ব্রাম্পটনে মেঘলা আকাশের নিচে
দীর্ঘ শীতটা শেষ হলো মাত্রই। বসন্তের প্রায় অর্ধেকটা শীতেই হারিয়ে গেছে। আকাশটা আজকাল স্বচ্ছ নীলাভ। কখনো তাতে সাদা-কালো মেঘের ছোটাছুটি। বরফ গলা স্যাঁতসেঁতে জমিনে আজ প্রাণচাঞ্চল্য সবুজের দোলা। শীতের প্রচণ্ড ঠান্ডায় মৃতপ্রায় ঘাসের মূল প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সেই প্রতিকূলতার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা পাতাবিহীন বিবর্ণ গাছগুলোও মরে যায়নি। আনন্দ আজ সেগুলোর শিরা–উপশিরায়। গজিয়েছে পাতা। বাড়ছে। প্রকৃতিতে আজ বইছে সুবাতাস। মনোরম পরিবেশ।
মনোমুগ্ধকর এই প্রকৃতি আজ ডাকছে সবাইকে। বেরিয়ে এসো। বদ্ধ ঘরের দুয়ার খুলে। নগরের সার্বক্ষণিক কোলাহলকে পেছনে ফেলে। একঘেয়ে ব্যস্ততাকে দূরে ঠেলে। মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে। অপরূপ সৃষ্টিকে দুই চোখ ভরে দেখতে। সবুজের আলতো ছোঁয়ায় প্রাণে দোলা দিতে। এসো।
কে না চায় এই নির্মল আনন্দ? এতটুকু অবসর? দীর্ঘ শীতে বাসস্থানের ড্রাইভওয়ে আর পাশের হাঁটাপথের ওপর ক্ষণে ক্ষণে জমা তুষারপাতের বরফকে সকাল-সন্ধ্যা সরানোর কষ্টকর কাজটায় বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। এ কাজে অভিজ্ঞতাটা নতুনদের জন্য প্রথম প্রথম অন্য রকম ভালো লাগায়। বেশিতে সত্যিই বিরক্তি। হাড়কাঁপানো ঠান্ডাও অসহনীয়। অধৈর্যের কারণ। নিত্যদিনের কর্মব্যস্ততা ছিল, থাকবে। সময় বের করতে হয় এর মাঝেই। এতটুকু প্রশান্তির জন্য। পরিবারের জন্য। সামাজিকতা রক্ষায়।
দুই.
দেশ থেকে দূরে এই ভিন দেশে পরিচিতজনেরাই আত্মীয়। আর সত্যিকারের আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলে তো অনেক বেশি কিছু। স্বভাবতই তাঁরা দেশের মানুষ। মনের মিল থাকে। আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি একই। মুক্তা আপা আমার সহধর্মিণীর কাজিন। থাকেন ব্রাম্পটনে। চাকচিক্যময় নতুন এক এলাকায়। যাব সেখানে। মে মাস। দুই পরিবারে চারজন ছেলেমেয়ের জন্মদিন এ মাসে। প্রায় পুরোটা মাস রোজা, শুরুটা দ্বিতীয় সপ্তাহে। গেট টুগেদার হয়নি বহুদিন। হওয়া দরকার। পরিকল্পনা শেষে দিনক্ষণ ঠিক হলো। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবার, ৪ মে। বিশাল আয়োজন হবে। আসবেন বন্ধুরা পরিবারসহ। ব্রাম্পটনে হবে দেশীয় আড্ডা। নেব দেশের স্বাদ। সবাই মিলে সেখানে গড়ব ছোট্ট বাংলাদেশ—থাকবে বড়রা আর নতুন প্রজন্ম।
বের হলাম আমরা। সেদিন দুপুরে। পূর্ব টরন্টোয় সকালটায় ছিল বৃষ্টি। বেলা বাড়লে ঝরঝর বৃষ্টিটা শেষ হয়েছে। তবে আকাশটাতে জমাট ভারী সাদা-কালো মেঘ। ভ্রমণের উপযোগী চমৎকার আবহাওয়া বটে। আরামদায়ক তাপমাত্রা, ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওন্টারিওর গর্ব হাইওয়ে ৪০১ দিয়ে চলছি। ডিভিপি এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে এগলিংটন-ডন মিলসে প্রয়োজনীয় কাজে যাত্রাবিরতি।
টরন্টোতে ৪০১ খুবই ব্যস্ত হাইওয়ে। চলার জন্য একমুখী প্রায় ছয় থেকে দশটা লেন। ডিভাইডারের ওপারে উল্টো দিকে যাওয়ার সমানসংখ্যক লেন। তা সত্ত্বেও বেশ ভিড় থাকে। বিশেষত পিক আওয়ারে। সকাল ৬টা-৯টা, বেলা ৩টা-৭টায়। আর সাপ্তাহিক ছুটির দুই দিন, দুপুর থেকে সন্ধ্যা। কী শীত, কী গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই সমান ব্যস্ত এই সড়ক। বুক চিরে ছুটছে গাড়ি। কাজে ছুটছে মানুষ। সবই নিয়মে। নেই হুড়োহুড়ি। নেই ধাক্কাধাক্কি। নেই বিরক্তিকর হর্ন বাজানো। সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। বেপরোয়া গতি আর মাতাল অবস্থায় চললে তা পুলিশের চোখ এড়ানো যায় না। আছে সিসি ক্যামেরা আর পুলিশি টহল। সংঘর্ষ আর সড়ক দুর্ঘটনা খুবই কম। তিন ধাপে পরীক্ষার মাধ্যমে যথাযথ যোগ্যতা প্রমাণ করে লাইসেন্স পাওয়া এই চালকদের কাছে নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে। কী হাইওয়েতে, কী লোকাল রাস্তায়—সবখানে সঠিক নিরাপত্তা। পুরো কানাডায়। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা অতিমাত্রায়। নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার যেন। জীবনের মূল্য কী এতই সস্তা? না নয়।
দেশে রাস্তাঘাটে মানুষের জীবনের এই নাজুক পরিস্থিতির কারণগুলো ভাবছি আর চমৎকার এই হাইওয়ে ৪০১ বরাবর পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলছি। ইটোবিকক অতিক্রম করলেই ডানে চোখে পড়ে বিমানের মুহুর্মুহু ওঠানামা। টরন্টো পিয়ারসন বিমানবন্দর সেখানে। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির শহর মিসিসুয়াগাকে বাঁয়ে রেখে হাইওয়ে ৪১০-এ প্রবেশ করলাম। ব্রাম্পটনের পথ এটা। এই পথে এগিয়ে মেফিল্ড ও চিগুয়াকোজি এলাকায় ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছালাম। বেলা ২টা। দক্ষিণ এশীয় অধ্যুষিত ব্রাম্পটনের নতুন এলাকা এটা। নিরিবিলি আবাসিক এলাকা। সুন্দর বাড়িঘর, বিশাল মাঠে বাচ্চাদের খেলার পার্ক।
তিন.
অতিথি ভরা আয়োজকের বাড়িতে আমাদের অভ্যর্থনা। আত্মার টানে সবাই আমরা এই মিলনমেলায়। দশটি পরিবার, সেখানে বড়রা আর নতুন প্রজন্ম। মুভি দেখা, খেলা, অভিজ্ঞতা শেয়ার, আলোচনা, আড্ডা সব আছে। বিশাল টেবিলের ওপর থরে থরে সাজানো প্রিয় সব খাবার। প্রাণোচ্ছল সময় কাটানো। একসঙ্গে কিংবা কখনো ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে।
শীত পেরিয়ে এই নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় ঘরের চার দেয়ালের মাঝে আড্ডাটা ঠিক জমে না। তাই বেরিয়ে পড়া। খেলার মাঠে আর শিশুদের পার্কে। আজকের দুনিয়ায় তুমুল জনপ্রিয় ক্রিকেটের আনন্দটা ব্রাম্পটনের এই মেঘলা আকাশের নিচে খুব ভালো উপভোগ করলাম। পার্কে উচ্ছ্বসিত কচিকাঁচারা। তাতে নির্মল আনন্দ। বিভিন্ন রাইডে উঠে বিনোদন আর বল হাতে ছোটাছুটি। সেটা দরকার সবার, সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য।
ঘর থেকে পা বাড়িয়ে বাইরের এই মুক্ত পরিবেশটাকে উপভোগ করার মজাই আলাদা। মাঝেমধ্যেই সন্তানদের আমার দেশের গ্রামবাংলার গল্প শোনাই। ঠাসাঠাসি করে গড়ে ওঠা আকাশচুম্বী সব বিল্ডিংয়ে ভরা আর দূষণযুক্ত ভারী বাতাসের শহর ঢাকার কথা নয়। শহর থেকে দূরের গ্রামে ধুলাবালু আর কাদামাখা পরিবেশে বেড়ে ওঠার গল্প। প্রাচুর্যে নয়, দারিদ্র্যের মাঝেই ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে প্রকৃতি থেকেই শেখার গল্প। বাবাকে ওরা জিজ্ঞেস করে, ছোটবেলায় পার্কে প্রিয় রাইড কী ছিল! আসলে খেলার জন্য পার্ক ছিল না, রাইডও না। আমি বলি ধানগাছের শুকনা চারা দড়ি দিয়ে বেঁধে বানানো বল নিয়ে খোলা মাঠে দৌড়াদৌড়ি করা। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তির-ধনুক-তরবারি বানিয়ে খেলা করা।
এই প্রজন্মের সঙ্গে আমাদের সময়কার পার্থক্যটা বেশ স্পষ্ট। স্কুল বয়সী হওয়ার আগেই হাতে পায় কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, স্মার্টফোন। স্কুলে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা। বিনোদনের জন্য ইনডোর আর আউটডোরে কতই না ব্যবস্থা। ভালো লাগে। বাচ্চারা বেড়ে উঠুক উচ্ছ্বাস আর আনন্দে। আর সঠিক শিক্ষাটা নিয়ে। তাদের মুখে হাসি ফোটাতেই জীবনযুদ্ধে বাবা-মায়ের অবিরাম ছুটে চলা। তাদের সুখের জন্যই আমাদের সব ব্যস্ততা।
আগের প্রজন্মের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ভালোবাসায় আমরা হয়েছি ধন্য। সুন্দর পরিবেশ তৈরিতে, আর আমাদের গড়ে তুলতে সব চেষ্টাই তাঁরা করেছেন। তাঁদের ছায়ায় আমরা খেলেছি, শিখেছি, আর বড় হয়েছি। সেই ছায়া দেওয়া মানুষেক আজ আমরা অনেকেই হারিয়েছি। দায়িত্ব এখন আমদের কাঁধে, নতুন প্রজন্মকে প্রস্ফুটিত করতে। একদিন আমরাও থাকব না। জীবন একটাই, আয়ু সীমিত। চিরন্তন সত্য। সবাইকে চলে যেতে হবে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। প্রস্তুত থাকাটা ভালো। মহতী এক উদ্যোগের কথা জানলাম সেদিন ব্রাম্পটনে। সেখানে স্থানীয় বাংলাদেশি মসজিদ কর্তৃপক্ষের (nice-canada. com) চেষ্টায় চালু হয়েছে মৃত্যু–পরবর্তী দাফন-কাফনসংক্রান্ত খরচের বিশেষ গ্রুপ পরিকল্পনা।
চার.
প্রকৃতি খুব সুন্দর। মানুষের জীবনটাও। সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে ক্লান্তিকর কাজে ব্যস্ততার পাশাপাশি জীবনকে উপভোগ করতে হবে। বের হতে হবে বদ্ধ ঘরের দুয়ার খুলে। মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে। অপরূপ সৃষ্টিকে দুই চোখ ভরে দেখতে। নীল আকাশে সাদা-কালো মেঘের সঙ্গে মনের খেলা করতে। সবুজের আলতো ছোঁয়ায় প্রাণে দোলা দিতে। কোনো দিন দূরে কোথাও সমুদ্রের কাছে গিয়ে বিশালতা শিখতে।
নিজ পরিবারের গুরুদায়িত্ব পালনের গণ্ডি পেরিয়ে সীমাবদ্ধ আয়ুর মূল্যবান জীবনে উদার মনের বিশালতায় মিশে যেতে হয় সমাজের সবার সঙ্গে। আত্মীয়, বন্ধু, অজানা মানুষ। দেশে-বিদেশে। পথ চলায় অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকাটা খুব দরকার। সঠিক শিক্ষা, নিরাপত্তা, উচ্ছ্বাস আর আনন্দে বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার।
...
ড. মো. সাদেকুল ইসলাম পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট।
ই–মেইল: < [email protected]>, ফেসবুক: < sadequl>