মা, দেশমাতা ও শিক্ষা

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

অনেক বছর ধরে লাল হয়ে থাকা চোখটার দৃষ্টিশক্তি বুঝি ফুরিয়ে এল। খুব জ্বালা করে, সবকিছু ঝাপসা লাগে। আর পারছি না, আমাকে ডাক্তার দেখাও। এক মায়ের আকুতি এটা। ভগ্নদশা এ মায়াবিনীর পানে হতভাগ্য যুবক ভুলুর নির্বাক তাকিয়ে থাকা। হার মানা অসহায়ত্ব। সময়ে পেরে ওঠেনি। গড়িয়েছে সময়। মায়ের কাছে হেরে গেছে সে। তবু ভেঙে যায়নি। স্বপ্ন দেখে। জেতার স্বপ্ন। শিক্ষা নিয়ে বেড়ে ওঠা। চোখে পর্যবেক্ষণ আর মায়াবী দৃষ্টি।

দুই.

উত্তরাঞ্চলের এক প্রত্যন্ত এলাকায় পাড়াগাঁয়ে বেড়ে ওঠা ছেলে এই ভুলু। রক্তের লালিমায় মোড়া তার জন্মের নাড়িটা কোনো এক সবুজের সমারোহের নিচে মাটিতে পোঁতা। জন্মের সময় প্রসববেদনায় নেতিয়ে পড়া কষ্ট নিয়েও সন্তানের দিকে সে কী আনন্দের ঝিলিক দেওয়া মায়েদের চাহনি! শত কষ্টেও এই মায়েদের বিশ্বাসে থাকে অনেক জোর। নিজ শরীরে বেড়ে ওঠা সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। একটা শিশুকে এনে দেন তার প্রথম স্বাধীনতা। নিজস্ব সত্তা। বুকের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে তাকে কোলে জড়িয়ে রাখেন। নিজের এতটুকু যত্নের ফুরসত নেই। ঘুম নেই, আরাম নেই। চিন্তাভাবনায় নবজাতক। দিন-রাত সাংসারিক অক্লান্ত পরিশ্রম মাঝেও।

আধুনিক শহুরে জীবনের মতো গ্রামাঞ্চলে বাচ্চাদের বড় করার এত এত সামগ্রী কখনোই ছিল না। আজও নেই। গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে উন্নয়নের ছোঁয়াবিহীন কোনো এক পাড়াগাঁয়ের খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে এসব অবশ্যই কল্পনাতীত। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে, সীমিত সম্বলের জমিতে পরম মমতায় বড় করা ফসলের ওপর নির্ভর করা গ্রাম্য জীবন। ডায়াপার, ওয়াইপার, বেবি সোপ, বেবি শ্যাম্পু, হরেক পদের খাবার সিরিয়াল, বেবি মিল্ক ফর্মুলা, রং-বেরঙের ফিডার বোতল, স্ট্রলার এসব কোনো কিছুর ধারণা নেই। ভাগ্যচক্রে কেউ যদিও-বা অবগত হোন, এসব হাতে পাওয়ার আশা করা বাতুলতা মাত্র। অব্যবহৃত আর অপরিধানযোগ্য কাপড়কে বিভিন্ন মাপে কেটে মনের মাধুরী মিশিয়ে মায়েরা নকশি সেলাই করেন। মমতাময়ী মায়েরা তা শিশুর যত্নে কাজে লাগান। আধুনিক কালের ডায়াপার আর ওয়াইপারের বিকল্প সেগুলো।

বাচ্চাদের আদর, যত্ন, আর বড় করায় কষ্ট আছে। ঢের বেশি আনন্দও আছে। বাবার তুলনায় একজন মায়ের অবদান অনেকগুণে বেশি। এই মায়েদের দুগ্ধপানে সব পুষ্টিতে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা শিশুর শুরু হয় কথা বলা শেখা, বর্ণ শেখা। ভাষার ব্যবহারে যোগাযোগ স্থাপন। একসময় গুটিসুটি পায়ে স্কুলে যাওয়া। মাতৃকোল ছেড়ে এগিয়ে যাওয়া। মা শিশুকে এনে দিলেন এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা। শিক্ষার অধিকার ভোগের শুরু। শিশুশিক্ষা, বাল্যশিক্ষা। পরিবারের দেওয়া নৈতিক ও আদর্শের শিক্ষা। সামাজিক শিক্ষা, আর স্কুলে একাডেমিক জ্ঞানার্জন। এগিয়ে চলা।

তিন.

দারিদ্র্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সামনে চলা। চলতে হবে। পরিবারের শিক্ষা, আর সমাজের চাহিদা এটা। অনেক সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের শত শত সন্তান এই ভুলুদের বড় হওয়া আমি দেখেছি। তাদের জেনেছি। মায়ের আঁচলের মায়া কাটিয়ে, বাবার লুকিয়ে কান্নাকে উপেক্ষা করে অল্প বয়সে জীবনের প্রয়োজনে তারা পরিবার থেকে বের হয়। নিজেকে জানতে, আর তৈরিতে। নিজ এলাকায় উপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে, শুধু কলেজ পর্যায়ে নয়, এমনকি মাধ্যমিক স্কুলের অভাবে, শিক্ষার জন্য মাইলের পর মাইল দূরে গিয়ে থাকার দরকার পড়ে। হয় পরিবারছাড়া। নিজেকে আবিষ্কার করতে লড়াই। তৃতীয় স্বাধীনতা এটা, একলা চলা। আফসোস হয়, রাজধানীকেন্দ্রিক আমাদের দেশটায় সব সুবিধা যেন ঢাকায়। ভালো স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় সব ওখানে। বিভাগীয় শহরগুলোতেও প্রতিষ্ঠানের মান বেশ ভালো। মফস্বল শহরগুলোতে ততটা নয়। হাজার হাজার গ্রাম-বাংলার এই দেশ, অথচ পাড়াগাঁয়ে শিক্ষাটা কতই না নাজুক অবস্থায়!

লেখক
লেখক

মফস্বলে শিক্ষার পরিবেশ আসলেই নাজুক। গ্রামের এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসবেন উপজেলা চেয়ারম্যান এম আর আমিন। শিক্ষার মান আর পরিবেশ দেখতে। ১৯৮৭ সালের কথা। সেই ইউনিয়নে মোট তিনটি সরকারি বিদ্যালয়। কেন্দ্রের ভালোটিকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। অন্য কোনো দিন অনুপস্থিত থাকলেও, স্কুলে চারজন শিক্ষকের সবাই আছেন সেদিন। ইউনিয়নব্যাপী চারদিকে আলোচনামুখর পরিবেশ। সম্বল না থাকাতেও কিছুটা সাজ সাজ রব। নয়টায় আসার কথা থাকলেও দুপুর গড়িয়ে চেয়ারম্যান এলেন, ব্যস্ত মানুষ তিনি। হেডমাস্টার আর সহকারী হেডমাস্টারকে সঙ্গে নিয়ে সর্বোচ্চ ক্লাস পঞ্চমের শ্রেণিকক্ষে ঢুকলেন। ফার্স্ট বয়ের দিকে তাকালেন। ইংরেজিতে বলো 'আমি ভাত খাই'—তাঁর জিজ্ঞাসা। ভুলুর ঝটপট উত্তর 'আই ইট রাইস'।' আমি কি ভাত খাই? ' পরের প্রশ্ন। নীরবতা। একে একে সব কয়জন শিক্ষার্থীর মাথা নিচু হলো। উত্তর কেউই না পারায় চেয়ারম্যান তাকালেন শিক্ষকদের পানে। তাঁদের কাছ থেকে উত্তর চেয়েও শেষ অবধি নিরাশ হতে হলো।

তবে কি শিক্ষকদের অবহেলা? পুরাটা নয়। সংসার সামলিয়ে কম বেতনভোগী এসব শিক্ষক নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা তাঁরা করেছেন। গ্রামাঞ্চল এটা। সুযোগ-সুবিধা নগণ্য, মেধাবী মুখের অভাব, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণেরও অভাব। বর্ণিত ঘটনাটা অনেক আগের। এটা ২০১৯ সাল। আশা, এখন নিশ্চয়ই সেই অবস্থায় নেই। শিক্ষাকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টায় ব্যস্ত দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পরীক্ষা নিচ্ছেন বিভিন্ন ধাপে, পিইসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি। জিপিএ ৫-এর দৌড়ে ছাত্রছাত্রীরা। ‘আমি জিপিএ ৫ পেয়েছি’ এর ইংরেজিতে নিকট অতীতে জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রের উত্তর ‘আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ’। বেশ হতাশ করে যদিও। শুধু পরীক্ষা নেওয়া নয়, মনোযোগ দিতে হবে গুণগত শিক্ষায়। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের সঠিক দিকনির্দেশনা, আর গুণগত শিক্ষা দিতে যোগ্য শিক্ষকদের খুব দরকার।

চার.

শুধু পেশাদার শিক্ষকেরাই নন, মা-বাবা অথবা কাছের আত্মীয়দের মাঝে যে কেউ হতে পারেন একজন আদর্শ শিক্ষক। সে রকম একজন মানুষ আমার জীবনেও। মা। মাটির মানুষ, আমার জীবনের শিক্ষক। শিখিয়েছেন বাংলায় কথা বলা, বর্ণমালা, নীতি ও আদর্শ। পাঠিয়েছেন স্কুলে। বলেছেন সঠিক শিক্ষাটা নিতে। ভালোকে জড়িয়ে ধরতে, আর খারাপ থেকে দূরে থাকতে।

দেশ ছাড়ার আগে ২০০৩-এ শেষ দেখা, মায়ের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে, বিদায় নিয়েছি জাপানের পথে উড়াল দেব বলে। মা বলেছেন, মানুষ হও। বড় হও। বড় হওয়ার জন্যই তখন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছি। দেশ প্রতিরক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাঁর আরেক ছেলেও তখন দেশের বাইরে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের শান্তি মিশনে কর্মরত। পিএইচডি গবেষণার মাঝপথে মায়ের পরপারে চলে যাওয়ার খবরটা পাই। আগে ফোনে আমাকে বলেছিলেন, দেখতে মন চায়, কখন দেশে যেতে পারব। আমাকে না দেখেই ২০০৫ এর ২৯ আগস্টে মা আমার চলে যান। ডুকরে কেঁদেছি, এটা থামে না। আজও না। বুকটা হাহাকার করে, বড় শূন্যতা অনুভব করি। যে মাটির গন্ধ শুঁকে বড় হয়েছি, সেই অজপাড়াগাঁয়ে তাঁর প্রিয় লেবুর বাগানের নিচে কবরে শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন তিনি। এই মা তাঁর জীবনের সবটুকু ভালোবাসা নিংড়িয়ে তাঁর সন্তানদের দিয়ে দিয়েছেন। ছোট বলে, ভাগে আমি একটু বেশি পেয়েছি। পরিবারের সবাইকে খাইয়ে, পরে অবশিষ্টাংশটুকু কখন যেন খেতেন। নিজের জীবনভর দীর্ঘ অসুস্থতা ভুলে সবাইকে জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।

পাঁচ.

এই মায়েরা আমাদের গ্রামবাংলার প্রতিচ্ছবি। দেশের প্রতিচ্ছবি। দেশমাতা বাংলাদেশের কোলে বসে তার কোটি সন্তানেরা ধীরে ধীরে বড় হয়। শিখে ভাষা। এই ভাষার অধিকার আদায়ে জীবন দিয়ে আমরাই প্রতিষ্ঠা করেছি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। গর্বিত জাতি আমরা। লাখো শহীদের বিনিময়ে পেয়েছি স্বাধীনতাটাও। শহীদদের লাল রক্তে মাখা সবুজ জমিনটা আজ আমাদের। হাজারো সমস্যায় জর্জরিত এ দেশ। তবু, এখানেই ভোগ করি শিক্ষার অধিকারসহ সব। দেশের সম্পদ ভোগ করে, উচ্চশিক্ষা নিয়ে জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ বিভিন্ন কারণে দেশ থেকে হারিয়ে যায়। অর্জন দেশে ও বিদেশে। এর ব্যবহার অনেকটায় বিদেশে। আফসোস! এটা ব্রেইন ড্রেইন, মেধা পাচার। মতের পার্থক্য আছে হয়তো। তবে ভাববার সময় এসেছে।

মমতাময়ী মায়েরা নিজের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে সন্তান বড় করেন। দেন ভাষা শিক্ষা, আদর্শের শিক্ষা। দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রমে অর্জিত শেষ সম্বলটুকুও তাঁরা বিলিয়ে দেন সন্তানের একাডেমিক শিক্ষায়। সন্তানেরা কি প্রতিদান দিতে পারে? মন চাইলেও লাখো ভুলুরা সঠিক সময়ে তা পারে না। তবু মাকে অনেক ভালোবাসি। আমরা দেশকে ভালোবাসি। প্রাণে ধারণ করেছি লাল-সবুজের মানচিত্রকে। অনেক সমস্যার মাঝে শিক্ষাক্ষেত্রটা সবার ওপরে। শিক্ষকের যোগ্যতা, শিক্ষার মান, আর গবেষণা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। দেশকে দাঁড় করাতে ব্রেইন ড্রেইন ঠেকাতে হবে। স্বপ্ন দেখি একটা সুন্দর বাংলাদেশের। অন্যেরা পারে। পারব আমরাও।
...

ড. মো. সাদেকুল ইসলাম, পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, জৈব রসায়ন।
ইমেইল: <[email protected]> ফেসবুক: <sadequl>