ইস্তাম্বুলে সুফিবাদ শীর্ষক আলোচনা

ইস্তাম্বুলে বাংলাদেশ ও তুরস্কের ঐতিহাসিক সম্পর্ক: প্রেক্ষিত সুফিবাদ শীর্ষক আলোচনা
ইস্তাম্বুলে বাংলাদেশ ও তুরস্কের ঐতিহাসিক সম্পর্ক: প্রেক্ষিত সুফিবাদ শীর্ষক আলোচনা

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ‘বাংলাদেশ ও তুরস্কের ঐতিহাসিক সম্পর্ক: প্রেক্ষিত সুফিবাদ’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইস্তাম্বুলের বাংলাদেশ কনস্যুলেটের ফ্রেন্ডশিপ হলে গতকাল সোমবার (১৩ মে) স্থানীয় সময় বিকেলে এ আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মী, লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহরিয়ার কবিরের ‘মিতহাতের স্বপ্ন’ প্রামাণ্যচিত্রও প্রদর্শন করা হয়। আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা ছাড়াও ইস্তাম্বুলে নিয়োজিত বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম, কনসাল বিদোষ চন্দ্র বর্মন, প্রবাসী বাংলাদেশি, তুরস্কের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন।

মিতহাতের স্বপ্ন প্রদর্শণের পর আলোচনাপর্বে প্রামাণ্যচিত্র তৈরির পটভূমি বর্ণনা করতে গিয়ে শাহরিয়ার কবির প্রথমে জালাল উদ্দিন রুমির জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, রুমি (১২০৭-১২৭৩) সর্বকালের অন্যতম মহান মানবতাবাদী, দার্শনিক ও কবি। জ্ঞান, চিন্তা ও ভাবের ঐশ্বর্যে তাঁর মাসনাভি এক অতুলনীয় কাব্যগ্রন্থ। তৎকালীন আনাতোলিয়া বা বর্তমান সময়ের তুরস্কের কনিয়ায় তিনি যে মরমিবাদী বাণী প্রচার শুরু করেছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁর শিষ্যরা অর্থাৎ দরবেশরা সেই বাণী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সিরিয়া, মিসর, ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান ও ভারতে। তাঁর শিষ্য হজরত শাহজালাল (রহ.) সুফিবাদী ধারা প্রচার করতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ পর্যন্ত। আজকের বিরূপ বিশ্বে যাঁরা সুফিবাদের মানবতাবাদী বাণী প্রচার করে চলেছেন, তুর্কি যুবক দরবেশ মিতহাত তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

বক্তব্য দিচ্ছেন শাহরিয়ার কবির
বক্তব্য দিচ্ছেন শাহরিয়ার কবির

বর্তমান সময়ে রুমির জীবন-দর্শনের প্রাসঙ্গিকতার ওপর বলতে গিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, সুফিবাদ উদার মানবতাবাদ ও সমন্বয়ী চেতনার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। রুমি সংকীর্ণ পরিচয় ও ভেদবুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের পরিচয়ে সবার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আত্মিক স্বাধীনতা লাভের জন্য মনোযোগী হতে বলেছেন। তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি, উদার মানবিকতা ও অপার ভালোবাসা মানব সমাজ ও সভ্যতার বিকাশে এক অমূল্য ভাবসম্পদ। ধর্মের নামে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি ও সন্ত্রাসের এ সময়ে রুমির ভাব আন্দোলন আজও প্রাসঙ্গিক বলে তিনি মন্তব্য করেন।

প্রসঙ্গক্রমে গোটা বিশ্বে বিদ্যমান মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ব্যক্তির অতিকেন্দ্রিকতা সমাজের স্বাভাবিক বুননকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করে চলেছে। অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ধর্মকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। বিভিন্নভাবে ঘৃণা উদ্রেককারী ও সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে। মিতহাতের কথাতেও এ উদ্বেগ ও আশঙ্কা ধ্বনিত হয়েছে।

বক্তব্য দিচ্ছেন মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম
বক্তব্য দিচ্ছেন মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম

মিতহাতের স্বপ্নের মানবিক সমাজ বিনির্মাণে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের জন্য করণীয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, গুণগত শিক্ষার মাধ্যমে সবাইকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখাতে হবে। মুক্ত ও সহনশীল সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক মূল্যবোধ ও শ্রেয়বোধের চর্চা করতে হবে। মানবকল্যাণ, স্বাধীনতা ও প্রগতির বাণী সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আত্মধর্মীয়, আত্মসাংস্কৃতিক ও আত্মসভ্যতার সংলাপ, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এভাবে মিতহাতের স্বপ্ন পূরণ হতে পারে।

স্বাগত বক্তব্যে মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতাসহ উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ধর্মীয় সম্প্রীতি স্থাপনে বাংলাদেশ বিশ্বে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের শূন্য সহনশীলতার′নীতির কথা উল্লেখ করেন। শাহরিয়ার কবিরের মিতহাতের স্বপ্ন প্রামাণ্যচিত্রটি একটি সময়োপযোগী প্রচেষ্টা বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।

প্রামাণ্যচিত্রের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘রুমির শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের চারপাশের সবার প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে এবং মানুষ হিসেবে তাদের ভালোবাসতে হবে। পারস্পরিক সহযোগিতা ও আত্মনির্ভরশীলতাকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজের তথা মানবতার কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে। এ জন্য আমাদের সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা পরিহার করতে হবে।’ তিনি বলেন, সমাজ ও জাতির সর্বস্তরে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় ন্যায়বিচার, সহনশীলতা, সংহতি ও সহমর্মিতার চর্চা করতে হবে।

আলোচনায় উপস্থিতি
আলোচনায় উপস্থিতি

বাংলাদেশ-তুরস্কের মধ্যকার বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশেষত সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তুলে ধরতে গিয়ে কনসাল জেনারেল উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ও তুরস্কের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, ভ্রাতৃত্বমূলক ও বন্ধুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক সময় থেকে দুই দেশের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে, তা আজও অটুট ও কালপরিক্রমায় আরও শক্তিশালী হয়েছে। দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে ছাড়াও জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রসারিত হয়েছে। তিনি প্রসঙ্গক্রমে তুরস্কে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এবং বাংলাদেশে কামাল আতাতুর্কের নামে সড়কের নামকরণের বিষয়টিকে দুই দেশের গভীর সম্পর্কের প্রকাশ বলে মন্তব্য করেন। আগামী দিনগুলোতে দুই দেশের বিরাজমান সম্পর্ক আরও এগিয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

প্রশ্নোত্তরপর্বে শাহরিয়ার কবির উপস্থিত অতিথিদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। অনুষ্ঠান শেষে অতিথিদের সম্মানে বাংলাদেশি ঐতিহ্যবাহী খাবার সহযোগে ইফতার ও ভোজের আয়োজন করা হয়। বিজ্ঞপ্তি