আমার মেয়ে - তিন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রথম প্রথম বেশ হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। স্কুলে নতুন চাকরি। পড়ানোর অভিজ্ঞতা আমার আগে ছিল না। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম, তিতলিকে দেখাশোনা করে করে বাচ্চাদের ব্যাপারে আমার ধৈর্য অনেক বেড়েছে। আর ওদের মন-মানসিকতাও বুঝতে পারছি সহজে। চাকরির পরও তো একদণ্ড বসা নেই। তিতলিকে সঙ্গে নিয়েই কাজ থেকে বাড়ি ফিরতাম। আমরা বাড়িতে ফিরতে ফিরতেই জাহিদ আশাকেও স্কুল থেকে তুলে নামিয়ে দিয়ে যেত। দুপুরের খাওয়াটা আগের রাতেই রান্না করে রাখতাম। কারণ বাড়ি ফেরার পর থেকে এই দুই বাচ্চাকে নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকতাম।

তিতলি যেদিন শান্ত থাকত, তবুও রক্ষা। কিন্তু কোনো কোনো দিন ভীষণ জেদ করত। গোসল করবে না, খাবে না। কখনো কখনো চিৎকার করে ঘুমন্ত আশাকে জাগিয়ে দিত। ওকে হয়তো অনেক কষ্ট করে আমি মাত্র ঘুম পাড়িয়েছি। কখনো বা আমাকে পুরোটা সময় ওকেই দিতে হতো, আশাকে বুয়া বা শাশুড়ি মায়ের কাছে রেখে। সমস্যা হয়ে যেত ডাক্তারর কাছে যাওয়া, দোকানপাটে যাওয়া, এসব নিয়ে। আমি আর জাহিদ দুজনে একসঙ্গে তো এসব কাজে যেতেই পারতাম না। অথচ এক বাচ্চার অসুখ হলে বা দোকানে যেতে হলে দুজনকেই ছুটি নিতে হতো। একজনের কাছে এক বাচ্চা, আরেকজন অন্য বাচ্চা নিয়ে কাজ সারতে হতো। যদিও বাইরে নিয়ে গেলে মানুষজন তিতলির কাজে বিরক্ত হতো। কিন্তু বাইরে গেলে ও খুশি হতো মনে হতো। তাই মাঝেমধ্যে সময় পেলে ওকে নিয়ে এমনি গাড়িতে করে ঘুরাতাম। ওই সময়টাই আমার একমাত্র বিশ্রাম। গাড়িতে বসে ও শান্তভাবে বাইরে দেখত। আশাও আমার কোলে কিছুক্ষণ থেকে ঘুমিয়ে পড়ত। শুধু জ্যামে অনেকক্ষণ আটকে থাকলে অস্থির করত।

প্রথম ধাক্কাটা সামলে ওঠার পর এই ব্যস্ত জীবনে আমরা সবাই মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। রুটিন জীবন বরং তিতলির জন্য ভালো মনে হলো। আগে মাঝেমধ্যে রাতে ঘুমাতে চাইত না। এখন ক্লান্ত থাকে, সময়মতো ঘুমিয়ে যায়। প্রতিদিন একই কাজের একই সময়ে পুনরাবৃত্তি করতে করতে দৈনন্দিন কিছু কাজ ও এখন নিজে করতে পারে। সকালের দাঁত ব্রাশ করা বা জামা, জুতা দিয়ে রাখলে পরা এসব। স্কুলের শিক্ষকেরা ওর ছবি আঁকার প্রতিভাকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। সঙ্গে একটু একটু করে পড়তে, সংখ্যা গণনা, এসবও শেখাচ্ছেন। আমাদের বুকে একটু একটু করে আশা জাগে।

তবে সামাজিক জীবন থেকে আমরা তখনো অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তিতলি কিন্তু অন্য বাচ্চাদের আঘাত করে এমন নয়। কিন্তু তার পরও ওর সঙ্গে কেউ খেলতে বা মিশতে চায় না। বাচ্চাদের চেয়ে তাদের বাবা-মায়ের ভয় বেশি। আর ও চিৎকার করলে তো কথাই নেই। ভয় পায় বা বিরক্ত হয়। অনেকে অনেক সময় মুখের ওপরে অনেক কিছু বলে দেয়। সেগুলো সহ্য করা কঠিন হয়ে যায়। বাইরে খুব একটা যাওয়া হয় না বলে কি না, জানি না, ওদের দুই বোনের ভীষণ ভাব। ভাবটা বলা যায় খানিকটা একতরফা। আশা তিতলির জন্য পাগল। আমার বড় মেয়েটাকে আল্লাহ অসহায় করে পাঠিয়েছেন বলেই হয়তো ছোটটা বয়সের তুলনায় অনেক বুদ্ধি রাখে। পাঁচ-ছয় বছর বয়স হতে হতেই সে শিখে গেছে বোনকে অনেক খেয়াল রাখতে হয়। অনেক কিছুতে সাহায্য করতে হয়। কোন কোন খাবার তিতলি খেতে চায় না, সেটাও সে জানে। তিতলিকে যে বেশি সময় দিতে হয়, সেটা নিয়ে মন খারাপ করে না, বায়নাও কম। তবুও বাচ্চা মানুষ। ওরও পড়ালেখা আছে, খেলতে মন চায়। তিতলি ওর খুব ভালো খেলার সাথি। কখনো ওকে আশা ঘোড়া বানায়। কখনো প্রিন্সেস। ছুটির দিনের দুপুরবেলা দুই মেয়েকে পাশে নিয়ে আমি ওদেরকে গল্প পড়ে শোনাই, আশা হাজারটা প্রশ্ন করে, আর তিতলি কখনো একদম অপ্রাসঙ্গিক কিছু একটা বলে বসে।

শাশুড়ি মা আজকাল মাঝেমধ্যে নতুন চিন্তা মাথায় ঢোকান। মেয়ে বড় হলে কী হবে। ওর শরীর নিয়ে কিছু ওকে বোঝানো তো সম্ভব না। আমি এগুলো বেশি একটা ভাবতে চাই না। এখনো তো মাত্র দশ পেরিয়ে এগারো। আমি না ভাবলে কী হবে, পৃথিবী আমাকে ঠিকই ভাবাবে। সেদিন ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ভাশুরের ছেলে এসেছে বাড়িতে। দুপুরবেলা, আমাদের তখনো খাওয়া হয়নি। তাই খেয়ে যেতে বললাম। ওকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে আমি গেছি রান্না ঘরে। হঠাৎ তিতলির ঘর থেকে চিৎকার। রান্না ঘর থেকে ওর রুমটা বেশ দূরে। এসে কিছুই বুঝলাম না, খালি ওকে গোঙাতে দেখলাম। ভীষণ রেগে লাল হয়ে আছে। অনেক কষ্টে থামিয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই জয়, আমার ভাশুরের ছেলে উঠে দাঁড়াল, ‘আমার যেতে হবে চাচি এক বন্ধুর বাসায়।’ আমাকে তেমন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ও এক রকম পালিয়ে চলে গেল, ওর মুখে বেশ কয়েকটা আঁচড়ের দাগ। আমার হাত পা হিম হয়ে গেল। সামনের দিনের কথা ভেবে আমি চোখে-মুখে অন্ধকার দেখি।

দেখতে দেখতে মেয়েটা বেশ বড়সড় হয়ে গেছে। আজকাল রাস্তাঘাটে ছেলেরা কেমন করে যেন তাকায়। ওকে ফ্রক ছাড়িয়েছি অনেক আগেই, জামাকাপড় ঠিকমতো সামলাতে পারে না বলে। কিন্তু ওড়নার ঝামেলা ও তো পারবে না। মাথায় আবার নতুন চিন্তা। ঢোলাঢালা সালওয়ার কামিজ ধরনের কাপড় খুঁজে বের করি হন্যে হয়ে। সেগুলো পরে ওকে আরও অদ্ভুত লাগে। আর আমার মন খারাপ হয়। সারা জীবনে কখনো লম্বা চুলও রাখতে দিইনি।

আর তারপর ঠিকই চলে এল সেই দিন, যার ভয়ে আমি কাঁটা হয়ে ছিলাম। স্কুল থেকে ফোন এল, ফোনটা ধরতে ধরতেই আমার মন বলছিল একটা কোনো খারাপ খবর। খারাপই বা বলি কী করে, এটাই তো প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। তিতলির পিরিয়ড শুরু হয়েছে। সেদিন নিজেকে আমার এত অসহায় লাগছিল। বাসায় নিয়ে এসে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে দিলাম। ও খুব কাঁদছিল, মনে হয় ব্যথাও করছিল। নিজের কথা মনে হলো। আমিও জানতাম না। তাই অনেক ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন বোঝানো হলো, সবারই এটা হয়, কদিন পরে ঠিক হবে, তখন একটু একটু করে ভয় কেটেছে। এই মেয়েকে আমি কীভাবে কী বোঝাব? আর না বোঝালে তো ওর ভয় কাটবে না। জন্ম থেকে যেগুলো হয়, সেগুলোতে ও অভ্যস্ত, কিন্তু এটা তো সে রকম না।

আমার এই আশঙ্কাটা সত্য হলো। ওকে এটা ঠিকমতো বোঝানো গেল না। আর ওর সঙ্গে আমাকেও ছুটি নিয়ে বসে থাকতে হলো প্রথম কদিন ওকে, ওর কাপড়চোপর সব ঠিক রাখতে, সামলে রাখতে। নতুন চিন্তা মাথায় যোগ হলো, এভাবে আমি চাকরি করব কীভাবে?

কিন্তু আমার এই মোটামুটি বন্দী জীবনে চাকরিটাই একমাত্র খোলা জানালা। সে জানালা আমি বন্ধ হতে দেব না কিছুতেই। বেশ কয়েক বছর ধরে চাকরি করছি। সিনিয়র বলে বেতনও বেড়েছে। পয়সার মায়া ত্যাগ করে আবারও লোক খোঁজা শুরু করলাম। মাসের ওই কয়দিন বাড়িতে ওর সঙ্গে থেকে ওর দেখাশোনা করবে এমন লোক। প্রায় অসম্ভব কাজ মনে হচ্ছিল। ও এখন বড় হয়েছে, কিছুতেই বাইরের কারও সঙ্গে সহজ হতে পারছিল না, তাও এমন একটি ব্যাপারে। শেষে উপায় না দেখে ওকে একটা মেয়ের সঙ্গে স্কুলে নিয়ে আমার টিচার্স রুমে বসিয়ে রাখতাম। মনে হচ্ছিল আমার যুদ্ধ আর শেষ হবে না। বছরখানেক লেগেছে ওর অভ্যস্ত হতে।

সময়ের গতিতে শরীরে সব পরিবর্তনই আসছে। এগুলোকে তো আর আটকে রাখা যাবে না। ওকে স্কুলে নামাতে বা তুলতে গেলে মাঝে মাঝে দেখি, ওদের ক্লাসের ছেলেগুলো বড় হয়ে গিয়েছে, গোফের রেখা। মাঝেমধ্যেই দেখা যায় সবার সামনে মাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে অনবরত, আর বেচারি মা বিব্রত, থামাতে চাইছে। এই মায়ের কষ্ট কে বুঝবে?

এর মধ্যে একটা বিরাট ঘটনা ঘটেছে। ওর আঁকা একটা ছবি জাতীয় পর্যায়ে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে। সেই ছবির পুরস্কার আনতে গিয়ে আমি খুশিতে হাপুস নয়নে কেঁদেছি। আমাকে কাঁদতে দেখে ও আমার চোখের পানি মুছে দিয়েছে, আর আমার এই কাণ্ড দেখে আশা হেসেই অস্থির। একবার বাবাকে জিজ্ঞেসও করল, ‘মা কি পাগল হয়ে গেছে? খুশিতে কেউ কাঁদে?’ আশা তো জানে না যে একজন নামকরা পাবলিশার্স তিতলির জন্য চুক্তি সই করেছে আমাদের সঙ্গে, তার কোম্পানির সব ক্যালেন্ডার, পত্রিকা, বইয়ের কভার এগুলোর ছবি এঁকে দেবে তিতলি। এক বছরের চুক্তি হয়েছে, কাজ পছন্দ হলে এই চুক্তি বাড়ানো হবে। আমার ব্যাগে তখন পাবলিশার্সের দেওয়া অগ্রিম ২০ হাজার টাকার একটা চেক। আমার স্পেশাল বাচ্চার প্রথম ইনকাম। এই টাকাগুলো আমি রেখে দেব। ওকে একটা আর্ট গ্যালারি করে দেব। ও মনের মতো ছবি আঁকবে, গ্যালারিটা দেখাশোনা করতে আশা সাহায্য করবে। একদিন নামকরা শিল্পী হবে তিতলি। এত সুখ কী আমার ভাগ্যে আছে? ভাবতে ভাবতে আমার চোখে জল আসে। আশা আছে বলেই তো আমরা বেঁচে থাকি, আশাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। (শেষ)

ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন