।

কুনালও খুব কম কথা বলে। তাই ওর নিজের তেমন বন্ধুবান্ধব নেই। সে থাকে তার কাজ নিয়ে আর বাসায় এসে ক্রিকেট খেলা দেখা ছাড়া তেমন কিছু করেও না। কোথাও যায় না। যে সময় নেহার কুনালকে খুব দরকার, সে সময় ও কাছে পায়নি। ওর অভিমান, রাগ সব কুনালের ওপর। চিন্তা করে, সব ছেড়ে দেশে চলে যাবে। কিন্তু অনাগত বাচ্চার কথা চিন্তা করে সব সহ্য করে নেয়।

এদিকে দিন দিন নেহার মনের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। সে একা একা কথা বলে। নেহা নিজেও বুঝতে পারছিল যে সে আর স্বাভাবিক নেই। কিন্তু যখন সে নিজের বাচ্চার কথা চিন্তা করে, আবার সামলে নেয়। শক্ত হওয়ার চেষ্টা করে ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে। একা একা পাশের পার্কে হাঁটতে যায়। একটু একটু করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। এর মধ্যে ওর মেয়ের জন্ম হলো। এরপর আবার সেই মন খারাপ, মেজাজ খিটখিটে থাকা, বাচ্চা কান্না করলে মনে হতো আছাড় মেরে ফেলে দিতে। কুনালের সঙ্গেও চিল্লাচিল্লি করত আর রাতে ভালো ঘুম হতো না। নিজেকে ঠিক রাখতে পারত না।

এখন দু-তিনজন নেপালি বন্ধু হয়েছে ওর। পার্কে হাঁটতে গিয়ে পরিচয়। মাঝেমধ্যে বাসায় আসে। ওদের দেখলে ওর কথা বলতে ভালো লাগে। কুনাল নিজে কোনো সাহায্য করেও না তেমন ঘরের কাজে। শুধু বাজার করে দিয়েই দায়িত্ব শেষ। কুনাল খুব বিরক্ত নেহার এসব আচরণে। সে মনে মনে চিন্তা করছে, নেহাতকে দেশে পাঠিয়ে দেবে। এখানে নেহা থাকতে পারবে না। নেহার গায়ে লাগল কথাটা। সে নিজের কথা ভাবছে না। ভাবছে এই বাচ্চাটা কেন আমার জন্য নেপালে গিয়ে কষ্ট পাবে। সে এখানে মানুষ হবে, আবার নেহা ডাক্তারের কাছে যায়, কথা বলে। সে ভালো সেলাই জানত। তা–ই করত পরিচিত দু-একজনের মাধ্যমে। আস্তে আস্তে ওদের নেপালি কমিউনিটিতে ওর সুনাম ছড়াতে লাগল ওর ভালো সেলাইয়ের জন্য। নেহা নিজেকে বদলাতে শুরু করল শুধু তার নিজের মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। সে প্রতিজ্ঞা করল, তাকে বদলাতেই হবে। কারণ সে যে মা।

ওপরের তিনটি ঘটনাই সত্য এবং আমার পরিচিত মায়েদের সঙ্গেই ঘটেছে। আমরা মা বলেই সব করে যাচ্ছি। মায়েদের কোনো দেশ, জাতি, ভাষা লাগে না। মা তো মা-ই; সে যে দেশেই থাকুক না কেন আর যে সংস্কৃতি আর ভাষাতে কথা বলুক না কেন। মায়েদের জন্য কোনো দিবস লাগে না। বছরের সব দিনই মা দিবস। পৃথিবীর সব মা ভালো থাকুক, সেই কামনা করি।