আমোদ আলীর স্বপ্নপূরণ

পুরোনো ঘরের সামনে লেখিকার শ্বশুর-শাশুড়ি
পুরোনো ঘরের সামনে লেখিকার শ্বশুর-শাশুড়ি

আমার শ্বশুর সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। নাম আহমেদ আলী। কিন্তু গ্রামের চিরায়ত নিয়মের নিষ্পেষণে সেই নাম চাপা পড়ে আহমেদ আলীর পরিবর্তে হয়ে গেছে আমোদ আলী। নাম বিকৃতিতে গ্রামের মানুষের জুড়ি মেলা ভার। তাঁর এই নাম পরিবর্তন নিয়ে আমার অবশ্য মাথাব্যথা নেই। ভালোবেসে দেওয়া নাম আদু, গেদু, লেদুও ভালো। আমার নিজের দাদার নাম ছিল লেদু। সে বিচারে, আমোদ আলী নাম অনেক ভালো। আমার মাথাব্যথা ছিল যেটা নিয়ে এখন সেই গল্পই বলতে যাচ্ছি।

আমার শ্বশুর তার নিজ ভিটায় একটা বাড়ি করার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু জোর দিয়ে কাউকে কিছু বলতে পারতেন না। তার এই অব্যক্ত স্বপ্নটাই আমার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিল এবং আমিও আমার শ্বশুর অর্থাৎ আমোদ আলীর স্বপ্নপূরণের তাগিদে ছোটখাটো অট্টালিকার মতো একটা বাড়ি বানানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। হঠাৎই সুযোগটা এসে গেল। এত দ্রুত আব্বার স্বপ্ন পূরণ করতে পারব, সেটা আমি নিজেও ভাবিনি।

আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ মহান। আমার দেখা স্বপ্নের সেই বাড়ির কাজ বাস্তবে আজ প্রায় শেষের দিকে। এই তো কয়েক দিন আগের কথা, বাড়ির ছাদে বসে আব্বা আমাকে বললেন, ‘মা আমার জীবনে আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আল্লাহ আমার সব ইচ্ছা পূরণ করেছেন।’

কথাটা শুনে আমার চোখটা কেমন যেন ভারী হয়ে গেল। বুঝলাম আমার চোখভর্তি জল। এ জল লুকোনো যেমন যায় না, তেমনি গাল বেয়ে গড়াতেও দেওয়া যায় না। তবে এ জল কিছু সময়ের জন্য কণ্ঠরোধ করে দেয়। আর এটাও তো ঠিক, এমন আনন্দের জল সবার জীবনে আসে না। অতি বড় ভাগ্য নিয়ে যারা জন্মায়, কেবল তাদেরই আসে। নিঃসন্দেহে আমি সে দলেরই একজন। তাই আমার জীবনে এমন আনন্দের কান্না বহুবার এসেছে। সুবহানাল্লাহ।

আব্বাকে বললাম, আব্বা অনেকেই পেছনে অনেক কথা বলেছে। আমি নাকি না বুঝে শুনেই এত বড় বাড়ি করার স্বপ্ন দেখছি।

আব্বার খুব ছোট্ট উত্তর, ‘মা, তারা এখন দেখছে।’ এমন কথা শোনার পর আমার আর সত্যি আফসোসের কিছু থাকে না।

আব্বার কথা ভাবি। কতটা মনোবল থাকলে তাঁর ৬৭ বছর বয়সেও একা হাতে পুরো একটা বাড়ি তৈরির কাজ সামাল দিয়ে যাচ্ছেন। তাও যদি বাড়ির ধারে পিঠে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট কিছু একটা পাওয়া যেত। যা কিছুই লাগবে সব আনতে যেতে হয় থানা শহরে। বাড়ি থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে। সুখের কষ্ট যে কষ্ট নয়, তা আব্বার বাড়ি করার বাসনা দেখে বুঝি। একমাত্র তাঁর প্রচেষ্টাতেই এত দ্রুত বাড়ির কাজ শেষ প্রান্তে। অথচ, শুরুতে এই বাড়ি করা নিয়ে ফারুক হোসেন তো সাফ সাফ বলে দিল, দুই রুমবিশিষ্ট টিনশেড হবে। আমিও এক কথার মানুষ। আব্বাকে বলে দিলাম, ‘বাড়ি হলে বিল্ডিং না হলে নাই।’

আব্বা হয়তো আমার কথায় খুশিই হয়েছিলেন।

আসলে, বাংলাদেশের সব মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প হয়তো একই রকম। একটা ভালো কাজে দুজন এগোবে তো পাঁচজন পিছিয়ে দিতে চাইবে। আমি শুধু চেয়েছি আব্বা-মা আমাদের মতোই নগর জীবনের সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বাঁচুক। এখন যখন দেখি মা ঘরের মধ্যেই তার ছোট্ট রান্না ঘরে গ্যাসের চুলোয় রান্না করছেন, বাথরুমের জন্য বাইরে বের হতে হচ্ছে না, তখন তাদের ছেলের বউ হিসেবে নয় বরং তাদের মেয়ে না থাকার কষ্টটা দূর করতে পেরেছি ভেবে এক অজানা আনন্দে ভেসে বেড়াই। এমন আনন্দ হয়তো ব্যাংকে ১০ লাখ টাকা থাকলেও আমি পেতাম না। সে কারণেই ফারুক হোসেনের সঞ্চয়ের পুরো অর্থই বাড়ির পেছনে ব্যয় করতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি আমার।

কথা প্রসঙ্গে কথা মনে পড়ে, ছোটবেলায় একবার দাদির সঙ্গে গ্রামে প্রতিবেশী আরেক দাদির বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওই বাড়ির দাদি তখন আমার দাদিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাদলের মা (আমার আব্বার ডাক নাম বাদল), বাদলের বাসায় থাকো, বাদলের বউ তোমার যত্নআত্তি করে?’

আমার দাদি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বাদলের বউ আমাকে রাজরানির মতো রাখে।’

চাপা একটা কষ্ট নিয়ে ওই দাদি তখন বলেছিলেন, ‘বাদলের মা, তুমি এক ছেলে মানুষ করে রাজরানির মতো আছ। আর আমি এতগুলো ছেলে মানুষ করে কী করলাম! খুব বেশি কিছু তখন না বুঝলেও এটুকু বুঝেছিলাম, দাদি মায়ের প্রশংসা করলেন।’

বাড়ি এসে মাকে কথাগুলো বলার পর মার চোখেমুখে আনন্দের যে স্ফুলিঙ্গ আমি দেখেছিলাম, আজও আমার চোখের সামনে সে মুহূর্ত ছবির মতো জ্বলজ্বল করে।

আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক। তিনি হয়তো আমার মায়ের জীবনের কৃতকর্মের ফল তাঁর সন্তানদের সুদে-আসলে পুষিয়ে দিচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় এত দিন পরে এসে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে আমাদের সঙ্গে। আমার নিজেকে এখন মনে হয় আমি আমার শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে তাঁদের রাজকন্যা।

আমার মা যখন আমাকে বলেন, ‘জানো তোমার শ্বশুর মানুষের কাছে কী গল্প করে?’

আমি অতি আগ্রহে জানতে চাই, কী?

‘তোমার শ্বশুর গল্প করল, অমুকের ছেলে বাড়িতে টাকা দেয় না, এটা শুনে সে নাকি তাঁকে বলেছে, কী বলো! তোমার ছেলে টাকা দেয় না, আমার ছেলের বউ আমাকে টাকা পাঠিয়ে একবার জিজ্ঞেসও করে না আব্বা টাকা দিয়ে কী করলেন? আর তুমি বলো তোমার ছেলে টাকা দেয় না।’

কথাটা শুনে বানের পানিতে ভেসে যেতে ইচ্ছে হলো। আল্লাহকে বললাম, এমন বানের জোয়ার আমার জীবনে শতবার দিয়ো।

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল নতুন ঘরের ফার্নিচারের জন্য আব্বাকে আমার অস্ট্রেলিয়া এসে অর্জিত টাকা থেকে কিছু টাকা দিয়েছিলাম। আর তাতেই আব্বা এত খুশি। টাকায় টাকা আনে কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা, এটা এত দিনে আমি বুঝে গেছি। বরং দোয়ায় টাকা আনে। আমরা যারা ভাবি, বাড়িতে কখনো থাকব না, বাড়িতে ঘর করে কী হবে, ফার্নিচার করে কী হবে, অযথা টাকা নষ্ট। তারা কখনো ভুল করেও এটা ভাবি না, আমাদের বাবা-মায়েরা দুদিনের জন্যও যদি আমাদের কাছ থেকে সুখ পান, সে সুখের প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ আমাদের ফেরত দেবেন।

আমার মা-বাবাকে দেখেছি দাদিকে ভালোবাসতে। আর আমি ভালোবাসছি আমার বাবা-মা তথা শ্বশুর-শাশুড়িকে। আমার সন্তান তো এভাবেই শিখবে। পৃথিবীর সব সন্তানকে তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে আল্লাহ তৌফিক দিক তাদের পিতামাতাকে সন্তুষ্ট রাখার। আমিন।
...