গোল্ডেন বিচ

প্রসারিত সমুদ্রজুড়ে জীবনের উন্মত্ততা এখনো ফেটে পড়ছে উচ্ছলতায়। অধরা আকাশের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে নীলিমার হৃৎপিণ্ড ছুঁয়ে যাচ্ছে সে। গোধূলিলগ্ন উপস্থিত। অসম্ভব আকুলতা চারপাশে ছড়ানো। কিছুক্ষণ আগে নিরিবিলি হয়ে গিয়েছিল এ পাশটা। আসন্ন সন্ধ্যায় দর্শনার্থীর ভিড় নেই। হঠাৎ চোখে পড়ল দূরের গোল্ডেন বিচ লোকেলোকারণ্য হয়ে উঠেছে। ছেলে বুড়ো, নারী-পুরুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে কোলাহল মুখরিত হয়ে। সুচরিত উৎসুক হলো, ওখানে কী হচ্ছে বলো তো? অত মানুষের ভিড় জমেছে। যাবে? বেশি সময় লাগবে না। বিচ ধরে যাওয়া যাবে? হ্যাঁ। তখন ছেলেগুলো তো ওখান দিয়েই ছুটল, বলেই সামনের অপ্রশস্ত সৈকতভূমির দিকে হাত তুলল সে। তার জানার আকর্ষণ তীব্র।

কিন্তু হাঁটতে গিয়েই বুঝতে পারল গোল্ডেন বিচের দূরত্ব কম নয়। কাছে এসে দেখল, সেই রাজস্থানি উট আর টাট্টু ঘোড়াটা তখনো উপস্থিত। তাদের পিঠে কয়েকটি বালক হইহই করতে করতে বালির বিছানায় চরে বেড়াচ্ছে। এক প্রবীণ ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন, কেন ওদের ওপর জোরজুলুম করছ? মরুভূমির উট, টাট্টু ঘোড়া সাগরে নামে কখনো? উত্তরে তারই বয়সের অন্য প্রবীণ বললেন, কেরামতি জাহিরের প্রতিযোগিতা চলছে গো!

জগতে মানুষ নিজের কেরামতির ভাগ আর কাউকে দিতে তো প্রস্তুত নয়। তাই উট আর ঘোড়ার মালিক চাইছে জীব দুটোকে জোর করে জলে নামিয়ে কেরামতির প্রমাণ দিতে। তাতে উট, ঘোড়ার যাই হোক। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি ওদের কেরামতি। রোজই দেখছি এসব দৃশ্য। কাঁহাতক আর সহ্য হয়? তোমার কথা কবে ওরা শুনেছে ভূপাল? গোঁয়ার্তুমি করে সেদিনকার মতো আর মারামারি করতে যেও না। দেখছ তো, দর্শকেরা সবাই দেখতে চাইছে উট, ঘোড়া সত্যিই জলে নামে কিনা! আর সেদিন মালিকও তো বলল, আমার উট, আমার ঘোড়া, যা ইচ্ছে হয় করব, তাতে আপনার কী! দুই প্রবীণই বাঙালি। তাঁদের সহমর্মিতার অনুভব মুহূর্তেই ছুঁয়ে দিল বহ্নির কোমল অন্তর। সে কৃতজ্ঞ চিত্তে বলল, ভাগ্যিস আপনাদের মতো মানুষ জগতে আজও আছেন। নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তাই প্রতিবাদ ওঠে। সত্যিই তো ওরা কেন জোর করছে অসহায় জীব দুটোকে? ভূপাল ক্ষুব্ধতায় উচ্চারণ করলেন, কারণ ওরা মানুষ! মানুষ কী পারে আর পারে না, সেই হিসাব জগৎ আজও মেলাতে পারেনি। পারলে জগতের চেহারাটাই অন্য রকম হয়ে যেত!

দর্শকের কোলাহল এখনো চলছে। অনেকটা উঁচুর দিকে বালুর চরাচরে দোকানিরা পসরা সাজিয়ে রেখেছেন। চুড়ি, কসমেটিকস, শিশুদের খেলনা, জিলাপি, পাঁপড়, ঝালমুড়িসহ আরও সব লোভনীয় দোকানের সামনে জনতার ভিড়। বহ্নিরা এগোলো বাঁ দিক ধরে। সেদিকটায় নজরে পড়েছিল পাহাড়প্রমাণ ঢেউয়ের মাথায় দুটি ছেলে শোলার তৈরি পুতুলের মতো ডোবা ভাসার মরণ দোলায় দুলছে। ভেসে উঠছে, ফের পরক্ষণেই হারিয়ে যাচ্ছে ঢেউয়ের আড়ালে। দেখে মুহূর্তে হিম হয়ে গেল বহ্নির বুকের রক্ত। ঠিক তখনই পাশের রাজস্থানি তরুণীর ভয়ার্ত মন্তব্যও কানে এল তার, ‘হে ভগবান! উন লাদাকোন কিসি ভি ক্ষণ মিয়েন মর জায়েগা কাহাতে হৈ!’ সঙ্গের বর্ষীয়ান রমণী শান্ত স্বরে বললেন, ‘অত ভয় পাসনি বিন্দিয়া!’ প্রথম দিকে আমিও খুব ভয় পেয়েছিলাম মরে যাবে বলে। তারপর কতকাল ধরে দেখছি, পদ্মাসনে বসলে দুরন্ত ঢেউয়ের মাথায় ওরা দেবতা হয়ে যায়। সারা দিন তখন ভেসে থাকতে পারে। সবাই জানে, ওরা মানুষ নয়। দেবশিশু! তাতেই তো সবাই খেতে দেয়। ভালোবাসে।

এমন আশ্বাসে আস্থা নেই বহ্নির। তার মন বলল, জীবনবাজি রেখে এমন সর্বনাশা খেলায় কেন মেতেছে ওরা এভাবে? শুধুই খিদের প্রয়োজনে? প্রবল প্রতাপ জলরাশি যদি শৃঙ্খলিত ঢেউয়ের টানে টেনে নেয় বহুদূর? এমন হৃদয় দীর্ণ দৃশ্যই বা রোজ কী করে উপভোগ করছে সাগরপাড়ের মানুষগুলো? কথাগুলো বলতেই বিরক্ত হলো সুচরিত। শুনলে তো, এসবে ওদের অভ্যাস আছে! কিন্তু সাগরেরও তো অভ্যাস আছে সবকিছু টেনেহিঁচড়ে অতলে নেওয়ার। এই স্বভাবের জন্যই তুমি কিছু এনজয় করতে পার না বহ্নি। নেগেটিভভাবে সবকিছু চিন্তা করার অভ্যাস তোমায় পাল্টাটে হবে! হবেই হবে।

পরিব্যাপ্ত চারপাশজুড়ে অবর্ণনীয় সূর্যাস্ত রক্তিমাভা ছড়াচ্ছে অকৃপণ হাতে। যেন অন্য পৃথিবীর এক অচেনা জগৎ। অনিন্দ্যসুন্দর স্বপ্নের মায়ায় উৎসারিত হয়েছে হঠাৎ করে। উঁচু পাড় ধরে আরও উঁচুতে উঠে এল ওরা। আসতেই এক আশ্চর্য বাস্তবতা কেড়ে নিল চোখের আকর্ষণ। এক ত্রিশোর্ধ্ব তরুণ সাগরতীরে একটি অসাধারণ শিল্পকর্ম অনবদ্য আবেদনে ফুটিয়ে তুলছেন ধীরে ধীরে। চারপাশে সদ্য কৈশোর পেরোনো গুটিকয়েক ছেলেমেয়ে। একাগ্র মনঃসংযোগে সৃষ্টিকর্ম দেখতে দেখতে শ্রদ্ধায়, ভালো লাগায় বিগলিত হচ্ছে। সুচরিত দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে অজান্তেই বলে উঠল, বাঃ, অসাধারণ! ছেলেমেয়েরা মুহূর্তের জন্য পলকহীন তাকাল এবং সঙ্গে সঙ্গেই তৃপ্তির নিটোল হাসি অরুণোদয়ের আলো হয়ে ফুটে উঠল সবার মুখে। বহ্নি বলল, কিন্তু এমন অপরূপ শিল্পসৃষ্টি সাগরসৈকতে কেন? একটু পরেই তো ঝোড়ো হাওয়ায় ভেঙে যাবে চারু কাজ! মন্তব্য শুনে শিল্পী মুখ তুলে তাকালেন, তাতে কী হলো? সাগরের জলও তো ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেঙে পড়ছে তীরে এসে। সেটাও শিল্পীরই অনিন্দ্যসুন্দর কারুকাজ! আমি ভুবনেশ্বর বি কে কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসের শিক্ষক। এরা আমার ছাত্র। ওদের আমি শেখাচ্ছি, বলেই নমস্কারের ভঙ্গিতে হাত তুললেন। তরুণ শিক্ষকের কথায় আসন্ন সন্ধ্যার আলোছায়ায় মহাসাগরকে গভীরতায় দেখল বহ্নি। এক জোড়া স্যান্ডেল সেই মুহূর্তে সাগরের অদৃশ্য হাত ছুড়ে দিল সৈকতে। হয়তো সে আপন খেয়ালে টেনে নিয়েছিল দৃপ্ত দাপটে। তারপর তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে সৃষ্টির অমলিন পরশে ঠেলে ফেলে গেল তার স্পর্শের বাইরে। বহ্নি মনের গভীরে উচ্চারণ করল, কুড়ায়ে লও না কিছু করো না সঞ্চয়/তুমি তাই, পবিত্র সদাই। তরুণ শিক্ষকও কি এই কথারই ইঙ্গিত করলেন একটু আগে? ত্যাগের সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হলে পবিত্রতার পরশ শিল্পে পড়ে না? হারিয়ে যায় সৃষ্টির সার্থকতাও?

ব্যস্তময় রাজপথে উঠতে গিয়ে অনেক উঁচুতে দৃষ্টি যেতেই কুণ্ডলায়িত অগ্নিবলয় নজর কেড়ে নিল। সুচরিত দেখতে পেয়ে বলল, ওই দেখো, স্বর্গদ্বার মহাশ্মশান। ছেলেবেলায় মায়ের মুখে শুনেছিলাম এই শ্মশানের আগুন কখনো নেভে না। মানুষের বিশ্বাস, এখানকার চিতায় দেহ পুড়লে মৃত ব্যক্তি সরাসরি স্বর্গে যায়! বহ্নি জানে, জগতে অদ্ভুত, অযৌক্তিক, বিপজ্জনক বিষয়কেও মানুষ শুভদায়ক হিসেবে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে কখনো কখনো। এ ক্ষেত্রে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নির্বোধ-বুদ্ধিমান, ভিতু কিংবা সাহসীদের মধ্যে তেমন কোনো ফারাক নেই। এর কারণ সম্ভবত, মানুষ তার বিশ্বাসের জগতে এমন একটি বাস্তবতার অনুসন্ধান করে, যা তার স্বপ্ন পূরণের সহায়ক। প্রচলিত কথায় তাকেই বলে কুসংস্কার অথবা বদ্ধমূল ধারণা। সে একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, রাজপথের পাশে, এতগুলো হোটেলের কাছে কেন রেখেছে এমন এক মহাশ্মশান? তাতে অসুবিধে কী? নেই? এভাবে চোখের ওপর মরা মানুষ আর চিতার আগুন দেখতে কারোর ভালো লাগে? কিন্তু এটাই তো জীবনের বাস্তবতা বহ্নি! অন্তত এসব দৃশ্য রোজ দেখলে মানুষ জীবন সম্পর্কে কিছুটা হলেও শিক্ষা নেবে!

চলতে চলতে বুকের ভেতর উদাসী হাওয়ার পরশ বইছে বহ্নির। অন্তর উড়ে যাচ্ছে মহাকাশের অসীম পারে। মন জানতে চাইছে, কী শেখাচ্ছে এই বাস্তবতা? এত দিন যত কিছু চিন্তা, আনন্দ, ভালোবাসায় পূর্ণ হয়েছিল নশ্বর দেহ, মুহূর্তের অগ্নিশিখায় তার সবই নিঃশেষিত হবে? নাকি অধ্যাত্মবাদীরা যেমন বলেছেন, জীবন আর মৃত্যু কোনো আলাদা বাস্তবতা নয়, যেমন নয় সাগর আর নদী, সেই সত্যকে? (Life and death are one, as the river and the sea are one) .

রাজপথ থেকে নিচে নেমে আবার সাগরসৈকতে ফিরে এল ওরা। ঠান্ডা হাওয়ার হিমেল পরশ ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের শরীর। ততক্ষণে সুনসান হয়েছে চারপাশ। সুচরিত বলল, সূর্য অস্ত গেছে। দেখো, কী অসাধারণ দেখাচ্ছে চারপাশটা! বহ্নি এক অদ্ভুত কথা বলল এরপরে, হ্যাঁ সাগরের জলজুড়ে সূর্যের চিতাগ্নি থেকে আলো ঝরে পড়ছে! তার মানে, মৃত্যুও জীবনের মতোই সুন্দর তাহলে বলো! (চলবে)

ধারাবাহিক এ ভ্রমণ কাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন