বরফের খোলস থেকে বেরিয়ে

সনি সেন্টারে বিগ টপ একাডেমি টিভি তারকাদের মাঝে সস্ত্রীক লেখক
সনি সেন্টারে বিগ টপ একাডেমি টিভি তারকাদের মাঝে সস্ত্রীক লেখক

গাছে গাছে ফুল। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। বাহারি সব রঙিন পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে যুবক-যুবতীদের পথে আনাগোনা। কপোত-কপোতীদের একে অপরকে ফুল দেওয়া, ফুল নেওয়া। এ হলো আমাদের বসন্ত। হৃদয়ে দোলা দেওয়া এই বসন্ত পেরিয়েই আসে নতুন বাংলা বছর। বৈশাখে বর্ষবরণ। চারদিকে সাজ সাজ রব। হরেক রকম আয়োজন। কী সুন্দর আমার দেশ। বাংলাদেশ। ঋতুর পরিবর্তনে আসে আবহাওয়ার ভিন্নতা। আর সেই অনুযায়ী কতই না অনুষ্ঠান!

থাকি ঠান্ডার দেশে। বরফে। উত্তর আমেরিকার ওন্টারিওতে। আবহাওয়ার পরিবর্তনটা এখানে ক্যালেন্ডারের সঙ্গে ঠিক যায় না। বসন্তের শুরু হয়েছে মার্চের ২০ তারিখ। তবু শেষ তুষারপাতটা হলো মার্চের ৩১। বুঝুন! গত বছর মধ্য এপ্রিলেও তুষারবৃষ্টি হয়েছে। এ বছরটায় হয়নি। চারদিকে জমে থাকা বরফের স্তূপ এখন আর নেই। শীতের অসহনীয় ঠান্ডাও শেষ হয়েছে।

বরফের খোলসে আবদ্ধ দীর্ঘ শীতের সময়টা শেষ হলেই বাচ্চারা উত্তেজিত থাকে কোথায় যাবে, লাইব্রেরি আর কমিউনিটি সেন্টারের কী সব প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করবে তার তালিকা তৈরিতে। উৎসাহ দিই আমি। তালিকাটা একটু কাটছাঁটও করি। চেষ্টা থাকে শিক্ষণীয় আর আনন্দেরগুলোতে জোর দিতে। তালিকায় ছিল টরন্টোর সনি সেন্টারে আয়োজিত ফ্যামিলি ফ্যান ডে। ডাউন টাউনের ফ্রন্ট স্ট্রিটে অবস্থিত সুবিশাল বিল্ডিং সনি সেন্টার। সেখানে এ অনুষ্ঠান। টরন্টোতে বৈশাখী উৎসবের কদিন আগে। একই দিনে পরিবারের সবার জন্য ডেন্টিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া ছিল। নাবিহা আর নাশিতার চাওয়াকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে অ্যাপয়েন্টমেন্টটা অন্য দিনে ঠিক করলাম। ফ্যামিলি ফ্যান ডেটা তালিকার শীর্ষে এল। পরক্ষণেই ফিরে তাকিয়ে তাদের চেহারায় জিতে যাওয়ার চমৎকার হাসিটা দেখতে পেলাম। ছোট্ট মামণিদের মুখের অপূর্ব এই হাসি আমাদের বেঁচে থাকার শক্তি।

সেদিন ছিল শনিবার। পুরো সপ্তাহের অতি ক্লান্তিকর দিনগুলো পেরিয়ে সাপ্তাহিক এই ছুটির দিনে একটু বেশি ঘুমাতে চাই। সম্ভব না। সদা উৎসাহী কচি মনের দুরন্ত বাচ্চারা তা হতে দেয় না। তাদের এই উদ্দীপনাতে বেশ ভালো লাগে। উপভোগ করি। সব ক্লান্তিকে তখন সুখ মনে হয়।

বিগ টপ একাডেমি তারকাদের সঙ্গে জাগলিংয়ে
বিগ টপ একাডেমি তারকাদের সঙ্গে জাগলিংয়ে

ফ্যামিলি ফ্যান ডের সকাল। বের হলাম আমরা। সপরিবারে। যাব ফ্রন্ট স্ট্রিটের সেই সনি সেন্টারে। ব্যস্ত শহর টরন্টো। স্বভাবতই ডাউন টাউনটা জনাকীর্ণ। সেখানে গাড়ি চালিয়ে মজা পাই না। পার্কিংও একটা মাথা ব্যথার কারণ মনে হয়। সাবওয়েতেই বেশ সুবিধা। আরামদায়কও। স্কারবোরো টাউন সেন্টার স্টেশনে ট্রেনে উঠলাম। সিটে বসামাত্রই পা থেকে জুতাটা খুলে ফেলল গ্রুপের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ইহান। এ তার অভ্যাস। বলল সু ফলনো! কিছু পড়ে গেলে ফলডাউনকে বলে ‘ফলনো’। প্রতিদিন নতুন নতুন শব্দ শিখছে সে, এখন বেশ কিছু সুন্দর বাক্যও বলতে পারে। স্বজ্ঞানে এটা তার প্রথম ট্রেনে ওঠা। শেষবারে সে ছিল স্ট্রলারে শুয়ে থাকা লিটল বেবি। তার অতি উৎসাহী স্কুলবয়সী বোনেরা অভিজ্ঞদের মতো দিক নির্দেশনা দিয়ে চলল। এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।

গন্তব্যে পৌঁছে চোখে পড়ল মানুষের ভিড়। লম্বা লাইনের অনেক পেছনে আমরা। চার ঘণ্টার প্রোগ্রাম। সকাল ১০টা থেকে আরম্ভ, বেলা ২টায় শেষ হবে। প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে জেনে বাচ্চাদের আর তর সয় না। চোখে মুখে তাদের বিষণ্নতা স্পষ্ট। উপায় নেই। প্রচণ্ড ভিড়ে পাশ কাটিয়ে অন্যকে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সস্তা কালচারে বিশ্বাসী নই। বাইরে ঠান্ডা, দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। তবু দাঁড়িয়ে। প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে আমাদের গ্রুপটা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। আহ, কী শান্তি! অবশেষে কাঙ্ক্ষিত জায়গায়। সেলিব্রিটিদের মধ্যে।

প্রথমত, দ্রুতই গেলাম বিগ টপ একাডেমি কর্নারে। টিভিও কিডস কানাডায় এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান। মজার ও শিক্ষণীয়। কিছু তুখোড় মেধাবী কচি ছেলেমেয়ের অসাধারণ অভিনয় আর বিভিন্ন শারীরিক কসরতে তৈরি এই অনুষ্ঠানটি দেশব্যাপী তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সেই আর্টিস্ট ও অ্যাথলেট কচি তারকারা এখানে। তাদের মধ্যে ফিনেক্স, রোসা, এপ্রিল, সেলেষ্ট, এলা—এরা মেয়ে আর্টিস্ট। আর ছেলে তারকারা—নিকোলাস, চেস, আক্সেল ও ম্যাক্সওয়েল। কী স্মার্টই না তারা! আচার-ব্যবহারও অমায়িক। অতিথি দর্শকদের সঙ্গে সহাস্যে ছবির পোজ দিচ্ছে। উৎসুক মানুষের উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে অভিনয় আর আর্টিস্টিক কারুকার্য দেখাচ্ছে। আর শেখাচ্ছে।

টেলিভিশন অনুষ্ঠান ট্রি হাউস জোনে তারকার সঙ্গে
টেলিভিশন অনুষ্ঠান ট্রি হাউস জোনে তারকার সঙ্গে

বিগ টপ একাডেমি গল্পের একটু ধারণা দিই। নিকোলাস কেন্দ্রীয় চরিত্রে। ফিনেক্স তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। ম্যাক্সওয়েল বন্ধু নয়, শত্রুই বলা যায়। বাবা নিকিজল্টারের খোঁজ জানা নেই। বেঁচে আছেন নাকি নেই? অজানা। অ্যাথলেট নিকিজল্টার রোপওয়েতে হেঁটে মেক্সিকোর এক জলপ্রপাত পাড়ি দেওয়ার সময় হারিয়ে যান। এক জাদুর মার্বেলের ছোঁয়ায় আসলে তিনি জীবিত। পেয়েছেন অসীম কিছু শক্তিও। তবে আগের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে মেক্সিকোতে তিনি গ্র্যান্ড মালাবোর নামে পরিচিত। সেখানে সার্কাসের বিভিন্ন কলাকৌশল শেখান। ছাত্রী রোসাকে নিয়ে গ্র্যান্ড মালাবোর কানাডায় বিগ টপ একাডেমিতে আসেন। এই একাডেমির প্রধানের নাম সুরেন। ম্যাক্সওয়েলের বাবা তিনি। সুরেন নিকিজল্টারকে দেখতে পেলেন। এই গ্র্যান্ড মালাবোরই আসলে নিকিজল্টার। সুরেনের খুব ভালো বন্ধু। নিকোলাস আর ম্যাক্সওয়েলের সেটা অজানা। জাদুর সেই মার্বেলের ছোঁয়া নিকোলাসও পেয়েছিল। অসীম কিছু অদৃশ্য শক্তি তারও আছে। সেই শক্তিতে নিকোলাস বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মাঝে খারাপ ব্যবহার করে। কোনো কিছুই যাতে নিকোলাসের ক্ষতির কারণ না হয়, তাই ফিনেক্স, সেলেষ্ট, এলা এরা সবাই চেষ্টায় থাকে। হাজারো রহস্যের পর নিকোলাস পায় তার বাবা নিকিজল্টারকে।

বিগ টপ একাডেমির সেই একঝাঁক তারকার সঙ্গে মিষ্টি সময় কাটিয়ে বাচ্চারা দৌড়ে গেল আরেক প্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘ট্রি হাউস’ জোনে। সেই অনুষ্ঠান তৈরিতে ব্যবহৃত সাজসজ্জার বিভিন্ন ফানি আইটেম আছে সেখানে। সেগুলো নিয়ে নিজেদের কল্পনা আর চিন্তাশক্তিকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করল। ফানি চেহারায় ফটোসেশনটাও হলো।

পেপ্পা পিগ জোনে প্রিয় জর্জ আর পেপ্পার সঙ্গে
পেপ্পা পিগ জোনে প্রিয় জর্জ আর পেপ্পার সঙ্গে

ট্রি হাউসের ব্যারাক পেরিয়ে পা বাড়াই পরেরটায়। শিশুদের অনেক ভালো লাগার আরেকটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান হলো এই পেপ্পা পিগ। অ্যানিমেটেড প্রোগ্রাম। বড় বোন ‘পেপ্পা’ আর তার ছোট ভাই ‘জর্জ’ সেখানে। প্রিয় সেই দুই ক্যারেক্টারকে ছুঁয়ে দেখা। তাদের সঙ্গে হাঁটাহাঁটি। কল্পনাকে সামনে এনে অনুভব করা।

ফ্যামিলি ফ্যান ডেতে সেখানে সিবিসি টরন্টোও। সংবাদ আর সাংবাদিকতার গুরুত্ব আলোচনায়। বিখ্যাত সাংবাদিক ডোট ড্রুমোন্ড স্টেজে বসে তাঁর ব্যতিক্রমী কণ্ঠে ভয়েস দিচ্ছেন। আগ্রহী স্কুল-কলেজ বয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে নিয়ে সংবাদপাঠের কৌশল শেখাচ্ছেন। স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। বড় হওয়ার স্বপ্ন। আজকের কচি আর তরুণদের মাঝেই লুকিয়ে আছে আগামী দিনের খ্যাতিমানেরা। সিবিসি নিউজের পর এই মেইন স্টেজে একের পর এক চলল বিভিন্ন নাচ, গান আর ম্যাজিক।

কানাডা বরফের দেশ। কিছুটা বিষণ্নতায় ভরা রসহীন দীর্ঘ শীতকাল এখানে। সেটা পেরিয়ে বসন্তের শুরু। সবার মধ্যে ভালো লাগার অনুভূতি আসে। ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের মুক্ত আবহাওয়াটাকে ভোগ করার সময় এটা। সেটা শুরু হয়েছে। ফ্যামিলি ফ্যান ডেতে ভিন্ন ভিন্ন সেক্টরের জনপ্রিয় সব তারকার সঙ্গে সপরিবারে সময় কাটিয়ে টরন্টোবাসীর অনেক ফান হয়েছে। অনেক মজা। গ্রীষ্মকালটা অনেক বেশি আনন্দের। সেটার অপেক্ষায়!
...

ড. মো. সাদেকুল ইসলাম পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট।
ই–মেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <sadequl>