কমলা সুন্দরী

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

সপ্তাহে তিন দিন সাত সকালে ক্লাসে ছুটতে হয়। এক দিনের অনুপস্থিতি মানে অন্তত সাত দিন পেছনে পড়ে যাওয়া। রোদ-বৃষ্টি সবকিছু উপেক্ষা করেই পথ চলতে হয়। মাঝেমধ্যে নিজেকে প্রবোধ দিই, এখানে পড়ালেখা করার সুযোগ তো পেয়েছি। বাংলাদেশে এমন অনেক মেধাবী আছেন, যাঁরা হয়তো অনেক কারণেই এমন সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। অতএব, অবহেলা করব কেন?

ফেরার পথে নিজস্ব গাড়ির দেখা মেলে না, ক্ষতি কী? আমার কমলা সুন্দরী আছে না, আমায় বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য? ধীর পায়ে হেঁটে যাই ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন যাত্রীছাউনির দিকে। আমার মতো অনেকেই থাকেন সেখানে। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। আবার কেউ-বা স্মার্টফোনে গেম খেলতে খেলতে আপন মনেই হেসে উঠছেন।

মনে পড়ে বাংলাদেশে কাটানো প্রায় তিন বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা। উত্তরা থেকে বসুন্ধরা। প্রায় প্রতিদিন যুদ্ধ করা যেখান থেকে বাসে উঠতে হতো। জায়গাটি জুড়েই ছিল ছাত্রছাত্রীদের রাজত্ব। কেউ হয়তো রাস্তার পাশে ঝাল চটপটির থালায় ডুবেছেন। কারও প্রশ্ন, ‘এই তোর কাছে ভাংতি আছে রে? আমি টাকা ভাঙাতে ভুলে গেছি, এবার বাস ভাড়া কোথায় পাই?’

কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়ে অন্তত একটা ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা। থেকে থেকে টিকিট কাউন্টার থেকে আশ্বাস, ‘এইতো গাড়ি আইতাসে মামা, যানজটে পড়সে তো, তাই এট্টু দেরি আর কী!’

এই এট্টু দেরি আর শেষ হয় না। আরও পঁচিশ মিনিট দাঁড়িয়ে যাও বা ফাল্গুন বাসের দেখা মিলত। তাতে এতই ভিড় যে ওঠার উপায় নেই। যদি ভিড় না-ও থাকে, বাস এতই উঁচু যে, উঠতে গেলে নিশ্চিত জখম। নয়তো লোহায় আটকে কাপড় ছিঁড়ে যাওয়া। তাই রক্ত ঝরতে থাকা হাত পা অথবা নতুন ওড়নার ছেঁড়া অংশ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।

বাবার হাত ধরে পাশে বসা আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে সহপাঠিনীর কথায়, ‘কাজী, চারটা পঁচিশ পয়সা হবে? আমার কাছে এক ডলারের খুচরা নেই।’ ব্যাগ হাতড়ে খুঁজে বের করি রুপালি ধাতব মুদ্রা। তুলে দিই ওর বাড়ানো হাতের তালুতে।

চারপাশে বাতাসে দুলতে থাকা গোলাপের সুবাস আমায় আবারও টেনে নিয়ে যায় আমার বাংলাদেশে। নড়বড়ে ফাল্গুন বাসে। নারী সিট অনেক সময়ই পুরুষ যাত্রীদের দখলে থাকত। সিট ছাড়তে বললে তাদের মুখে কথার খই ফুটত, ‘এক্ষণ নাইমা যামু আফা, এট্টু খাড়ান।’ আর যারা একটু ‘ভদ্র’ গোছের, তাদের দৃষ্টিতে মনে হতো আমি যেন ভিনগ্রহের প্রাণী। আর যদি দাঁড়িয়েই যেতে হতো, তবে মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে যেতাম। যদিও সঙ্গে আমার বাবা থাকতেন এবং তাঁর জন্য আমি একটু আরামেই আসতে পারতাম। তবু, বাঙালি নারীমাত্রই জানেন, গণপরিবহনে হাজার রকম ভোগান্তির কথা। আর ফাল্গুন বাসের কিছু সিটের ওপর লেখা ‘প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত’ কথাটি তো কেবল কথার কথা, কাজে প্রমাণ নেই মোটেও।

যাত্রীছাউনি থেকে উঠে দাঁড়াই এবার। ওই তো দূরে, আমার কমলা সুন্দরী আসছেন! এবার আমায় তৈরি হতে হবে। দুই মিনিট পরই আমার সামনে চলে এলেন তিনি। আমার কমলা সুন্দরী, অর্থাৎ মেট্রো ২৬৭। ঝকঝকে উজ্জ্বল রং, ভাঙাচোরা নেই একেবারেই। সারা গায়ে অনেক রকম বিজ্ঞাপন। আমি উঠতে গিয়েও থমকে দাঁড়াই। সাইরেন বাজছে যে! এই সুরের অর্থ আমার জানা। একটু পরেই নেমে এল যন্ত্রচালিত হুইলচেয়ার। যিনি বসে আছেন, তাঁর শরীর স্বাভাবিকের থেকে হয়তো একটু অন্য রকম। তবে তাঁর দুই চোখে ঝরছে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। আমায় দেখে মৃদু হাসলেন তিনি, ‘কাজী, তোমায় দেখে খুশি হলাম, তোমার দিনটা অনেক ভালো কাটুক।’ তাঁর হাসিতে আমিও হেসে উঠি, ‘কেমন চলছে তোমার ক্লাস? ভালো তো? অনেক ভালো থেকো।’

মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই, ‘খোদা, ওনার থেকে অনেক ভালো অবস্থানে আছি আমি, আলহামদুলিল্লাহ।’

পরিচিত বাসচালক এবার তাড়া দেন, ‘উঠে এসো, বাড়ি যাবে না?’

এবার আমি ঢুকে পড়ি কমলা সুন্দরীর পেটের ভেতর। সিটে বসতে যাব, আবারও সেই সাইরেন। এবার ছোট্ট সন্তানের হুইল চেয়ারকে হালকা ঠেলে বাসে তুললেন একজন মা। নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন চালক। উঠে দাঁড়ালেন তিনজন যাত্রীও। মুড়ে ফেলা হলো ওই তিনজনের আসন। বাসচালক সেই হুইল চেয়ারটি সাবধানে বসিয়ে দিলেন মুড়ে ফেলা আসনের পাশে। তিনজন যাত্রীর কোনো ভাবান্তর নেই তাতে। আমি পাশের বিশেষ নীল আসনে বসে দেখছি আর ভাবছি, ‘হায়রে বাংলাদেশ, কোথায় ফাল্গুন, আর কোথায় মেট্রো!’

প্রাণের বাংলাদেশ ছেড়ে আসতে চাইনি। বাধ্য হয়েছিলাম গণপরিবহনে প্রতিদিনের যুদ্ধ সহ্য করতে পারিনি বলে। এখানে শুধু একটি দুটি আসন নয়, গোটা বাসের বেশ বড় একটি অংশ সত্যিকার অর্থেই ‘প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত’। এমনকি বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের ভাড়া স্বাভাবিকের তুলনায় অর্ধেক!

হঠাৎ আমার হাতে টান পড়ে। চমকে তাকাই, কাটল নাকি? মোটেও না, সেই ছোট্ট শিশুটি আমার হাত নিজের মুঠোবন্দী করেছে। এখানে শখের ওড়না ছিঁড়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই। আমি ওড়নার আড়ালে মুখ লুকাই, পরমুহূর্তে উঁকি দিই আড়াল থেকে, ‘টুকি! টুক...টুকি!’ আমার লুকোচুরি খেলায় সাড়া দিল শিশুটি। আর তার খিলখিল নিষ্পাপ হাসিতে আমার সঙ্গে বাকি যাত্রীরাও হেসে উঠলেন। এক মুহূর্তে সব ক্লান্তি পালিয়ে গেল শরীর-মন ছেড়ে। আমায় নিয়ে ছুটে চলল কমলা সুন্দরী, আমার গন্তব্যে।