আমার মায়েরা

ছোটবেলায় বাবা-মা–চাচা–চাচিকে অনেক সুন্দর সুন্দর ডাকে সম্বোধন করতাম। নিজের বাবাকে আব্বা, তার সঙ্গে মিলিয়ে অন্য চাচাদের তাদের পারিবারিক অবস্থান অনুযায়ী আব্বা ডাকা হতো। যেমন: বড়আব্বা, মাজি (মেজ) আব্বা, ছোটআব্বা ইত্যাদি। আবার মায়েদেরও একইভাবে সম্বোধন করা হতো। যেমন: বড়মা, মাজিমা, ছোটমা ইত্যাদি। এ ছাড়া দাদির বাবা-মাকে আমরা যথাক্রমে বড়আব্বা ও বড়মা বলতাম। দাদির চাচাদেরও একইভাবে বড় বড়আব্বা, মেজ বড়আব্বা, ছোট বড়আব্বা আর চাচিদের বড় বড়মা, মেজ বড়মা, ছোট বড়মা ইত্যাদি। আমার দাদির ছিলেন সাত চাচা। তাঁরা আশপাশের পাড়াতেই থাকতেন। তাঁদের আবার একগাদা ছেলেমেয়ে, যাঁদের আমরা দাদা–দাদি ডাকতাম। বড়, মেজ, ছোট এই সম্বোধনের বাইরে গিয়েও অবস্থান অনুযায়ী আরও কিছু ডাক ছিল। যেমন: সেজ, নোয়া ইত্যাদি। আমি খুবই সৌভাগ্যবান, এসব মানুষের আদর পেয়েছি।

দাদিরা ছিলেন তিন বোন। কোনো ভাই ছিল না। দাদির বড় সন্তান আমার বাবা। আর তাঁর বড় সন্তান আমি। তাই দাদির বাবা-মায়ের কাছে আমার বাবা বরাবরই ছেলের আদর পেতেন। আমি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সেই আদরের পুরোটার দখল পেয়ে গেলাম উত্তরাধিকার সূত্রে। আমার মায়ের বাইরে বড়মা ও দাদির আদর পেয়েছি একেবারে অকৃত্রিমভাবে। একান্নবর্তী পরিবারে মা, দাদি যখন সংসার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, তখন আমাকে আগলে রাখতেন বড়মা। সারা দিন নাওয়া–খাওয়া থেকে শুরু করে সবদিকেই ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ নজরদারি। এ ছাড়া তাঁর আদরে বড় হতে হতে পেয়ে গেলাম অবারিত স্বাধীনতা। যার ফলে হয়ে উঠলাম পাড়ার দুষ্টুকুল শিরোমণি। দাদির মেজ বোনের নাতি আনোয়ার আমারই সমবয়সী। আনোয়ারেরা নাইওরে এলে ওকে শাগরেদ হিসেবে পেয়ে আমার দুষ্টুমি একেবারে লাগামছাড়া হয়ে যেত। তখন পাড়ার সব বাড়ির নারীরাই ত্রস্ত থাকতেন কখন কার বাসায় আমরা হামলে পড়ি। আর যদি কোনো দুষ্টুমি করতে গিয়ে ধরা খেতাম, তখন আমাদের উদ্ধার করতে হাজির হতেন বড়মা।

এরপর যখন আমার দাদি আলাদা বাড়ি করলেন, তখন বড়মায়ের জায়গা নিলেন দাদি। দাদির আদরে আমি সত্যিকার অর্থেই পুরোপুরি বাঁদর বনে গেলাম। স্কুলে যাওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সারা দিন শুধু খেলা আর খেলা। মাঠঘাট এক করে ফেলতাম আমরা। তত দিনে আমাদের মেজ ভাইটা বড় হয়ে গেছে। তাই আমিও পেয়ে গেলাম একজন সার্বক্ষণিক যোগ্য সহচর। দাদির গোয়ালে অনেক দুধেল গাভি ছিল। সকালবেলা গোয়ালা এসে সেগুলোকে দুইয়ে নিয়ে যেতেন। আমার কাজ ছিল যখন গোয়ালা গরু দোয়াতেন, বাছুরটার দড়ি ধরে থাকতাম যাতে সেটা ছুটে গিয়ে আবার দুধ খেতে শুরু করতে না পারে। দোয়ানো শেষ হলে গোয়ালের পেয়ালার এক পেয়ালা দুধ যেটাকে আমাদের গ্রামের ভাষায় আমরা বলতাম এক পোয়া মানে এক সেরের চার ভাগের এক ভাগ, সেটাই বরাদ্দ থাকত আমার জন্য। এটা ছিল একেবারে প্রতিদিনকার রুটিন। এ ছাড়া দাদির পাড়া বেড়ানোর সার্বক্ষণিক সঙ্গী আমি আর আমার মেজ ভাইটা। মেজ ভাইকে দাদি কোলে নিয়ে নিতেন আর আমি তাঁর শাড়ির আঁচল ধরে হেঁটে চলতাম।

এরপর একসময় নিজ জন্মভূমি চরভবানীপুর ছেড়ে কুষ্টিয়ার শহরতলি বাড়াদীতে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করলাম আমরা। আমার বন্ধু আমিনুর আর আমি একই ক্লাসে পড়তাম। আসলে একই ক্লাসের হওয়াতেই আমাদের বন্ধুত্বটা হয়ে গিয়েছিল। আমিনুরের মা আমাকে তার ছেলের মতোই আদর করতেন। আমার পছন্দের খাবার কী, সেটাও কীভাবে যেন জেনে গিয়েছিলেন। তাই আমি কখনো তাঁদের বাসায় গেলেই সব তরকারি বাদ দিয়ে আমার জন্য কলাইয়ের ডাল আর আলুভর্তা করতেন। সঙ্গে গরম-গরম সাদা ভাত। আর যদি আমি আসব—এই খবর তাঁর কানে আগে থেকেই পৌঁছাত, তাহলে তিনি যেভাবেই হোক আমার জন্য কচুর শাক জোগাড় করে ঘন্ট করতেন। আমার ভালো ফলে তেমনি খুশি হতেন, যেমন খুশি হতেন তাঁর ছেলেদের ভালো ফলের খবর শুনে। আমি ঢাকা থেকে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা না করলে অনেক মন খারাপ করতেন এবং পরেরবার গেলে সেটা মনে করিয়ে দিতেন।

বুয়েটে ভর্তির পর বন্ধু পাভেলের মাধ্যমে পরিচয় হলো রাশেদা আন্টির সঙ্গে। আমরা অবশ্য তাঁকে আন্টি বলেই সম্বোধন করতাম। তবে আংকেল তাঁকে আদর করে ডাকতেন রাশু বলে। এই মানুষটার গাত্রবর্ণ ছিল আমার কাছাকাছি। তাই মনে হতো তিনি যেন আমার আপন মা। কারণ, ছোটবেলায় সবাই আমাকে বলত, আমি নাকি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান। আমার মায়ের গায়ের রং ছিল আমার গায়ের রঙের উল্টো। তাই সবাই বলত, দেখো, তুমি যদি তোমার মায়ের সন্তান হতে, তাহলে তুমি হতে ফরসা, যেমন তোমার মেজ ভাইটা। কিন্তু তুমি তো কালো। আসলে একদিন একটা ভিক্ষুক তোমাদের বাসায় ভিক্ষা করতে এসেছিল তোমাকে কোলে নিয়ে। তখন তোমার মা চালের বিনিময়ে তোমাকে রেখে দিয়েছিল। আমি তাঁদের এমন কথা শুনে খুবই মন খারাপ করতাম আর ভাবতাম, আমার আসল মা যাঁর গায়ের রং কালো, তিনি এখন কোথায়। আন্টির সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী, কিন্তু কখনোই আমাদের খালি মুখে ফেরাতেন না। সব সময়ই কিছু না কিছু খাইয়ে দিতেন। সবার চেয়ে আমাকে আদর একটু বেশিই করতেন। তাই আমি গেলেই হাঁড়িতে যা আছে, আমার পাতে দিতেন। মুখ দেখেই বুঝে ফেলতেন আমার পেট ভরা না, খালি।

আন্টির দুই মেয়ে, এক ছেলে। রুপা তার মধ্যে সবার বড়। আমাদেরই কলেজে আমাদের এক ক্লাস নিচে পড়ত। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে আমার বন্ধু পাভেলের সঙ্গে পরিচয়। সেই সূত্রে আমাদেরও অনেক কাছের মানুষ হচ্ছে রুপা। রুপাকে আমি মা বলে সম্বোধন করি। সত্যি কথা বলতে, এখনো মা বলেই সম্বোধন করে যাচ্ছি। রুপাও আন্টির মতো আমার মন বুঝতে পারে। আমার কী ভালো লাগে বা খারাপ লাগে, তার সবই তার জানা। বুয়েট পাস করে বাসা খুঁজছিলাম। রুপা বলল, তুই আমাদের বাসায় উঠছিস না কেন? পরে বাসা পেলে সেখানে চলে যাবি। পরদিনই আমি উঠে পড়লাম ওদের বাসায়। আমার খাবারদাবার ছাড়াও আমার পোশাক–পরিচ্ছদের ব্যাপারে ছিল ওর তীক্ষ্ণ নজর। আমি বরাবরই একটু বেশি খাওয়াদাওয়া করতাম। তাই আমি গেলেই আমার জন্য আলাদা হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে দিত। আমার খাওয়ার পরিমাণ আসলেই অনেক বেশি ছিল। তাই বন্ধু মান্না আমার খাওয়া দেখে বলত, তুই আসলে খাবার হাড়ের মধ্যে গুঁজে রাখিস, না হলে তোর এত খাবার যায় কোথায়? শুনে রুপা বলত, তোরা শুধু ওর খাওয়াটাই দেখিস, ওর পরিশ্রমটা দেখিস না।

বড়মা থেকে শুরু করে দাদি, বন্ধু আমিনুরের মা, আন্টি, রুপা—সবার কাছেই আমি তাদের নিজ সন্তানতুল্য আদর পেয়ে বড় হয়েছি। তার মধ্যে বড়মা ও দাদি আজ আর এই পৃথিবীতে নেই। আমিনুরের মায়ের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া আসার আগে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন জানতে চেয়েছিলেন, কবে আবার দেশে ফিরব। এখনো আমার দেশে যাওয়া হয়নি। সময়ের অভাবে আন্টি বা রুপার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। তবে আসার আগে ফোনে কথা হয়েছিল। সম্প্রতি আন্টি পক্ষাঘাত ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। রুপা দুবাইয়ে থাকে। ফুটফুটে দুই সন্তান নিয়ে ওর আদর্শ সংসার। মা দিবস এলে তাই আমার নিজের মায়ের বাইরে এই মায়েদের কথায় আমার মনে পড়ে, যাঁরা আমাকে নিজ সন্তানের চেয়েও বেশি আদর করেন অনেক ক্ষেত্রে। আমি আসলেই অনেক ভাগ্যবান, একসঙ্গে এতগুলো মা পেয়েছি বলে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আমার এই মায়েদের কারও সঙ্গেই এমনকি আমার নিজের মায়ের সঙ্গেও আমার কোনো ছবি নেই। তাই মা দিবস এলে সবাই যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের মাকে নিয়ে ছবি দেন, তখন আমি কোনো পোস্ট দিই না।

আসলে মায়ের সঙ্গে সন্তানের যে সম্পর্ক, তা তুলনাহীন। এটা এমনই একটা নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্ত সম্পর্ক, যেখানে একজন সন্তান সারা জীবনই কোনো না কোনোভাবে তার মায়ের কাছ থেকে শুধুই গ্রহণ করে যায়। কিন্তু প্রতিদানে তেমন কিছুই করার নেই। অবশ্য মায়েরা প্রতিদানের আশা না করেই তাঁদের সন্তানদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান। বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে মানুষ তার নিজের তৈরি যন্ত্রের কর্মক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে জীবন থেকে মায়ের মতো অমূল্য উপহারকেও হারিয়ে ফেলতে বসেছে। মার্কেট ইকোনমি সবকিছুকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। যার ফলে এখন আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মায়েদের জন্য একদিনই শুধু ভালোবাসা প্রকাশ করি। কিন্তু বছরের বাকি দিনগুলোয় আমরা আর তাঁর খোঁজ নিই না। পৃথিবীতে মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়াটা অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। কারণ, বাবা-মা থেকে শুরু করে আত্মীয়পরিজন–বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক বিদ্যমান। যেটা ধরাও যায় না ছোঁয়াও যায় না। কিন্তু অনুভব করার যায়। আর এই অনুভবের সবচেয়ে দৃঢ় বন্ধন হচ্ছে মায়ের সঙ্গে তাঁর সন্তানের সম্পর্ক। পৃথিবীর সব মায়ের জন্য অসীম ভালোবাসা।

মো. ইয়াকুব আলী। ই–মেইল: <[email protected]>