বড়বোন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সানাই বাজলেই যে বিয়ে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এই যে সকাল থেকেই আমাদের বাসায় সানাই বাজছে। কই আমার তো বিয়ে হচ্ছে না? আমার কেন, এই বাসার কারোরই বিয়ের কোনো খবর নেই আজ। কিন্তু ক্রমাগত সানাই বাজিয়ে চলছে আমার বোন। তার নাম পরি। আমার চেয়ে বছর দুই ছোট। বয়স ছাড়া অন্য সব বিষয়ে সে আমার চেয়ে বড়। সব বিষয় বলতে কী বোঝায়, তা পরিষ্কার করেই বলি।

নাম থেকে শুরু করি। আমার নাম তরি। ওর নাম পরি। তরি নামের অর্থ নৌকা। বাবা–মা কেন তাঁদের কন্যার নাম নৌকা রাখতে যাবেন, সে প্রশ্নের উত্তর আমার অজানা। যেদিন থেকে পরি জানতে পেরেছে আমার নামের অর্থ নৌকা, সে আমাকে নৌকা বলেই ডাকে! এ ক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই। কারণ, পরি নামের এ রকম উদ্ভট কোনো অর্থ নেই যার মাধ্যমে আমি আমার বোনকেও জবাব দিতে পারব। সুতরাং শুরু হয়ে গেল ওর বড়গিরি।

আমি যখন ক্লাস নাইনে, পরি তখন সেভেনে। হঠাৎ একদিন বাসায় বেল বাজলে আমি দরজা খুলে দিলাম। পরিও এসে দাঁড়াল আমার পেছনে। দরজার ওপাশের লোকটা ছিল আমার জন্য নিযুক্ত করা নতুন শিক্ষক। সেদিনই তাঁর প্রথম দিন। আমি তাঁকে চিনতাম না এবং তিনিও আমাকে চিনতেন না। বাবার পরিচিত কোনো কলিগের ছেলে। বাবাই ঠিক করেছিলেন। সে যা হোক, প্রথম দিন শিক্ষক এসে ছাত্রীর পরিচয় জিজ্ঞেস করবেন। তা না করে তিনি সরাসরি আমাকে বলে বসলেন, আমি তোমার বড় বোনের নতুন শিক্ষক। কথা শুনে পরির সে কী হাসি। নতুন শিক্ষক লজ্জা পেয়ে সেই যে গেলেন, আর আসেননি। আমার জন্য অন্য শিক্ষক রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমি ভেবেই পাচ্ছিলাম না কেন তিনি আমাকে ছোট বোন মনে করেছিলেন। আমার প্রশ্নের উত্তরের জন্য বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলো না। আমি আবিষ্কার করলাম পরি আমার চেয়ে বেশ লম্বা ও স্বাস্থ্যবান। সেই তুলনায় রোগা হওয়ার কারণে আমাকে সত্যিই ছোট দেখায়।

দিন যত এগোয় পরি আমার চেয়ে শারীরিকভাবে তত বড় হয়। আর আমার যেন বড় হওয়া মানা, ব্যাপক হারে ওজন কমে যাচ্ছিল আমার। ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা করে বলেছিলেন, আমার হরমোনে জন্মগত কিছু সমস্যা আছে। ডাক্তারের এই কথায় আমার তেমন কোনো দুঃখ হয়নি, পরিকে আমার একটুও হিংসা হয়নি। আমার শুধু দুঃখ হতো লোকে যখন জিজ্ঞাসা করত তোমার বড় আপুকে ডেকে দাও!

পরির বড়গিরি ডালপালা ছড়াল যখন আমাদের বিয়ের বয়স হলো। সব বিয়ের প্রস্তাব পরির জন্য। এমন না যে আমি পরির চেয়ে কম যোগ্য। বাবা–মা আমাদের দুই বোনকেই সমানভাবে যোগ্য করার চেষ্টা করেছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি আমরা অনেক এক্সট্রা কারিকুলামে জড়িত। পরি সানাই বাজায় তো আমি পিয়ানো বাজাই। সমস্যা হলো, আমাকে সবাই মনে করে অল্প বয়স। আর পরিকেই সবাই মনে করে বিয়ের উপযুক্ত। আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এল কি না, সে ব্যাপারে আমার তেমন মাথাব্যথা নেই। আমার কষ্ট হলো এই দিক থেকেও পরি আমার বড়বোন হয়ে গেল।

লেখিকা
লেখিকা

ছুটির দিনে ঢাকা শহরের জায়গায় জায়গায় বিয়ে হয়। বিয়ের সানাই বাজে। আর আমাদের বাসায় বিয়ের নামগন্ধ না থাকলেও পরি ম্যাডাম সানাই বাজাতেই থাকে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় পরি যে আমাকে এখনো বলেনি তাকে বড় আপু বলে ডাকতে, এটাই আমার পরম সৌভাগ্য।

আগেই বলেছি, আমি পরিকে একটুও হিংসা করি না। পরিও আমাকে হিংসা করে না একদম। আমাদের বোনে বোনে কখনো ঝগড়া হয় না। বরং আমাদের মধ্যে ভালোই খাতির। শুধু আমার ভেতরেই একটা চাপা কষ্ট। বড় বোন হয়েও আজীবন আমি ছোট বোনের স্বীকৃতি পেলাম। আমারও তো ইচ্ছা করে একটু বড়গিরি দেখাব। সে আর হওয়ার সত্যিই কোনো উপায় নেই। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবা–মা জানতেন আমার জীবন নৌকার মতোই ভাসমান। তাই হয়তো নাম রেখেছিলেন তরি।

আমার জন্মগত হরমোনের সমস্যা বাড়তে বাড়তে এমন একটা পর্যায়ে ঠেকেছে যে গত পাঁচ বছর ধরে আমি আর হাঁটতে পারি না। আমার দুই পায়ে কোনো জোর নেই। ইদানীং তো হাতেও জোর পাই না। হুইলচেয়ারই আমার ভরসা। এখানেও পরির আমার ওপর বড়গিরি দেখাতেই হবে। আমার দেখাশোনা করার জন্য মেয়েটা বিয়েই করল না। আমি জানি, আমার হরমোনের সমস্যা আরও বাড়বে এবং আমি আস্তে আস্তে অকেজো একটা বস্তু হয়ে যাব। ডাক্তার সে রকমই বলেছেন। কিন্তু পরির বিশ্বাস, আমি নাকি সুস্থ হয়ে যাব! বড়বোনের মতো দিনরাত আমার সেবা করেই চলছে। আশ্চর্য হলেও স্বীকার করতেই হবে, ওর বড়গিরির কাছে আমি সত্যিই হেরে যাই। এত করে বোঝালাম বিয়েটা অন্তত কর। তার ওই এক কথা, আগে আমায় বিয়ে দেবে।

আচ্ছা, আমার মতো অকেজোকে বিয়েটা করবে কে? কদিন পর কথা বলতে পারব কি না, কে জানে? আমি তো জেনেশুনে একটা ছেলের জীবন ধ্বংস করতে পারি না। কিন্তু এ কথা পরি বুঝলে তো? বাবা–মা সেই কবেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। পরির এককথা, সে আমাকে ছেড়ে কিছুতেই যাবে না! আমার মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়, আমার জন্য আমার বোনটারও সংসার হলো না! আমি প্রায় স্বপ্ন দেখি সানাইয়ের সুরে চারদিক মোহনীয়, আমার বোনটা স্বামীর হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। পরিকে এই স্বপ্নের কথা বললেই সে সানাই নিয়ে বসে। আমাকে বলে যায় সে সানাই বাজাচ্ছে আর আমি যেন দিবাস্বপ্নে তার বিয়েটা দেখে ফেলি!

বলেছিলাম না? ওর কাছে আমার শখ–আহ্লাদ সব মামুলি। কারণ, সে মনে করে আমিই ছোট। ওই যে শুরু হয়ে গেল পিয়ানোর সুর। আমার হাতের জোর কমে যাচ্ছে বিধায় এখন আর পিয়ানো বাজাতে পারি না। কিন্তু পরি জানে, পিয়ানোর সুর আমার কত পছন্দ! তাই সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পিয়ানোর কিছু বেসিক শিখে নিল। এখন তো দুর্দান্ত বাজায়। সব দিকেই যে বড়গিরি করতে হবে তার!

আমি ভাবি, আমার নৌকার মতো ভাসমান জীবনও এত আনন্দময় হতো না; যদি পরি না থাকত। আমি ইচ্ছা করেই ওর সঙ্গে খুব রাগারাগি করি, যেন সে আমায় ছেড়ে নিজের জীবন নিয়ে ভাবে। কিন্তু আমার সব পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দেওয়ায় পরির জুড়ি নেই। কারণ, তার তো বড়গিরি দেখাতেই হবে। যত্তসব।
...

কাজী সাবরিনা তাবাসসুম: মিলান, ইতালি।