মাতৃহীনের মাকে নিয়ে না বলা কথা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সব সন্তানেরই মাকে নিয়ে থাকে অজস্র মধুর স্মৃতি। মা যদি জীবিত থাকেন সেই স্মৃতিচারণা হয় অনেক মধুর। আর মা যদি জীবিত না থাকেন তবে সেই স্মৃতিগুলো হয় নিতান্তই বেদনার। তেমনি কিছু বেদনার স্মৃতি আমি তুলে ধরতে চাই।

আমার মা বেঁচে নেই। অত্যন্ত অল্প বয়েসে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমার মাকে আমি পেয়েছি খুবই কম সময়। আমার দুই ছোট ভাইবোন পেয়েছে আরও কম সময়। ওরা তখন নিতান্তই শিশু। আমরা তখন গ্রামের বাড়িতে থাকি। আমার বাবা আর আমার মেজো চাচার সংসার মিলে আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। আমরা বছরের বেশির ভাগ সময়ই দাদার বাড়িতে থাকতাম। স্কুলের ছুটিতে আমরা এক বা দুই মাস নানাবাড়িতে বেড়াতে যেতাম। দাদার বাড়িতে থাকাকালে মাকে দেখেছি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে। অবসর খুব কমই পেতেন। নানা বাধ্যবাধকতা মেনে চলাফেরা করতে হতো।

আর আমরা যখন নানাবাড়িতে বেড়াতে যেতাম সেই সময়টা ছিল আমাদের জন্য যেমন আনন্দের। তেমনি আমার মায়ের জন্যও ছিল ততোধিক আনন্দের। আমার নানাবাড়ির পাশ দিয়ে একটি খাল ছিল। সেই খালটি ধলেশ্বরী আর পদ্মার (সম্ভবত) সংযোগ রক্ষা করত। খাল দিয়ে যখনই কোনো লঞ্চ যাতায়াত করত আমরা ছোটরা দৌড়ে যেতাম দেখার জন্য। আমার মা যখন তাঁর বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসতেন, আমি দেখেছি মায়ের সে কী আনন্দ। তাঁর চোখ ও মুখে শুধুই আনন্দের প্রতিচ্ছবি। তখন রাজ্জাক-কবরী ও আজিম-সুজাতা আমাদের চলচ্চিত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় জুটি। আমার নানাবাড়ির খুব কাছেই ছিল সিনেমা হল। আমার মা তাঁর ছোটবেলার বান্ধবীদের সঙ্গে যেতেন সিনেমা দেখতে। আমার মায়ের সেই চপলতা এখনো আমার চোখে ভাসে। আমার মায়ের সেই আনন্দ ভোলা যাবে না। নানাবাড়িতে আমরা সারা দিন শুধু খেলাধুলা ও পুকুরে সাঁতার কেটে বেড়াতাম। আনন্দ আর আনন্দ, এভাবেই কেটে যাচ্ছিল জীবন।

সময়টা তখন স্বাধীনতা–উত্তর লাদেশের কিছুদিন পরের। আমরা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জে চলে এলাম। আমরা সব ভাইবোন স্কুলে ভর্তি হলাম। আমার মা তাঁর একান্ত সংসার নিয়ে ব্যস্ত। একবার আমাদের পাশের বাসায় কয়েকজন মেহমান (সস্ত্রীক) বেড়াতে এলেন। আমাদের প্রতিবেশী আমার বাবার বন্ধু একদিন তাঁদের বাসার মেহমান ও বাবার বন্ধুর স্ত্রী ঠিক করলেন সিনেমা দেখতে যাবেন। সঙ্গে আমার মাকেও নিয়ে যাবেন। আমিও যেতে চাইলাম তাঁদের সঙ্গে। কিন্তু টিকিট না থাকায় আমার যাওয়া হলো না। আমার সে কী কান্না। আমার কান্না দেখে মা যেতে চাচ্ছিলেন না। পরে বাবার পীড়াপীড়িতে যেতে বাধ্য হলেন। আর আমি কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ আমার গালে পানির ছোঁয়া লেগে ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি আমার মায়ের কান্নাভেজা মুখ। তাঁর চোখ থেকে দর দর করে পানি বেয়ে পড়ছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে মা শুধু কাঁদছেন। তখন বুঝেছি আমার কান্না দেখে মা কতটা কষ্ট পেয়েছেন। সেই স্মৃতি আজও ভুলিনি। সেদিন মা আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছেন। এভাবে সুখেই চলছিল আমাদের জীবন।

আমার মেজো মামার বিয়ে ঠিক হলো। আমার মা মহাব্যস্ত। কারণ, মা ছিলেন ছয় ভাইয়ের একমাত্র বোন। একদিন বিয়ের ব্যাপারে যাবতীয় আলোচনা শেষ করে আমরা মুন্সিগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জে ফিরে এলাম। আমার মেজো মামা আমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে ঢাকায় চলে গেলেন। রাতে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সবাই। তখনই এল সেই ভয়াবহ সময়। আমার মা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। আমরা সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মা কিছুতেই চোখ খুলছেন না। নারায়ণগঞ্জ তখন মহাকুমা শহর। খুব ভালো ডাক্তারও নেই। সঙ্গে সঙ্গে আমার এক চাচাতো ভাই একজন ডাক্তার নিয়ে এলেন। সেই ডাক্তার কিছুই করতে পারলেন না। পরে নিয়ে আসা হলো আরও একজন ডাক্তার। তিনিও কিছু করতে পারলেন না। মায়ের রক্তচাপ অনেক বেশি থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যে অতি অল্প বয়েসে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমি একটু বুঝতে পারলেও আমার ছোট্ট দুই ভাইবোন কিছুই বুঝতে পারল না, যে আমরা কী হারিয়েছি। আমার মা এভাবে এত দ্রুত চলে যাবেন আমরা কেউ স্বপ্নেও ভাবিনি। মাকে আমরা খুব কম সময়ই পেয়েছি তবু তাঁর অজস্র স্মৃতি আজও অমলিন।

তারপর কেটে গেছে অনেক দিন। অনেকটা অবহেলায় বড় হয়েছি আদর–স্নেহ ব্যতীত। আজ আমরা দেশে–বিদেশে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী ও প্রতিষ্ঠিত। দুঃখ একটাই, কখনো মাকে কিছুই দিতে পারলাম না। মন খারাপ হলে মায়ের কাছে বসে যে সান্ত্বনা খুঁজব সেই জায়গাটাও ছিল না। আমার বন্ধুরা যখন প্রবাস থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে যায়, সবার মা তার পছন্দের খাবার রেঁধে রাখে। তাদের নিয়ে আরও কত কিছু করে। আর আমি এসব শুনে শুধু উদাস নয়নে ভাবি, আজ যদি আমার মা বেঁচে থাকতেন আমার জন্যও মা অপেক্ষা করতেন। মাঝেমধ্যে ভাবি যদি একবার মায়ের ছোঁয়া পেতাম। যদি একবার মা আমার মাথায় হাত দিয়ে আদর করতেন। যদি একবার মায়ের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে পারতাম। তাই তো বারবার মায়ের সেই কান্নাভেজা মুখটি এখনো আমার মনে ভেসে ওঠে।

মাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। সব স্বপ্নই অপূর্ণ রয়ে গেল। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও যদি মাকে ফিরে পেতাম! পরিশেষে এটুকুই শুধু প্রার্থনা, মহান আল্লাহ তাআলা আপনাকে বেহেশতবাসী করুন, নিশ্চয়ই মহান দয়াময় আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখবেন।